নির্বাচিত কলাম
চলতি পথে
আচমকা বন্যা: কী শিক্ষা দিলো
শুভ কিবরিয়া
২৩ জুন ২০২২, বৃহস্পতিবারসিলেট-সুনামগঞ্জসহ হাওর এলাকার এবারের বন্যা ছিল খুবই আচমকা। মানুষের প্রস্তুতি নেয়ার আগেই প্রবল পানির তোড়ে সবকিছু ভেসে যায়। এবারের বন্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে বাস্তবিক তেমন কোনো আগাম পূর্বাভাস জনগণ জানতে পারে নাই। পানি যে এরকম প্রবলতর হয়ে শহর অঞ্চলকেও ডুবিয়ে দেবে সেটা ভাবা যায় নাই। বন্যার প্রথম ধাক্কায় মানুষের ঘরবাড়ি আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কেননা, বিদ্যুতের অধিকাংশ বিতরণ সাব-স্টেশনে পানি ঢুকে পড়ে। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকায় দ্রুত মোবাইল ফোনের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। ফোনের চার্জ না থাকায় পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এটা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ট্রমা ও প্যানিক তৈরি করে।
এখন ত্রাণকাজ শুরু হয়েছে। সরকারিভাবে তো বটেই জনমানুষের পক্ষে নানা সংগঠনের পক্ষেও ত্রাণকাজ চলছে এবং চলবে। ত্রাণকাজ পরিচালনা করাও একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দাবি রাখে। মানুষের কখন কি দরকার, আর কি আমরা দেব- এ দুয়ের মধ্যে অনেক সময় ফারাক থাকে। দূর থেকে যারা ত্রাণ বিতরণ করতে যান তাদের অনেকেই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেন না, কোন জায়গায় ত্রাণকাজ চালালে, কাদের হাতে ত্রাণসামগ্রী পড়লে সত্যিই দুর্গত মানুষ অধিকতর উপকৃত হবে। বহুবছর আগে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর মোংলা, পটুয়াখালী এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে দেখেছি, যাকেই মাধ্যম ধরেছি, সেই কোনো না কোনোভাবে ত্রাণ বিতরণ কাজে সহায়তা করে তার রাজনৈতিক লাভ ঘটিয়েছেন। এই দুই অঞ্চলে প্রত্যন্ত এলাকায় যাদের মাধ্যমে নগদ টাকা আমরা বিতরণ করেছিলাম, তারাই পরে স্থানীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন।
দুজনই দুটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সমর্থক বলে আমরা জানতাম। এখন বুঝি, যাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছেছিল, তাদের অনেকেরই হয়তো ত্রাণের নগদ টাকা না পেলে খুব একটা ক্ষতি হতো না। আবার যাদের প্রয়োজন ছিল, তারাও যে দলনিরপেক্ষ মানুষ ছিলেন এখন আর সেটা নিশ্চিত নই। বুঝতে পারি যারা ত্রাণকাজে আমাদের সাহায্য করেছিলেন আন্তরিকভাবে তারা তাদের দলীয় সমর্থক ছাড়া অন্যদের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী হন নাই। আবার এটাও ঠিক দুর্গত প্রত্যন্ত এলাকায়, স্থানীয় জনসম্পৃক্ততা আছে, এরকম কারও সহায়তা ছাড়া ত্রাণসামগ্রী বিতরণ বিশেষ করে নগদ টাকা বিতরণ করে নিরাপদে ফিরে আসাও সহজ কাজ নয়। ফলে বাইরে থেকে যারা আবেগের বশে, মানুষের কষ্টে পীড়িত হয়ে ত্রাণকাজ করতে যান, তাদের কিছু সিস্টেম লস মেনে নিয়েই এ কাজটি করতে হবে। এবার হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ বিতরণের সময় একজনের মৃত্যুর সংবাদ মিডিয়ায় এসেছে। ত্রাণ বিতরণের সময় হুড়োহুড়ি-পাড়াপাড়ি করে মানুষের জীবনহানি ঘটাও অস্বাভাবিক কিছু না। ফলে, ত্রাণ বিতরণে খুব সতর্ক ও বাস্তবভিত্তিক উপায় বের করা দরকার।
মুরাদনগর উপজেলার নয়াকান্দি গ্রাম থেকে ছবিটি তুলেছেন আমাদের প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ
ত্রাণকাজে স্থানীয় প্রশাসন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা ছাড়া উপায় নেই। কেননা, তারাই বলতে পারেন, কোন গ্রামে কোন মানুষের কী প্রয়োজন। যদিও এখানে, ত্রাণ রাজনীতিকীকরণের একটা প্রবল আশংকা আছে। ফলে, এটাকেও মাথায় রাখতে হবে। ত্রাণের সময় খাবার-ওষুধ বা এ জাতীয় যে জিনিসই থাকুক না কেন, সঙ্গে নগদ টাকা খুব কাজে লাগে। আমরা হয়তো ত্রাণ হিসেবে দিলাম তেল ও লবণ, তখন তাদের হয়তো দরকার রান্নার জন্য জ্বালানি, সেটা ক্রয়ের জন্য দরকার নগদ টাকা। যদিও এটা মোটামুটি নিশ্চিত, বছরের পর বছর ধরে রাজনীতির দুষ্ট প্রভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছি যে, সরকার যত চেষ্টা করুক না কেন, শতভাগ সততার সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষত উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ কাজ করতে পারবে না। তার সিস্টেমটাই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, অক্ষমতায় ভরা। কাজেই যে সহায়তাই মানুষকে দিতে চান না কেন, এই মেশিনারির সিস্টেম লস তার কিছু না কিছু খেয়ে ফেলবেই।
সেটা সহ্য করেই, মেনে নিয়েই এগুতে হবে। আপাতত এর বিকল্প নেই। সান্ত্বনা এই যে, নানা সময়ে প্রান্তিক মানুষকে দেয়া সহায়তার যে সিস্টেম লস ঘটে, সেই দুর্নীতির অর্থ যদি স্থানীয়ভাবে খরচ হয় তবে তা গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটা সাময়িক প্রভাব রাখে। চেইন সিস্টেমে সেটা কাজ করে। এই দুঃসময়ে যেকোনো মূল্যেই বন্যাপীড়িত এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখাটাও খুব জরুরি। বন্যার পানি এখন নেমে গেলে, স্থানীয় বাজার থেকে ত্রাণসামগ্রী কিংবা সহায়তাসামগ্রী ক্রয় করলে সেটাও বিপদাপন্ন গ্রামীণ অর্থনীতিতে টাকার যোগান দেবে, তাকে চালু রাখবে। এসব বিবেচনা কাজে লাগিয়ে এবারের বন্যাকালীন, বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন কাজে মনোযোগী হতে হবে। যারা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জিজাইন করেন, তারা এসময় মিডিয়ার হাল নাগাদ খবরে চোখ রাখতে পারেন। নতুন নতুন সংকটের খবর হয়তো তাতে মিলবে, যেটা কর্তৃপক্ষ সমাধান করার উদ্যোগ নিতে পারেন। এখন প্রশ্ন হলো- আচানক এরকম বন্যা হলো কেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন অতিবৃষ্টি, পাহাড়ের পানি, ভারত থেকে আসা নদ-নদীর পানি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের নদী-খাল-বিলের দখল। আমাদের নদী-খাল-বিলের নাব্য কমে গেছে। দখল-দূষণে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে, স্বাভাবিক বৃষ্টির চাইতে অধিক বৃষ্টি হলে অথবা উজান থেকে পানি নেমে এলে, তা ধরে রাখার আধার নাই। ফলে পানি তখন নদ-নদী-খাল-বিল ছেড়ে ঢুকে যাচ্ছে লোকালয়ে, বসতঘরে। এর সমাধান কি? সেটা ভাবতে হবে। বছরের পর বছর যত্রতত্র অবকাঠামো উন্নয়নের যে পাগলা হাওয়া ছুটে চলেছে, তাতে আক্রান্ত হয়েছে হাওর-বাঁওড়। হাওরের মধ্যে রাস্তা বানিয়ে আমরা জলাধারের স্বাভাবিক প্রবাহে কৃত্রিম বাধা সৃষ্টি করছি।
এটার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে। নদীর উপর বড় বড় সেতু তৈরি হচ্ছে। তার জন্য যে নদীশাসন করতে হচ্ছে, কৃত্রিমভাবে, তারও একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনমানুষের দখলদারি। নদীর মধ্যে আবাসন, স্থাপনা এখন শুধু আমজনতাই করে না, খোদ সরকারি সংগঠনের বহু স্থাপনা নদী-খাল ভরাট করে করা হচ্ছে। ফলে উজানের পানি বেড়ে গেলে তা প্রবাহের আর জায়গা থাকছে না। কাজেই উন্নয়নের নামে অবকাঠামো নির্মাণের আগে আশু ফায়দার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের ফায়দা চিন্তায় রাখা দরকার। প্রকৃতির আধার নদী, হাওর, খাল-বিল-জলাধার যেখানেই আমরা অবকাঠামো নির্মাণ করি না কেন, তা যেন ভবিষ্যতে মানুষের দুর্ভোগের কারণ না হয়, সেই বিবেচনা এখন খুব জরুরি। যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়নকে এখন দুঃখের কারণ বলে ভাবা হচ্ছে সেগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। কেননা, এরকম প্রাকৃতিক দুর্ভোগ যে নিকট ভবিষ্যতে আবার আসবে না, তা বলা যায় না। ভারতের সঙ্গে উজানে থাকা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে, নদীর নাব্য নিয়ে কথা বলা দরকার। চীন, ভারত, নেপালের সঙ্গে এর একটা আন্তঃদেশীয় সমাধানের পথ খোঁজা দরকার।
বিষয়টি খুব জরুরি। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থকে বলি দিয়ে হলেও সাহসের সঙ্গে এই পথে পা বাড়ানো দরকার। এ বন্যার আগে পূর্বাভাস দেয়ার যেসব ব্যবস্থা ছিল, ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে তারা আগাম কোনো সতর্ক বার্তা মানুষের কানে জোরালোভাবে পৌঁছাতে পারে নাই। এ দুর্বলতা ক্ষমার অযোগ্য। আমাদের প্রযুক্তি আছে, দক্ষ জনবল আছে, অতীত অভিজ্ঞতাও আছে-কিন্তু এবার তা কাজে লাগে নাই। কোথাও একটা ঘাটতি থেকেছে। সেটা মেরামত করা দরকার। এ বিষয়ে ভবিষ্যতের জন্য জোর প্রস্তুতি দরকার। এবার বন্যায় বিদ্যুৎ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবার আগে। ফলে, বিদ্যুৎ সরবরাহই বন্ধ রাখতে হয়েছে। এ ঘটনাও বিপজ্জনক। আমাদের গ্রামীণ বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণের যে প্রচলিত ধারা তাতে অনেক রাজনীতিকীকরণ হয়েছে, অনেক অকারিগরি কারণের সমাবেশ ঘটেছে। গ্রামীণ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নির্মাণের পুরো বিন্যাস নিয়ে নতুন করে ভাবার দরকার আছে। বিশেষ করে বিতরণ সাব-স্টেশনগুলো আরও উঁচু জমিতে, আরও কারিগরি কৌশলগত জায়গায় তৈরি করা দরকার।
বিতরণ লাইনগুলো আরও মানসম্মত আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা মাথায় রেখে তৈরি করা দরকার। বন্যার পানি এলে যাতে বিকল্প ব্যবস্থায় ন্যূনতম বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে সেরকম নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সোলার বিদ্যুতের একটা বিকল্প পথ বের করা দরকার। যাতে গ্রিড বিদ্যুৎ না থাকলেও অফ-গ্রিড বিদ্যুতের মাধ্যমে মোবাইল ফোন কমিউনিকেশন চালু রাখা যেতে পারে। এবারের বন্যার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে, সড়ক কম্যুনিকেশন ব্যাহত হলে বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দরকার। যাদের প্রয়োজন হবে তাদের চলাচলের জন্য নৌকার ব্যবস্থা রাখতে হবে। স্থানীয়ভাবে নির্মিত, রক্ষিত, ব্যবহৃত নৌকাগুলো প্রয়োজনের সময় কীভাবে ব্যবহার করা যায় স্থানীয় প্রশাসন তার উদ্যোগ নিতে পারে। এখন নানারকম প্লাস্টিকের পানিযান পাওয়া যায়, যেগুলোতে বাতাস ভরে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচলের উপযোগী করা সম্ভব।
বন্যার সময় কাজে লাগাবার জন্য আগাম এগুলো সংগ্রহ করার একটা প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন করা যায়। প্রশাসনের সমন্বয়ে এনজিও, সামাজিক সংগঠনকে এ কাজে লাগানো যেতে পারে। সিলেট-সুনামগঞ্জকে প্লাবিত করা এ হঠাৎ বন্যা, আমাদের জন্য একটা বড় শিক্ষা। আমাদের বহু অক্ষমতাকে দেখিয়ে দিলো এ বন্যা। এ থেকে যদি আমরা সবাই শিক্ষা নেই, প্রস্তুতি নেই, তাহলে ভবিষ্যতে আরও শক্তভাবে এরকম বিপদকালীন সময় মোকাবিলা করা যাবে। মনে রাখতে হবে, এ বন্যাই শেষ বন্যা নয়। প্রকৃতিকে আমরা যেভাবে শত্রু বানিয়েছি আমাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে, প্রকৃতি বহুভাবেই হয়তো তার শোধ নেবেই। কাজেই সাবধান হওয়ার এটাই সময়। প্রস্তুতি নেয়ারও এটাই সময়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, [email protected]