নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
২০২৪ বিশ্বজুড়ে নির্বাচনের বছর
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বুধবারনতুন বছরেই নির্বাচন হচ্ছে পাকিস্তানে। দেশটিতে জেলবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই প্রধান ইমরান খান। এখন পর্যন্ত যে আলোচনা বা পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে ইমরান খান নির্বাচনে অযোগ্য। তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। তবু তার পক্ষে মনোনয়নপত্র কিনে তা জমা দেয়া হয়েছে। ওদিকে নির্বাচন কমিশন তার দল পিটিআইয়ের প্রতীক কেড়ে নিয়েছে। দলের ভেতরে নির্বাচন না করার কারণে নির্বাচনে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে তার দলকে। ফলে দলীয় প্রধান হিসেবে ইমরান খান ব্যারিস্টার আলি খানকে চেয়ারম্যান হিসেবে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাও কার্যকর নেই ফলে ইমরান খানকে জেলে রেখেই পাকিস্তানে নির্বাচন হতে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। এমন অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) বর্ষীয়ান সিনেটর রাজা রাব্বানি। তিনি বলেছেন, এমন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ইমরান খানকে জেলে রেখে, অন্যদিকে সাত বছরের জেলের সাজা পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে বেকসুর খালাস দিয়ে নির্বাচনে আনার চেষ্টা চলছে। এসবই বিচারের দ্বিমুখী নীতি।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে জাতীয় নির্বাচন বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগামী বছর। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, বৃটেন, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান সহ কমপক্ষে ৫৮টি দেশ। ফলে বিশ্বজুড়ে নতুন বছর ২০২৪কে নির্বাচনের বছর বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। এরই মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিন্ন মাত্রায় এক উত্তেজনা বিরাজ করছে। সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে তার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর মার্কা বিতরণ করা হয়েছে। চলছে প্রচারণা। অন্যদিকে বিএনপি’র নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো ভোটের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এরই মধ্যে নির্বাচনের দিন ভোট না দিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে নানা কর্মসূচি পালন করছে। বাংলাদেশের এই নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি রেখেছে বিশ্ববাসী। ২০২৪ সালে যে ৫৮টি দেশে নির্বাচন হবে, তার মধ্যে খুব সম্ভবত বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যতিক্রমধর্মী। এর কারণ, এখানকার নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করার দাবি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বগুলোর পক্ষ থেকে। বার বার এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সতর্কতা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে। সেখানে এই নির্বাচন নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সর্বশেষ ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘ সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা নির্বাচন দেখেশুনে, নির্বাচনের পরে বাংলাদেশ ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া জানাবে। এই নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র যখন অবাধ ও সুষ্ঠু করার দাবি জানাচ্ছে, তখন একে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দাবি করে রাশিয়া ও চীন কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। ভারতও দীর্ঘদিন পর তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অদ্ভুতভাবে বর্তমান সরকারের পক্ষে থাকার জন্য ভারত ও চীন পরস্পরের ঘোরতর বিরোধী হলেও এক অবস্থানে। বাংলাদেশের এই নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে সম্প্রতি যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে তা হতাশার জন্ম দিচ্ছে। কারণ, তারা মনে করছেন নির্বাচন হলেও বা নির্বাচনে কারচুপি হলে, সহিংসতা হলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বোদ্ধারাও বিভিন্ন টকশো, সেমিনার, ওয়েবিনারে একই সতর্কতা দিয়ে যাচ্ছেন। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে থামবে- তা বলে দেবে ভবিষ্যৎ।
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে নাটকীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডেমোক্রেট দল থেকে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। দৃশ্যত এখন পর্যন্ত তার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান দল থেকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এর আগের কোনো এক লেখায় বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো সেখানকার নির্বাচনী ব্যবস্থা। কেউ কোনো দলের প্রধান বা বড় নেতা হলেই তিনি দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। তাকে কঠিন প্রাইমারি নির্বাচনের মাধ্যমে অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে লড়াই করে বিজয়ী হতে হয়। নিজ দলের মধ্যে এই প্রাইমারি নির্বাচন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগে থেকে এ জন্য প্রার্থীদের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে হয়। এবার রিপাবলিকান দল থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় আছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, রন ডি’স্যান্তোস, নিকি হ্যালি, বিবেক রামাস্বামী প্রমুখ। এর মধ্যে ফ্রন্টরানার ট্রাম্প। কিন্তু তিনি আইনি জটিলতায় পড়েছেন। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনি অর্থের বিনিময়ে সাবেক পর্নো তারকা ড্যানিয়েল স্টর্মির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা প্রকাশ না করতে মুখ বন্ধ করিয়েছিলেন। ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল পাল্টে নিজের অনুকূলে নেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি তার উস্কানিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দাঙ্গা চালায় তার অনুসারীরা। তাতে কমপক্ষে ৫ জন নিহত হন। এ ছাড়া নির্বাচনের পর তিনি হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাওয়ার আগে স্পর্শকাতর গোপনীয় ডকুমেন্ট নিয়ে যান মার-এ-লাগো অবকাশযাপন কেন্দ্রের বাসায়। সেখান থেকে এফবিআই ওইসব ডকুমেন্ট উদ্ধার করেছে। এসব বিষয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান। এরই মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়াতে তাকে ওই রাজ্যের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে আদালত। বাকি মামলাগুলোতে ট্রাম্পের নিয়তি কোনদিকে যায় তা বলা কঠিন। অন্যদিকে ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনসমর্থনও কমে গেছে। বিশেষ করে গাজা হামলায় ইসরাইলকে ঢালাও সমর্থন দেয়ার কারণে তিনি সমালোচিত হচ্ছেন।
নতুন বছরেই নির্বাচন হচ্ছে পাকিস্তানে। দেশটিতে জেলবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই প্রধান ইমরান খান। এখন পর্যন্ত যে আলোচনা বা পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে ইমরান খান নির্বাচনে অযোগ্য। তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। তবু তার পক্ষে মনোনয়নপত্র কিনে তা জমা দেয়া হয়েছে। ওদিকে নির্বাচন কমিশন তার দল পিটিআইয়ের প্রতীক কেড়ে নিয়েছে। দলের ভেতরে নির্বাচন না করার কারণে নির্বাচনে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে তার দলকে। ফলে দলীয় প্রধান হিসেবে ইমরান খান ব্যারিস্টার আলি খানকে চেয়ারম্যান হিসেবে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাও কার্যকর নেই। ফলে ইমরান খানকে জেলে রেখেই পাকিস্তানে নির্বাচন হতে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। এমন অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) বর্ষীয়ান সিনেটর রাজা রাব্বানি। তিনি বলেছেন, এমন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ইমরান খানকে জেলে রেখে, অন্যদিকে সাত বছরের জেলের সাজা পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে বেকসুর খালাস দিয়ে নির্বাচনে আনার চেষ্টা চলছে। এসবই বিচারের দ্বিমুখী নীতি। এর ফলে পাকিস্তানে যে নির্বাচন হবে তাতে স্থিতিশীলতা বা শান্তি কতোটা টেকসই হবে তা বলা মুশকিল।
ভারতে নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার জন্য একজোট হয়েছে বিরোধী দলগুলো। এ জন্য তারা সবাই মিলে বিরোধী দলগুলোর জোটের সংক্ষিপ্ত নাম দিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’। ফলে সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সহ যেসব সামিট হয়েছে তাতে সরকার ভারতকে ইন্ডিয়া হিসেবে না লিখে লিখেছে ‘ভারত’। এর মধ্যদিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। কিন্তু বিরোধী দলগুলো যদি এক জোট হয়ে নির্বাচন করে, তাহলে তিনি কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে পারেন।
রাজনীতির আরেক উত্তেজনাপূর্ণ দেশ শ্রীলঙ্কা। দেশটি ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল। জনতার রোষে পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে। জনরোষে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে তাণ্ডব চালায় জনতা। কোনো শৃঙ্খলা ছিল না সেখানে। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন রনিল বিক্রমাসিংহে। তাদেরকে অর্থনৈতিক সহায়তায় এগিয়ে যায় বাংলাদেশসহ অনেক দেশ। তারা সেই দেউলিয়াত্ব ঘুচিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যে নতুন ইতিহাস লিখাচ্ছে। সেখানেও ২০২৪ সালে নির্বাচন। এতে রাজাপাকসে পরিবার অংশ নেবে কিনা তা নিশ্চিত নয়।
২০২৪ সালে বিশ্বের যেসব দেশে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তার মধ্যে এশিয়ার দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ (৭ই জানুয়ারি), ভুটান (৯ই জানুয়ারি), কম্বোডিয়ায় সিনেট নির্বাচন (২৫শে ফেব্রুয়ারি), ভারতে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন, ইন্দোনেশিয়া (১৪ই ফেব্রুয়ারি), ইরান, মঙ্গোলিয়া (জুনে), দক্ষিণ কোরিয়া (১০ই এপ্রিল), শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান (৮ই ফেব্রুয়ারি), তাইওয়ান (১৩ই জানুয়ারি)। যুক্তরাষ্ট্র অঞ্চলে ব্রাজিল (৬ই অক্টোবর প্রথম রাউন্ড, ২৭শে অক্টোবর প্রয়োজন হলে দ্বিতীয় রাউন্ড), কানাডা, এল সালভাদর (৪ঠা ফেব্রুয়ারি ও ৩রা মার্চ), ডমিনিক প্রজাতন্ত্র (১৯শে মে), মেক্সিকো (২রা জুন), পানামা (৫ই মে), যুক্তরাষ্ট্র (৫ই নভেম্বর), উরুগুয়ে (২৭শে অক্টোবর), ভেনিজুয়েলা। আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো হলো- আলজেরিয়া (ডিসেম্বরে), বোতসোয়ানা, চাদ, কমোরোস (১৪ই জানুয়ারি), ঘানা (৭ই ডিসেম্বর), মৌরিতানিয়া, মৌরিতাস, মোজাম্বিক (৯ই অক্টোবর), নামিবিয়া, রোয়ান্ডা (১৫ই জুলাই), সেনেগাল (২৫শে ফেব্রুয়ারি), সোমালিল্যান্ড (নভেম্বর) দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ সুদান, তিউনিশিয়া ও টোগো। ইউরোপের দেশগুলো হলো- অস্ট্রিয়া, আজারবাইজান (৭ই ফেব্রুয়ারি), বেলারুশ (২৫শে ফেব্রুয়ারি), বেলজিয়াম (৯ই জুন), বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা (৬ই অক্টোবর), ক্রোয়েশিয়া (ডিসেম্বর), ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্ট (৬-৯ই জুন), ফিনল্যান্ড (২৮শে জানুয়ারি), জার্মানি (১লা সেপ্টেম্বর), জর্জিয়া (২৬শে অক্টোবর), আইসল্যান্ড (১লা জুন), আয়ারল্যান্ড (জুন), লিথুয়ানিয়া (১২ই মে), মলদোভা, নর্থ মেসিডোনিয়া, পর্তুগাল (১০ই মার্চ), পোল্যান্ড, রোমানিয়া (নভেম্বর), রাশিয়া (১৭ই মার্চ), স্লোভাকিয়া, স্পেন (১৮ই ফেব্রুয়ারি), তুরস্ক (মার্চ), বৃটেন (মে)।