ঢাকা, ১০ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৪ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

মত-মতান্তর

নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি কতোটা উপযোগী?

ড. মো. সফিকুল ইসলাম
১০ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার
mzamin

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার বিষয় নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতির প্রচলন কতোটা উপযুক্ত এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক চলছে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) পদ্ধতি দেশের জন্য কতোটা উপযোগী খতিয়ে দেখা দরকার। এ পদ্ধতি বলতে আসলে কী বুঝায়। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি এমন একটি নির্বাচন পদ্ধতি যার মাধ্যমে কোনো একটি আইনসভায় যে আসন থাকে তা প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। কিন্তু এটি একটি সরলীকরণকৃত সংজ্ঞা। এই পদ্ধতির লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভোটিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। প্রথমটি হচ্ছে লিস্ট সিস্টেম  প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (List System Proportional Representation)। এটি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমানুপাতিকভাবে আসন বণ্টনের জন্য সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অগ্রাধিকার অনুসারে নাম সাজিয়ে একটি প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। ভোটারগণ হয় তাদের পছন্দের দলকে ভোট দেন অথবা তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে বাছাই করে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তিন ধরনের পার্টি লিস্ট পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো হলো ক্লোজ লিস্ট যা ভোটার শুধু দলকে ভোট দেয়; ওপেন লিস্ট যা ভোটারগণ প্রার্থীদের বেছে নিতে পারে এবং সেমি ওপেন লিস্ট যাতে ভোটারদের কিছু সীমিত প্রার্থী পছন্দের স্বাধীনতা থাকে। এ পদ্ধতির অসুবিধা হলো ভোটারগণ কোনো বিশেষ প্রার্থীকে ভোট দেয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দলের অগ্রাধিকার বা প্রার্থীদের ক্রম (Order) অনুসারে ভোট দিতে হয়। এ ব্যবস্থায় প্রার্থীদের নিজ নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে কোনো সংযোগ থাকে না। তবে এ পদ্ধতিতে ছোট ছোট দলগুলো লাভবান হয়। যাই হোক, পৃথিবীর অনেক দেশে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা এ পদ্ধতি অনুসরণ করছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট। এ পদ্ধতি বহু আসনবিশিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ব্যালটে ভোটারগণ তাদের পছন্দক্রম অনুসারে প্রার্থীদের নামের তালিকা থেকে ১, ২, ৩ নম্বর দিয়ে ভোট দেন। প্রার্থীদের নির্বাচিত হতে হলে সুনির্দিষ্ট ভোটের কোটায় পৌঁছতে হয়। ভোটারদের প্রথম পছন্দের উপর ভিত্তি করে উক্ত নির্বাচনী এলাকায় বরাদ্দকৃত সব আসনের প্রতিনিধি নির্বাচন করা সম্ভব না হলে ভোটারদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দ গণনার জন্য বিবেচনা করা হয়। এ পদ্ধতির সুবিধা হলো সমানুপাতিকতা এবং সকল ভোট মূল্যায়ন করা যায়। তবে এই পদ্ধতিতে ভোট গণনা করা জটিল। এ ছাড়া প্রার্থীদের সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না। এ পদ্ধতি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ও আয়ারল্যান্ডে ব্যবহার করা হয়। তৃতীয়টি হচ্ছে মিশ্র পদ্ধতি। এ ব্যবস্থায় একই সঙ্গে দুই ধরনের ভোটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। এখানে নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে প্রার্থীদের সংযোগ তৈরির জন্য সুনির্দিষ্ট সংখ্যক আসনের ক্ষেত্রে মেজরিটেরিয়ান সিস্টেম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আবার অবশিষ্ট আসনের জন্য লিস্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে ভোটারগণ দু’টি ভোট দিয়ে থাকেন। একটি তার নির্বাচনী এলাকার প্রার্থীর জন্য এবং অন্যটি তার পছন্দের দলের প্রার্থী তালিকা অনুসরণ করে ভোট দেন। এ পদ্ধতি জার্মানি, হাঙ্গেরি ও নিউজিল্যান্ডে প্রচলিত রয়েছে।

তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, এ পদ্ধতির সুবিধা- অসুবিধা দুটো দিকই রয়েছে। সুবিধা হচ্ছে ভোটের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোট নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ছোট ছোট দলগুলো লাভবান হবে। তাদের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার অনুসারে সংসদে আসন পাবে। ফলে তাদের বার্গেনিং ক্ষমতা বেড়ে যাবে। কিন্তু এটা প্রচলনের জন্য সময় ও প্রস্তুতির প্রয়োজন। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ দেশে মেজরিটেরিয়ান সিস্টেম চালু আছে। জনগণ এ ব্যবস্থায় ভোট দিয়ে অভ্যস্ত। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতির সঙ্গে জনগণ পরিচিত নয়। দেশের অনেক ভোটার স্বল্প শিক্ষিত ও নিরক্ষর। তাদেরকে এ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া এ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি থাকা প্রয়োজন তা দেশে নেই বললেই চলে। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠান প্রচলিত নীতি ও আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে পারে না এবং বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার মতো শক্তিশালী নয়।  রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার সংকট রয়েছে। 

দেশের বিগত বছরের নির্বাচনগুলোর ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কোনো দলই ৩৯ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। তাহলে পূর্বের ফলাফল অনুযায়ী ৩০০ আসনের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলই ১২০ আসনের বেশি পাবে না। অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার সম্ভাবনা নেই বলা চলে। এখন অবশ্য আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আগামী নির্বাচনের ফলাফল ভিন্ন হতে পারে।  তবে যেকোনো নীতি দীর্ঘ সময়ের ফলাফল বিবেচনা করেই নেয়া উচিত। যাই হোক, পিআর পদ্ধতি প্রচলনের ফলে ভবিষ্যতে যদি কোনো রাজনৈতিক দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। কোয়ালিশনভুক্ত দলগুলো প্রত্যেকের নিজস্ব নীতি ও আদর্শ থাকবে। তাই প্রত্যেকের স্বার্থ ও আলাদা হবে। নীতি, আদর্শ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে কোয়ালিশনভুক্ত যেকোনো দল তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করতে পারে। তখন সরকারের স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়বে। সরকার বার বার ভেঙে পড়তে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে বার বার নির্বাচন করা ব্যয়সাপেক্ষ ও কঠিন। এতে তৃতীয় শক্তি সুযোগ নিতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ ছাড়া ছোট ছোট দলগুলো পিআর পদ্ধতিতে যখন ৫ থেকে ১০টা করে আসন পাবে। তখন দেখা যাবে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বার্থে এদের কাজে লাগাবে। যেটি দেশকে আরও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আরেকটি অসুবিধা হচ্ছে এ ব্যবস্থায় প্রার্থীদের নিজ নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে কোনো সংযোগ থাকে না। বর্তমান ব্যবস্থায় পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে নির্বাচনী এলাকার একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এমপিগণ সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছে। পিআর পদ্ধতির প্রচলন হলে এলাকা নেতৃত্বশূন্য  হয়ে পড়বে। সরকারের পক্ষে জনগণের সমস্যা সমাধান ও প্রত্যাশা পূরণ কঠিন হয়ে পড়বে। অতএব, পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করার মতো পরিবেশ আমাদের দেশে এখনো তৈরি হয়নি। এতে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক (ডেপুটেশন), রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status