মত-মতান্তর
বিলম্বিত কূটনীতি ও সরকারি ব্যর্থতা: শুল্কের ঝড়ে বিপর্যস্ত পোশাক খাত
ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার
(৮ ঘন্টা আগে) ৯ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ১০:৫০ পূর্বাহ্ন

২০২৫ সালের ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে একধরনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়েছে, যা কার্যকর হবে ১ আগস্ট থেকে। হোয়াইট হাউসের এই চিঠি ঢাকায় এসে পৌঁছানোর পরপরই সরকারের সর্বোচ্চ মহলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অথচ গত তিন মাস ধরে ব্যবসায়ী নেতারা বারবার অনুরোধ করে আসছিলেন—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত ও কার্যকর আলোচনা ছাড়া এই সংকট ঠেকানো সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো গতরাতে জানিয়েছে, বাংলাদেশের আলোচক দল এই কয়েক মাসে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের বাদ দিয়ে সরকারি আমলাদের নেতৃত্বে আলোচনার উদ্যোগ ছিল দুর্বল ও অপরিকল্পিত। শুধু স্বল্পোন্নত দেশের (LDC) সুবিধা চাওয়ার উপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো অর্থনৈতিক পরাশক্তির মন বদলানো সম্ভব নয়—এই বাস্তবতা সরকার অনুধাবন করতে পারেনি।
বর্তমানে যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক বসছে, তা আগের ১৫-১৬ শতাংশের সাথে যুক্ত হয়ে কার্যকরভাবে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের পোশাক খাতকে সম্পূর্ণ অনিয়মিত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এদিকে ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক হার ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। অথচ বাংলাদেশ এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনার পর্যায়েই ঘোরাফেরা করছে। অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত পূরণ করতে বাংলাদেশ হয়তো কিছু আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ক ছাড় দিতে পারে—যেমন আমেরিকান কৃষিপণ্য, গাড়ি, বা এয়ারক্রাফট—কিন্তু এর বিনিময়ে কী মিলবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের পোশাক খাতের লাখো নারী শ্রমিক। এদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী, যাদের আয় নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ডারের উপর। এই নতুন শুল্কের কারণে অর্ডার কমে গেলে, অনেক কারখানাই কর্মী ছাঁটাই কিংবা মজুরি কমাতে বাধ্য হবে। ফলে এই নারী শ্রমিকরা খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে চরম সংকটে পড়বেন।
পোশাক শ্রমিকদের অধিকাংশ আয় খরচ হয় খাদ্যের পেছনে। যখন আয় কমে যাবে, তখন সবার আগে খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট শুরু হবে। কম দামে বেশি ক্যালরি—এই নীতিতে চলতে গিয়ে পরিবারগুলো পুষ্টিকর খাবার ছাড়তে বাধ্য হবে, যা শিশু ও নারীদের মধ্যে অপুষ্টি ও রক্তাল্পতার হার আরও বাড়িয়ে তুলবে। বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে ইতোমধ্যে উচ্চমাত্রার খর্বকায়তা এবং স্বল্পজন্ম ওজনের সমস্যা আছে—এই সংকট তা আরও তীব্র করবে।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও বিপর্যয় আসন্ন। গ্যাস্ট্রিক, ক্লান্তি, অ্যানিমিয়া, ও গাইনোকলজিক্যাল সমস্যা নিয়মিত যেসব শ্রমিকদের হয়, তারা তাদের সীমিত আয় দিয়ে সাধারণত বেসরকারি চিকিৎসা গ্রহণ করেন। কিন্তু আয় কমে গেলে চিকিৎসা বাদ দেওয়া ছাড়া তাদের উপায় থাকবে না, যা রোগের জটিলতা বাড়াবে ও মৃত্যু ঝুঁকিও বহুগুণ বাড়াবে।
এই সংকটের গভীরে রয়েছে সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বল কূটনৈতিক কৌশল। যেখানে ভিয়েতনাম ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আগেভাগেই সমঝোতা করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে, সেখানে বাংলাদেশ লম্বা সময় ধরে নীরব ছিল। এমনকি বাণিজ্যিক অংশীদারদের সাথে সমন্বয়হীনতা, যুক্তরাষ্ট্রে কোনো দৃশ্যমান লবিইং উদ্যোগ না নেওয়া, এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আজকের এই বিপর্যয়ের মূল কারণ।
তবে এখনো সময় পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ১ আগস্ট পর্যন্ত শুল্ক কার্যকর করার সময় দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশকে তিনটি কাজ একসাথে করতে হবে: প্রথমত, জরুরি আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা নিশ্চিত করতে হবে; দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্য ও নগদ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে; এবং তৃতীয়ত, দ্রুত ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণে উদ্যোগ নিতে হবে।
এই শুল্ক আর শুধু একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নয়—এটি একটি মানবিক সংকটের পূর্বাভাস। এবং যদি সরকার এই সংকট মোকাবেলায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত ভেঙে পড়বে, লাখো শ্রমিক পরিবার দারিদ্র্যের অতলে হারিয়ে যাবে, এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি থমকে যাবে।
এই মুহূর্তে নেতৃত্ব দরকার সাহসী ও দূরদর্শী পদক্ষেপে। আর সেটা এখনই নিতে হবে—আগস্টের আগেই।
লেখক- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক উর্ধ্বতন ষাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ
পাঠকের মতামত
এটা গার্মেন্টস মালিকরা, বায়িং হাউস এর মালিকরা কেন তাদের নিজ খরচে লবিস্ট নিয়োগ করলো না ? বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, এত এসোসিয়েশন তাদের কাজ কি ?