মত-মতান্তর
মুখলেছুর রহমান রিটার্ন অ্যান্ড অল কোয়াইট ইন বেইলি রোড
যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান
(৩ বছর আগে) ২৭ জুন ২০২২, সোমবার, ১০:১৯ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৩:৫৪ অপরাহ্ন

১. শিক্ষক মুখলেছুর রহমান আবার ফোন করেছেন। অনেকদিন ফোন করেননি। করোনা মহামারীর সময় (ফেব্রুয়ারি ২০২১) তিনি প্রথম আমাকে ফোন করেন। ৫ হাজার টাকা বেতনের বাংলাদেশের নন-এমপিওভুক্ত একটি স্কুলের শিক্ষক মুখলেসুর রহমানের দুঃখের দীর্ঘ দিবসের কাহিনী দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশের (০৬.০২.২১) পর সিলেটের এক মানব সন্তান ( মোহাম্মদ শহীদ, VSAT System Engineering, Milton Keynes, UK) এবং সিলেটের তার এক বন্ধু হতভাগা ওই শিক্ষক এবং তাঁর আরো কয়েকজন শিক্ষককে আর্থিক সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসেন। এ কাহিনী পড়ে কিছু হতভাগা শিক্ষককে আর্থিক সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন ব্রিটেনে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত সিলেটের সন্তান ডা: এবাদুর রহমান চৌধুরী লাহিন। তাদের কেউই মুখলেছুর রহমানকে চিনতেন না। কিন্তু অভাগা শিক্ষক মুখলেছুর রহমানের জীবন সংগ্রাম তাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। নিজেদের মানবিকতা প্রবল হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারেন যে মানুষ হিসেবে তাদের কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্বের ভেতরে শিক্ষক মুখলেছুর রহমানের কষ্ট লাঘবের কিছু চেষ্টাও যোগ হয়ে যায়।
২. সেই মুখলেছুর রহমানের পরিবার এখন বন্যা আক্রান্ত। বাড়ির চারপাশে পানি এসেছে। ৫০০০ টাকা বেতনের সংসারে এখন বন্যার পানির সাথে চোখের পানি যোগ হয়েছে। ৬ এবং ১২ বছর বয়সী দুই মেয়ে বাবার অসহায়ত্ব বুঝতে পারে না। ফোনে সাহায্য চাওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছু বলেন না। তবে তার প্রতিবেশীর একটি গল্প বলেন। এই গল্প বলার জন্যই তার ফোন করা।
৩. ইউনিয়ন পরিষদে সরকারি কিছু ত্রাণ এসেছে। কিছু বেসরকারি সংস্থা থেকেও খাদ্য সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। অসহায় সেই প্রতিবেশী লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ত্রাণের ছোট বস্তা আনার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে নিজের নাম লিখিয়েছেন। সকালে রওনা দেবার জন্য ঘর থেকে বের হবার উপক্রম করতেই, বড় মেয়ে বাবার পথ আটকে দেয়।' বাবা তুমি ওই ত্রাণ আনতে যেওনা, তোমার ছবি তুলবে, ফেসবুকের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় চলে যাবে। একসময় আমি বিবাহযোগ্য হবো। হয়তো আমাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হবে। আমি হয়তো কোনো ভালো চাকরি করবো। কিন্তু তোমার এই ত্রাণ নেয়ার ছবির কারণে আমার হয়তো ভালো জায়গায় বিয়ে হবে না। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তুমি ওই ত্রাণ আনতে যেওনা।' মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওই প্রতিবেশী ত্রাণ আনতে যাননি। লন্ডনে থাকলেও ফোনে আমি বুঝতে পারি মুখলেছুর রহমান সাহেবের মন খারাপ। তিনি ফোন রেখে দেন। আমার বুঝতে বাকি থাকে না যে ওই প্রতিবেশী আসলে মুখলেছুর রহমান নিজেই।

৪. সিলেটবাসীর প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজনের ভালোবাসা দেখে সত্যিই আবেগাপ্লুত না হয়ে পারা যায় না। ঢাকা থেকে, চট্টগ্রাম থেকে গাজীপুর থেকে, সুদূর যশোর এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে থেকে গাড়িতে করে, ট্রাকে করে, ট্রলিতে করে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে লোকজন সিলেটের দিকে ছুটছেন। উদ্দেশ্য একটাই-ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত মানুষদের একটু সাহায্য করা। মুখলেছুর রহমানদের কষ্ট একটু লাঘব করা।
৫. পত্রিকায় তাদের খবর আসছে। ফেসবুকের কল্যাণে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও আমরা সিলেটের বন্যা আক্রান্ত মানুষের কষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মানুষের অসহায়ত্ব দেখে মানুষেরই কষ্ট লাগে, চোখ ভিজে যায়, একটু সাহায্য করার জন্য মনটা আনচান করে উঠে। লোকজন দান করার জন্য জেগে ওঠে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা সেই দান এবং ভালোবাসা নিয়ে সিলেটের দিকে রওনা দিচ্ছেন। সহায়তা করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন। লোকজন উদারহস্তে সিলেটের বন্যা আক্রান্ত মানুষদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসছে।
৬. দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অতীতে বেইলি রোডের যে মানবিকতা ও আন্তরিকতা দেখেছি তা এখন বিদায় নিয়েছে। কেন বিদায় নিয়েছে? পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আনন্দে যদি আপনারা বিরতি দিয়ে থাকেন তাহলে এবার একটু জেগে উঠুন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ। এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে সিলেটের অনেক এলাকায় ত্রাণ পৌঁছায়নি। মানুষ বড় কষ্টে আছে। চিকিৎসা ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। এক মুঠো চাল ডালের জন্য লোকজন পানিতে যুদ্ধ করছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজন আশ্রয় নিয়েছে। তাদের কষ্ট দেখে আপনাদের মন কাঁদে না? বন্যা আক্রান্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য টিএসসিতে আপনাদের হারমোনিয়াম আর গিটারে সুর ওঠে না কেন? পহেলা বৈশাখ আর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনের জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে আপনারা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন তার একটুও কি এখন দেখাতে পারেন না? আপনারা কোথায়? দু-একজন বিচ্ছিন্নভাবে কিছু করছেন- এর বাইরে কোন দৃশ্য আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এর রহস্য ভেদ করা আমার ক্ষমতার বাইরে।
৭. বাংলাদেশ একটি প্রচলিত ধারণা ছিল যে, যারা মসজিদ মাদ্রাসার ইমাম-খতীব, তাঁরা সাধারণত দান করতে জানেন না। শুধু দান গ্রহণ করে যান। এই বৃত্তটি এবার প্রকাশ্যে ভেঙে পড়ছে। পাঞ্জাবি-পায়জামা এবং টুপি পরা মাওলানা সাহেবরা এবং তাঁদের অনুসারীরা পাগলের মতো বন্যা আক্রান্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য সিলেটের ভেতর থেকে এবং শত শত কিলোমিটার দূর থেকে ডজন ডজন খাবার ভর্তি ট্রাক নিয়ে সিলেটে রওয়ানা দিয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা উপস্থিত থেকে বন্যার পানি ডিঙিয়ে মানুষের হাতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। বড় বড় রাজনৈতিক দলের তৎপরতা চোখে না পড়লেও পাঞ্জাবি-পায়জামা এবং টুপি পরা লোকদের তৎপরতা সবার চোখে পড়তে বাধ্য। সিলেটের মানুষদের প্রতি তাদের এই ভালোবাসা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
৮. সরকারি সাহায্যের আশা এবং গল্প আপাতত বন্ধ। উনারা এখন পদ্মা সেতু নিয়ে ব্যস্ত আছেন। নির্বাচন আসলে সিলেটের খবর নেওয়া যাবে। আপাতত পদ্মা সেতু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। পদ্মা সেতু দিয়ে কে প্রথম পাড়ি দিল, কে প্রথম মারা গেল, কে প্রথম সেতুর নাট বল্টু খুলে ফেললো, কে প্রথম টিক টক করলো, কোন নারী বাইকার প্রথম পদ্মা পাড়ি দিলেন, কে প্রথম পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে বিয়ে করলেন, কে কখন এ সেতু মোটরসাইকেল দিয়ে প্রথম পাড়ি দিলেন, কার সৌভাগ্য হলো প্রথমবারের মতো প্রাইভেটকারে পদ্মা সেতু পাড়ি দেওয়া- এসব সব নিয়েই আপাতত সরকার এবং অধিকাংশ মিডিয়া ব্যস্ত। আফসোস! মানুষের কান্না দেখার কেউ নেই!
৯. কুকুর -বিড়াল-পোষা প্রাণীদের জীবন রক্ষা করার জন্য যাদের মন কাঁদে, তারা কি সিলেটের এবং বৃহত্তর বাংলাদেশের পানিবন্দি অসহায় মানুষদের কান্না শুনতে পান? ত্রাণের খাবারের জন্য হাহাকার করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া সুনামগঞ্জের বিপ্লব মিয়া এবং তাঁর পরিবারের কান্না কি তাদের কানে যায়? চারদিকে অথৈ পানি। লাশ দাফন করার মতো মাটি নেই। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে যে ছেলে মায়ের লাশকে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছেন, এবং একটি কাগজে লিখেছেন 'শুকনো জায়গায় মায়ের কবর দিও' এমন ব্যক্তির কান্না কি কারো মনে দাগ কাটে? গাছ রক্ষা, মাঠ রক্ষা এবং প্রাণী রক্ষায় যারা সভা-সমাবেশ এবং অবস্থান ধর্মঘট করেন তারা এখন কোথায়? সবাই এখনও পদ্মা সেতু নিয়ে ব্যস্ত? দেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে ত্রাণের আশায় বসে আছে, নিজের ঘরবাড়ি সহায়-সম্পদ হারিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অমানবিক জীবন যাপন করছেন । তাদের নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই।
১০.সিলেটে ভয়াবহ বন্যা চলছে। কেমন ভয়াবহ? কিছুটা ধারণা করা যাবে নিজের এলাকার খবর নিলে। সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়ন কখনো এমন বন্যা দেখেনি। এলাকার প্রায় সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অতীতে কখনও এমন ঘটেনি। ইউনিয়নের নবনির্বাচিত তরুণ চেয়ারম্যান শামীম আহমদ পাগলের মতো গ্রাম থেকে গ্রামে চষে বেড়াচ্ছেন এবং হাটু পানিতে নেমে মানুষকে ত্রাণ দেয়ার চেষ্টা করছেন। অবস্থা সামাল দিতে না পেরে ফেসবুক ভিডিও এবং ফোন কলের মাধ্যমে প্রবাসে অবস্থানরত ভাদেশ্বরের মানুষকে সাহায্যে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছেন। মানবিক বিপর্যয় পুরো ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলেছে। এ মানবিক বিপর্যয়ের দৃশ্য এখন সিলেটের প্রায় প্রতিটি এলাকায় বিরাজ করছে।
১১. এই মানবিক বিপর্যয়েও ঢাকার বেইলি রোডের রঙ্গিন মানুষেরা বড্ড নীরব। যেমনটা নীরব টিএসসি। নীরবতা গ্রাস করেছে মিন্টু রোডকে। এফডিসির হাওয়াইয়ান গিটারে করুণ সুর উঠছে না। তাই বলে সাধারণ মানুষেরা ঘুমিয়ে নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন বা ঠিকানা টিভি (অনলাইনে) মতো প্রতিষ্ঠানের লোকজনই কেবল সিলেটবাসীর কান্না শুনতে পাচ্ছেন। বাকিরা সবাই ঘুমাচ্ছেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অনুষ্ঠান নিয়ে অনেক ক্লান্ত। এই ক্লান্তি যখন শেষ হবে তখন হয়তো সিলেটের মানুষ বন্যার সাথে যুদ্ধ করতে করতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। অথবা কেউ কেউ এই মায়াবী পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারার কষ্টে অনেক মা-বাবা রাতে ঘুমাতে পারবেন না। বন্যায় হঠাৎ করে গরীব হয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তরা ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে না পেরে অভুক্ত দিন কাটাবেন। লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারবেন না। কিন্তু সময় থেমে থাকবে না।
১২. বৃহত্তর সিলেট এবং বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় আক্রান্ত বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য যারা এগিয়ে এসেছেন এবং আসছেন, তাঁরাই বর্তমান এবং আগামীর বাংলাদেশ। মানবিকতার বাংলাদেশ। ঢাকার বেইলি রোড, মিন্টু রোড, লাল ভবন আর সংসদ ভবনই একমাত্র বাংলাদেশ নয়। এর বাইরেও বিশাল এক জনপদ ও জনগোষ্ঠী আছে যারা মানুষের কষ্ট দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেন না। উজাড় করে সব কিছু বিলিয়ে দেন। এরাই আসল বাংলাদেশ। এদের কারণেই শিক্ষক মুখলেছুর রহমানরা হয়তো এই যাত্রায় বেঁচে যাবেন। বেঁচে যাবে বাংলাদেশ।
ডা: আলী জাহান
যুক্তরাজ্যে কর্মরত বাংলাদেশী চিকিৎসক