মত-মতান্তর
এসডিজি অর্জনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংস্কার অপরিহার্য
ডা. আবু জামিল ফয়সাল
১০ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার
তামাক বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়নের জন্য এক মহাবিপর্যয়। তামাক এমন একটি পণ্য, যা ব্যবহারকারীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষকে অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে প্রাণ হারান, যা আমাদের উন্নয়নের পথে এক বড় বাধা। তামাকের ভয়াবহতা হ্রাসে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-তে স্বাক্ষর করে। এরপর ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১৩ সালে তা সংশোধন করে আরও যুগোপযোগী করা হয়। ২০১৫ সালে এই আইনের বিধিমালাও পাস হয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর ৩ নম্বর অভীষ্টেও এফসিটিসি বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে কিছু দুর্বলতা থাকায় জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় এখনও যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
বিদ্যমান আইনে পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা রাখার বিধান থাকায় অধূমপায়ীরা প্রতিনিয়ত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় আইনটি শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একটি খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করলেও এখনো তা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে, তামাকজনিত মৃত্যু ও ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষ মারা যান। বাংলাদেশেও এই চিত্র ভয়াবহ। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, কর্মস্থলে ৪২.৭ শতাংশ এবং গণপরিবহনে প্রায় ২৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।
তামাক কোম্পানিগুলো তাদের আগ্রাসী বিপণন কৌশলের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে মরিয়া। বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্যের আকর্ষণীয় প্রদর্শন এক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। শিশুরা প্রায়শই তাদের পছন্দের খাবার ও খেলনার পাশে তামাকের প্যাকেট দেখতে পায়, যা তাদের মনে কৌতূহল ও আগ্রহ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে ৬৪.১৯ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্রে ক্যান্ডি ও চকলেটের পাশে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন করা হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো কৌশলে বিজ্ঞাপন চালিয়ে যাচ্ছে। তাই, খসড়া সংশোধনীতে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব একটি অত্যন্ত জরুরি ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
অন্যদিকে, তামাক কোম্পানিগুলোর তথাকথিত কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রম জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির একটি অপকৌশল। প্রাণঘাতী পণ্য উৎপাদন করে জনকল্যাণের নামে অর্থ ব্যয় করা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ব্যবসার প্রসার এবং মুনাফা বৃদ্ধি করা।
বিড়ি-সিগারেট ও গুল-জর্দার খুচরা বিক্রি তামাকের ব্যবহার কমানোর পথে একটি বড় অন্তরায়। স্বল্প আয়ের মানুষ ও তরুণরা খুব সহজেই অল্প খরচে এসব পণ্য কিনতে পারে, যা তাদের মধ্যে তামাকের অভ্যাস তৈরিতে উৎসাহিত করে এবং এই অভ্যাস ত্যাগ করতে নিরুৎসাহিত করে। খুচরা বিক্রি বন্ধ করা গেলে একদিকে যেমন তামাকের সহজলভ্যতা কমবে, তেমনি প্যাকেটের ওপর মুদ্রিত স্বাস্থ্য সতর্কবার্তাও সকলের নজরে আসবে।
ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস, যেমন ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং, তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি নতুন বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আকর্ষণীয় ডিজাইন ও বিভিন্ন ফ্লেভারের কারণে খুব সহজেই তারা এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাজারে ১৬,০০০ ধরনের ফ্লেভারযুক্ত ই-সিগারেট রয়েছে। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশে এর ব্যবহার ইতিমধ্যেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যবহার বাড়ছে। খসড়া সংশোধনীতে এই ধরনের পণ্য নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তামাকের ভয়াবহ স্বাস্থ্য ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্যকে রক্ষা করতে হলে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কজাতকরণে কঠোর নিয়ম আরোপ করা জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি’র ধারা ১১ ও ১৩ অনুযায়ী, তামাকপণ্যের প্যাকেটের বড় অংশে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে এই সতর্কবার্তার আকার তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট। খসড়া সংশোধনীতে এর আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করার প্রস্তাব একটি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ।
তামাক শুধু জনস্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি নয়, এটি দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর ওপর এক বিশাল বোঝা। বাংলাদেশে তামাকজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের ফলে বছরে ৬৫২.৮৬ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। পরোক্ষ ধূমপানের আর্থিক ক্ষতিও কম নয়, যা দারিদ্র্যবিমোচনের পথেও বাধা সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায়, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরও শক্তিশালী করা এবং এর দ্রুত বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, এফসিটিসি’র বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন বন্ধ করা, খুচরা শলাকা ও খোলা তামাকপণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা, ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস নিয়ন্ত্রণ এবং তামাকপণ্যের প্যাকেটে বড় সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা প্রচলন করা এখন সময়ের দাবি। তাই, আর বিলম্ব না করে অবিলম্বে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে তা কার্যকর করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হোক।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট, পাবলিক হেল্থ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।