মত-মতান্তর
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
অ্যান্থোনিও গুতেরেজের কাছে খোলা চিঠি
গাজী আসাদুজ্জামান
৯ জুলাই ২০২৫, বুধবার
ইসরাইল শুধু একটি রাষ্ট্রই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের একটি বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। তারা কাউকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, ইরাক, জর্ডান- সবার উপর মাতব্বরির ছড়ি ঘোরাচ্ছে। তটস্থ করে রেখেছে ইরানকে। কিন্তু ইরান এবার সাহসিকতার সঙ্গে ইসরাইলি আগ্রাসনের জবাব দিয়েছে। তারা প্রথমে হামলা করেনি। আগে তাদের ওপর আগ্রাসী হামলা চালানো হয়েছে। আক্রান্ত হওয়ার পর ইরান পাল্টা জবাব দিয়েছে। কিন্তু ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের যে মজুতের কথা বলা হচ্ছে, তা কোথায়? কেউ কি প্রমাণ দেখাতে পেরেছে?
এক্সেলেন্সি জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্থোনিও গুতেরেজ, আপনি কেমন আছেন? নিশ্চয় ভালো না। কারণ, একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অন্যদিকে ইসরাইল-ইরানের সংঘাত। সেই সঙ্গে আমেরিকার ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং ইরানের কয়েকটি পারমাণবিক প্লান্টে বি-টু বোমারু বিমান দিয়ে বোমাবর্ষণের ঘটনা আর একই সঙ্গে ইসরাইলের গাজা ত্রাণশিবিরগুলোতে জাতিসংঘের ত্রাণ বিতরণকারী সদস্যদের ওপর নির্বিচারে গুলি ও গাজাবাসীর ওপর অহরহ বোমাবর্ষণের ঘটনায় আপনার ভালো থাকার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। গত ৩রা জুলাই বৃহস্পতিবার ইসরাইলের হামলায় আরও ১১১ জন গাজাবাসীর প্রাণহানি ঘটেছে। রোববার ৬ই জুলাই মারা গেছে ৮১ জন। একই সঙ্গে মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।
মি. গুতেরেজ আমরা বাংলাদেশিরাও কিন্তু ভালো নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে আমরা খুব চাপের মধ্যে আছি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আগমনে তাদের নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। তাদের কারণে আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্পগুলোতে অহরহ খুনখারাবি লেগেই আছে। বছরের পর বছর ধরে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর শরণার্থীদের মানব বর্জ্য পরিবেশ-পরিস্থিতিকে অসহনীয় করে তুলছে। এই বিরাট সংখ্যক শরণার্থীর বোঝা এখন আমাদের ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কবে নাগাদ এই সমস্যার সমাধান হবে তা আল্লাহ মালুম।
আপনি তো জানেন মি. গুতেরেজ একসময় ভারত উপমহাদেশ বৃটিশ শাসকদের কব্জাগত ছিল। বৃটিশরা এক সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে নিম্নশ্রেণির লোকজনকে জোর করে, কোথাও কোথাও নানা ধরনের প্রলোভন এবং ভালো বেতনের লোভ দেখিয়ে বার্মার গহিন জঙ্গল পরিষ্কার করে লোকালয় ও বিভিন্ন স্থাপনা, মিলিটারি ক্যাম্প নির্মাণের লক্ষ্যে এদের নিয়ে আসে। এর মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী লোকজনই বেশি ছিল। তারা বার্মার জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানেই চাষাবাদ এবং কাজ করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বসবাস করে আসছিল। বাংলা ভাষাভাষী এবং মুসলিম হওয়ার কারণে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাদের উৎখাতে সেনা শাসকদের সহযোগিতায় তাদের বিতাড়নের লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে গুলি, মহিলাদের ধর্ষণ এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে তাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। মিয়ানমার সেনাদের নির্বিচারে গুলি আর অত্যাচারে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। সেই থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বোঝা বহন করে চলেছে বাংলাদেশ।
মাননীয় মহাসচিব, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই অমানবিক হত্যাযজ্ঞ আর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় জাতিসংঘ শুরু থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের সাহায্য সহযোগিতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বেঁচে থাকার প্রেরণা পাচ্ছে। খেয়ে-পরে বাঁচছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে যেতে পারছে না। বিভিন্ন দেশের সাহায্য সহযোগিতা চেয়েও এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের অনুরোধেরও তোয়াক্কা করছে না। এই সমস্যার সমাধান কোন পথে, বাংলাদেশের মানুষ তা বুঝে উঠতে পারছে না। বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয়। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তাই এদেশের পক্ষে বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গার বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। এ সমস্যার আশু সমাধান একান্তভাবে কাম্য।
মাননীয় মহাসচিব ইদানীং বাংলাদেশে আবার শুরু হয়েছে ভারতের পুশব্যাক অ্যাকটিভিটি। তারা বাংলা ভাষাভাষীদের দেখলেই ধরে এনে বাংলাদেশের সীমান্তে এনে সুযোগ বুঝে পুশব্যাক করছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বসবাসকারী বাংলাভাষীদের ধরে এনে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে মহারাষ্ট্রে পশ্চিমবঙ্গ থেকে একদল শ্রমিক কাজের সন্ধানে মহারাষ্ট্রে গিয়েছিল। বাংলাভাষী দেখে মহারাষ্ট্রের পুলিশ ওদের গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করছিল। কিন্তু ওই গ্রেপ্তার হওয়া দলে একজন শ্রমিক ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে মোবাইল ফোনে জানালে তিনি ত্বরিত ব্যবস্থা নেন। তিনি বলেন, বাংলায় কথা বললেই কাউকে বাংলাদেশি বানিয়ে, পরিবার ছাড়া করে দেয়া হচ্ছে। এটা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর অসভ্য ও দমনমূলক আচরণ। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। তার কঠোর প্রতিবাদের মুখে পরবর্তীতে মহারাষ্ট্রের পুলিশ ওদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই প্রতিপাদ্যকে অবলম্বন করে ভারত এই বাংলা ভাষাভাষীদের ধরে বাংলাদেশে পুশব্যাকের কর্মসূচি নিয়েছে। এই ধরনের কার্যকলাপ যাতে ভারত বন্ধ করে এব্যাপারে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি মাননীয় মহাসচিব।
মি. গুতেরেজ, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসছি। যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান নয়। যুদ্ধ কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে। কিছুদিন আগে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে আমরা আকাশে আতশবাজির খেলা দেখেছি। এই মারণাস্ত্রের আতশবাজি খেলায় ইরান-ইসরাইল রাষ্ট্রের মানুষের লাশের সারি দেখেছি। সেই সঙ্গে দেখেছি, সহায় সম্পদের ধ্বংসাবশেষ। এই ধ্বংসলীলা কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। গত ১লা জুলাই ও ৬ই জুলাই দেখেছি ইসরাইলি সেনাদের গাজায় ধ্বংসলীলার বর্বরচিত্র। অসহায় শিশু-বৃদ্ধ আর যুবাদের মৃত্যু। এ মৃত্যু শুধু দীর্ঘায়িত হচ্ছে। লাশের সারি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনই যদি বর্বর এই ইসরাইলের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা না হয় তাহলে একসময় দেখা যাবে, গাজা মানুষশূন্য হয়ে পড়েছে। বর্বর এই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে থামানো না গেলে এই মৃত্যুর সারি ক্রমশ দীর্ঘায়িতই হবে। এরই মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হবে। তার এ ঘোষণার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফর করছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। বলা হয়, নিজের দেশের ভেতরেই জগাখিচুড়ি অবস্থায় আছেন তিনি। তার ওপর চাপ আছে। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প তাকে যুদ্ধবিরতিতে কতোটুকু সম্মত করাতে পারবেন বা এর উদ্দেশ্য কতোটুকু আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হওয়ার পর গাজাকে দখল করে সেখানে ভূমধ্যসাগরের রিভেরা বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তার এমন বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে নেতানিয়াহু বর্বরের মতো নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন সেখানে নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরছে। এরই মধ্যে গাজার মোট ভূখণ্ডের শতকরা ৬০ ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে ইসরাইলি সেনারা। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কথাটার অর্থই হলো তারা সে এলাকা দখল করেছে। সমানতালে চলছে পশ্চিমতীরে হামলা। সেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিরা। তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নৃশংস লুটপাট করছে। বিশ্ব মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে ইসরাইলের হাতে। আপনি জানেন, জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আইসিজে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এই যখন অবস্থা তখন নেতানিয়াহু আইসিজের সেই নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিভিন্ন দেশ সফর করছেন। তাহলে ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার অর্থ কী থাকলো! ফ্রান্স সহ বহু দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জাতিসংঘ তো দেশে দেশে সংঘাত, যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত। তাহলে এ সময়ে জাতিসংঘ কী কাজ করছে? কেন ইসরাইলের গণহত্যা বন্ধ করতে পারছে না? পক্ষান্তরে ইসরাইল ও পশ্চিমারা সন্ত্রাসী আখ্যা দিচ্ছে সেই হামাসকে, যারা তাদের নিজেদের একটি ভূখণ্ডের জন্য লড়াই করছে যুগের পর যুগ ধরে। নিজের দেশের অধিকার আদায় করতে গেলে কেন তারা সন্ত্রাসী হবে?
ইসরাইল শুধু একটি রাষ্ট্রই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের একটি বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। তারা কাউকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, ইরাক, জর্ডান- সবার উপর মাতব্বরির ছড়ি ঘোরাচ্ছে। তটস্থ করে রেখেছে ইরানকে। কিন্তু ইরান এবার সাহসিকতার সঙ্গে ইসরাইলি আগ্রাসনের জবাব দিয়েছে। তারা প্রথমে হামলা করেনি। আগে তাদের ওপর আগ্রাসী হামলা চালানো হয়েছে। আক্রান্ত হওয়ার পর ইরান পাল্টা জবাব দিয়েছে। কিন্তু ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের যে মজুতের কথা বলা হচ্ছে, তা কোথায়? কেউ কি প্রমাণ দেখাতে পেরেছে? উল্টো ইরাকে যেমন মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে, লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হয়েছে, ইরানেও সেই একই ধারা অনুসরণ করা হয়েছে। কিন্তু ইরাক বা লিবিয়ার মতো না হয়ে বাঘের মতো জবাব দিয়েছে ইরান। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র যে হামলা করেছে ইরানে, এর যৌক্তিকতা কি? তারা যে ১২ দিনের যুদ্ধ করেছে তাতে কী সুফল এসেছে? উল্টো কয়েক শত মানুষের প্রাণ গেছে। ক্ষতি হয়েছে বহু কোটি টাকার সম্পদ। এই সন্দেহপ্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের।
তাই আসুন মি. গুতেরেজ, আমরা একটি সাম্যাবস্থার সমাজ প্রতিষ্ঠা করি। সেখানে প্রতিটি দেশ, প্রতিটি মানুষ পাবে ন্যায়বিচার। এক দেশ ইচ্ছা হলেই আরেক দেশকে আক্রমণ করতে পারবে না। ইচ্ছা হলেই এক দেশ থেকে শুধু ভাষার মিল থাকায় যেন কোনো নাগরিককে ঠেলে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিতে না পারে- আসুন সেই লক্ষ্যে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে কাজ করি। আর বলি যুদ্ধ-সংঘাত নয় শান্তি। আর আমরা শান্তি চাই।
পাঠকের মতামত
লেখনি ভাল কিন্তু গুতরেজের খমতা নেই এ সব সমস্যার সমাধান করার।
সুন্দর লেখা, তবে আমি মনে করি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো পাওয়ারের ক্ষমতা জাতিসংঘের সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশ ভোটে বাতিল করার বিধান সংযুক্ত করলে পরাশক্তি গুলির দম্ভ কমে আসবে ।।