মত-মতান্তর
ইউরোপের চিঠি
জুলাই আন্দোলন, প্রবাসীদের স্বপ্ন এবং দেশের ছবি
নিয়াজ মাহমুদ
(৮ ঘন্টা আগে) ৯ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ১০:৫২ পূর্বাহ্ন

একটি প্রবাদ আছে সকালের সূর্য দেখে নাকি বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে। তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায় আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে?
হাসিনার শাসনামলে জীবন বাচাঁতে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন দেশের প্রায় অর্ধশত সাংবাদিক, লেখক ও ইউটিউবার। এক শ্রেণির মিডিয়ার দালালির পাশাপাশি বেশিরভাগ মিডিয়া যখন বাধ্য হয়ে সেল্ফ সেন্সরশিপে চলে যায় তখন প্রবাস থেকে দেশপ্রেমিক সাংবাদিক ও ইউটিউবাররা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে লড়াই করেন।
জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থী - জনতার পাশাপাশি বিশেষ করে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে। ওই সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতে আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করায় ৫৭ বাংলাদেশিকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার ঘটনায় প্রবাসীদের পাশাপাশি জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। শিক্ষার্থী - জনতার আন্দোলনে দমন - পীড়নের এক পর্যায় সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে গণহত্যা শুরু করায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিটেন্স শাটডাউনের কর্মসূচি হাতে নেয়। এতে করে দ্রুত পরিস্থিতি বদলে যায় এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের অনেক বেড়ে যায়। ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট রিজার্ভ ২০২৫ সালের ২ জুলাই পর্যন্ত ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত রিজার্ভে বড় চাপ পড়েনি। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় এখনও স্থিতিশীল। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের উন্নতির কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার স্বপ্ন বহন করে দেড় কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। তাঁদের রক্তঘামে আসে বছরে প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার- যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রধান উৎস।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই অর্থে গড়ে উঠেছে গ্রামের অবকাঠামো, শিক্ষিত হয়েছে সন্তান, বদলে গেছে পরিবারের ভাগ্য। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে—দেশে ফিরে আসার পরে কি এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ও নিরাপত্তা পান?
সম্প্রতি গ্রিসের বাঙালি কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক এবং ‘জাহিদ ইসলাম’ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জাহিদ ইসলাম বাগেরহাট জেলা বিএনপির সদস্য খায়রুজ্জামান শিপন কাজীর ভয়ে দেশে এসেও অসুস্থ বাবা - মায়ের সঙ্গেও দেখা করতে পারেননি। সর্বশেষ তার আব্বা-আম্মার দোয়া মাহফিলের খাবারও ফেলে দিয়েছে শিপন। তাকে মোবাইলে ফোনেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি বাগেরহাটের এসপিকে জানিয়েও প্রতিকার পাননি প্রবাসী জাহিদ। পরে এসব অভিযোগ লিখিতভাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেয়ার পর শিপন কাজীকে শোকজ করা হয়। মাইগ্রেন্টওয়াচ মনে করে, শিপন কাজীদের মতো সুসময়ের নেতারা এখন দেশের জেলা - উপজেলাগুলো দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে! ওরা বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের সম্পদ নয়, আগাছা। আগাছা উপরে না ফেললে ফসল নষ্ট করে দেবে।
প্রবাসীদের ভোটাধিকারের দাবি
প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ চেয়ে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের প্রতি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর এ নোটিশ পাঠানো হয়।
২৬ জুন প্রবাসে অবস্থানরত ১৭টি দেশের ২০ জন বাংলাদেশি নাগরিকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির রেজিস্ট্রি ডাকযোগে এ নোটিশ পাঠান।
বিশ্বের প্রায় ১৭৬টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীরা বসবাস করছে। যেহেতু বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি— যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে ২০২৪ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সপ্তম। যেহেতু ভোটাধিকার নাগরিকের একটি রাজনৈতিক অধিকার। এটি আমাদের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। একজন নাগরিকের সাময়িক অবস্থানের পরিবর্তনও সংবিধান স্বীকৃত।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করা স্টকহোম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের (আইডিইএ) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১২৬টি দেশ তাদের প্রবাসী নাগরিকদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দেয়। তাই বাংলাদেশি প্রবাসী নাগরিকদেরও এই সুযোগ দেয়া উচিত।
সংস্কারের পাশাপাশি রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা পূর্ণ করার এখনই সময়। তাঁদের অবদানকে জাতির উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে না রাখলে উন্নয়ন শুধু ঢাকের বাদ্য হবে—গভীরতা থাকবে না। রাষ্ট্রের উচিত, নিজের দায়িত্ববোধ থেকে এই প্রবাসী জনগণের পাশে দাঁড়ানো। জুলাই মাসের একটি নির্দিষ্ট দিন প্রবাসীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঘোষণা করা উচিত।
রেমিটেন্সের টাকায় দেশের রিজার্ভ বাড়ছে। আর প্রবাসীদের রেমিটেন্সের প্রণোদননা! শেখ হাসিনার আমলে দেয়া ওই আড়াই শতাংশই রয়ে গেছে। আর তাই কথায় নয়, কাজেই প্রমাণ করুণ বাংলাদেশি রেমিটেন্স যোদ্ধারা দেশের রিয়েল হিরো।
লেখক: সম্পাদক, মাইগ্রেন্টওয়াচ ডট নেট