শেষের পাতা
ভূমিকম্পে মৃত্যুপুরী আফগানিস্তান, নিহত হাজার
মানবজমিন ডেস্ক
২৩ জুন ২০২২, বৃহস্পতিবারমৃত্যুপুরী আফগানিস্তান। ভূমিকম্পের পর বেরিয়ে আসছে লাশের পর লাশ। প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার গ্রামগুলো মাটির নিচে ঢাকা পড়েছে। সেখান থেকে আসছে মৃত্যুর খবর। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে লাশের সংখ্যা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কমপক্ষে ১০০০ জনের লাশ উদ্ধার
হয়েছে। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে সব। অভাবতাড়িত মানুষগুলোর মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তাদের সামনে শুধুই শূন্যতা। কিচ্ছু নেই তাদের। বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন নেই। তার ওপর স্বজন হারিয়ে নির্বাক তারা। বুকফাটা আর্তনাদ শূন্য আকাশে যেন প্রতিধ্বনি তুলে ফেরত আসছে। এ এক ভয়াবহ অবস্থা আফগানিস্তানের। এ দৃশ্য বর্ণনা করে শেষ করার মতো নয়। অনলাইন জিও টিভি, আল জাজিরা বলছে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে শক্তিশালী ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে দেশটিতে। এতে মুহূর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সব। তালেবান সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল পাকটিকা এবং খোস্ত প্রদেশে পৌঁছার চেষ্টা করছেন। সেখানকার মানুষের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। ফলে নিহত বা আহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক উপমন্ত্রী মৌলভী শরাফুদ্দিন মুসলিম বলেছেন, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১০০০ জনের নিহত হওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছি।
ওদিকে প্রাথমিক খবরে যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে বলেছিল ভূমিকম্পের মাত্রা ৬.১। কিন্তু পরে তারা তা সংশোধন করে বলেছেÑ এর মাত্রা ৫.৯। পাকিস্তান সীমান্তের কাছে খোস্ত শহর থেকে প্রায় ৪৬ কিলোমিটার দূরে ছিল ভূমিকম্পের উৎস। পাকতিয়া প্রদেশের উপজাতি নেতা ইয়াকুব মানজুর বলেছেন, যারা জীবিত আছেন তাদের পাঠানো হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য। স্থানীয় সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। সবাই ছুটে গেছেন আক্রান্ত এলাকাগুলোতে। পাকিস্তান সীমান্তের কাছে পাকতিয়া প্রদেশ থেকে যেসব ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ভিকটিমদেরকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আকাশপথে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। অনলাইনে যেসব ছবি ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে- এই প্রদেশের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে মানুষজন ছোটাছুটি করছেন।
আফগানিস্তানের সাংবাদিক আলি এম লতিফ কাবুল থেকে বলেছেন, রাজধানী কাবুল থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে থাকা মানুষও এই ভূমিকম্প অনুভব করেছেন। কর্তৃপক্ষ বলছেÑ ওই প্রদেশ ও অঞ্চলে শত শত বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আক্রান্ত এলাকাগুলোতে হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দাতা সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মানুষকে উদ্ধারে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই এলাকাটি প্রত্যন্ত এবং সেখানে পৌঁছা খুব কঠিন। আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটি বলেছেÑ তারা স্থানীয় একটি মেডিকেল টিম পাঠিয়েছে সেখানে। তারা দুর্গত মানুষকে উদ্ধার ও চিকিৎসা দিচ্ছেন। আফগান এই সাংবাদিক বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দুর্গত স্থানে পৌঁছা। কারণ, প্রাদেশিক রাজধানী থেকে এসব প্রত্যন্ত এলাকা অনেক দূরে। রাস্তার অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। ফলে বাস্তব বিষয় হলো, ওইসব স্থানে পৌঁছতে তাদের কতোটা সময় লাগবে তা নিয়ে।
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক লেখক হেদায়েতুল্লাহ পাকতিন বলেছেন, ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ বাড়ি প্রচলিত স্টাইলে তৈরি। এতে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, পাথর এবং অন্যান্য সরঞ্জাম। সেখানে কংক্রিটের বাড়ির খোঁজ মেলা ভার। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এই ভূমিকম্প এমন এক সময়ে আঘাত হেনেছে যখন অর্থনৈতিক সংকটে মারাত্মকভাবে ধুঁকছে আফগানিস্তান। ওষুধ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে।
পাকিস্তান, ইরান থেকেও অনুভূত: ভূমিকম্পের মাত্রা ৫.৯ হলেও কম্পনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, তা প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ইরান থেকে টের পাওয়া গেছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এতে পাকিস্তানে একজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে ইরানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। পাকিস্তান আবহাওয়া বিভাগ বলেছে, পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কিছু অংশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। পাকিস্তানের কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় দেখা গেছে, আফগান সীমান্তের কাছে বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। তবে এসব যে ভূমিকম্পের কারণে হয়েছে, এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক পরিষ্কার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একথা বলেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মুখপাত্র তৈমুর খান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শোক জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। বলেছেন, আফগানিস্তানের জনগণকে সাহায্য করবে পাকিস্তান।
এমনিতেই হতাশায় আফগানিস্তান: গত বছর ১৫ই আগস্ট ক্ষমতা কেড়ে নেয় তালেবানরা। তারপর থেকে দেশটিতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট লেগেই আছে। তালেবানের ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার জবাবে বহু সরকার আফগানিস্তানের ব্যাংকিং খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। উন্নয়ন সহায়তা বাবদ তারা যে শত শত কোটি ডলার পেতো তাও বন্ধ হয়ে যায়। তার ওপর এত বড় আঘাত কীভাবে সইবে আফগানিস্তান তা সময়ই বলে দেবে। ভিকটিমদের কাছে কীভাবে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো যায় তার সমন্বয় করতে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রমিজ আল আকবারভ হতাহতদের উদ্দেশ্যে শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে বিপর্যয়ের বিষয়ে সাড়া দিচ্ছে জাতিসংঘ।
পাহাড়ি আফগানিস্তান এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালা সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল অংশ দীর্ঘদিন যাবৎ ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে। এখানে ইউরেশিয়ান প্লেটের সঙ্গে ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ হয়। ২০১৫ সালে বড় রকমের এক ভূমিকম্প আঘাত হানে আফগানিস্তান ও প্রতিবেশী পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে। এতে কমপক্ষে ২০০ মানুষ মারা যান। একই রকম ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্পে ২০০২ সালে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে মারা যায় প্রায় এক হাজার মানুষ। ১৯৯৮ সালে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্প এবং তার পরবর্তী কম্পনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রত্যন্ত এলাকায় মারা যান কমপক্ষে ৪৫০০ মানুষ।