নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
গাজায় ইসরাইলি বর্বরতার শেষ হবে কবে?
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
৪ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার
এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা বড়। এসব মাধ্যমে কি প্রচার হবে কি হবে না, জনগণের মত কি হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ইসরাইল। মূলধারার সংবাদ মাধ্যম যখন এ কাজটি করতে পারছে না তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রকাশ করে দিচ্ছে ফিলিস্তিনে চালানো ইসরাইলের নৃশংসতা, ফিলিস্তিনি জনগণের বিভীষিকাময় দিনকাল, পিতামাতা হারা শিশুর আকাশ-বাতাস ফাটানো আর্তনাদের কথা। সেসব দৃশ্য দেখতে দেখতে মনের অজান্তেই হয়তো আপনার চোখ থেকে টপ করে ঝরে পড়ছে একফোঁটা অশ্রু। এই অশ্রু ফোঁটাই লিখে দিচ্ছে ফিলিস্তিনবাসীর, গাজাবাসীর বিজয়গাঁথা
এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ। কোনো কিছুই গোপন থাকছে না। মুহূর্তের মধ্যে যেকোনো তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। কেউ কেউ নিজের ইচ্ছায় ঘরের খবর পরের কাছে তুলে দিচ্ছেন। ইচ্ছে করেই ঘরের স্ত্রীকে নিয়ে হাসি তামাশার টিকটক বানাচ্ছে। এর ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুকে রিল নামে একটি অপশন চালু হয়েছে। এটাকে টিকটকের বিকল্প হিসেবে দেখা হয়। এমনতরো আরও অগণিত মাধ্যম আছে। তার মাধ্যমে যুবক-যুবতীর অশালীন দেহভঙ্গির প্রকাশ ঘটছে। কোথাও কোথাও গোপন দৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছে। সভ্য মানুষের এই সমাজে সভ্যতার নামে কিছু যুবক-যুবতী স্বল্প বসনে তার যে বিষয়টি সবচেয়ে দামি, তাকে সস্তা করে দিচ্ছে কোটি কোটি মানুষের সামনে। এতে দিকভ্রান্ত হচ্ছে কোমলমতি শিশু-কিশোর। ফলে সামাজিক ব্যাধি বাড়ছে। তো যা নিয়ে আজকে এই লেখা শুরু করেছি, মূল উদ্দেশ্য তা নয়। আজও নির্যাতিত মুসলিম, অসহায় গাজাবাসীর কথা তুলে ধরবো। অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি শেষ। আবার গাজার নিরস্ত্র সাধারণ নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে হামলা করছে ইসরাইল। তাদের সাদা ফসফরাস বোমার ধোঁয়া এখনো গাজার বাতাসে। তার ওপর আকাশ থেকে বোমা ফেলছে। আবার লাশের মিছিল দেখে প্রহ্লাদ গুনছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
পশ্চিমা মিডিয়া একপেশে রিপোর্ট প্রকাশ করছে। তারাও নেতানিয়াহুর সুরে সুর মিলিয়ে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অভিহিত করছে। যতবার হামাস শব্দটি আসছে, ততবার তারা একে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে অভিহিত করছে। আসলেই কী হামাস সন্ত্রাসী সংগঠন! নিজের দেশের স্বাধীনতা দাবি করা কী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড? নিজেদের ভূমি ভিন দেশকে দখল করে নিতে বাধা দেয়া কি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড? নির্যাতিত হতে হতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন জীবন বাঁচাতে বেঁকে বসা কি সন্ত্রাস! তবে হ্যাঁ, ৭ই অক্টোবর হামাস আকস্মিক যে রকেট হামলা করেছে তাকে সমর্থন করা যায় না। আবার এই রকেট হামলার অজুহাতে একটি দেশের নিরীহ ‘১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করে ফেলার বিরুদ্ধে বিশ্বের বড় বড় নেতারা কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, রকেট হামলার অজুহাতে নিরীহ মানুষ হত্যাকে বৈধতা দেয়া যায় না। এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুঁতেরা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেডরোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস সহ অনেক নেতা। বিশ্বের মধ্যে শিশুদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান এখন গাজা। এ কথা আমার নয়। এ কথা বলেছেন ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেল।
তিনি সতর্কতা দিয়ে বলেছেন, যদি নতুন করে এই যুদ্ধ সহিংস পর্যায়ে যায় তাহলে শত শত শিশু প্রতিদিন মারা যাবে। পশ্চিমা বিশ্ব সেই খবরটুকুই দিচ্ছে যেটুকুতে ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা হয়। এই যুদ্ধে ইসরাইল হয়তো আক্ষরিক অর্থে বিজয়ী হতে পারে। কিন্তু সাধারণ জনগণের বিচারে ইসরাইল এরই মধ্যে হেরে গেছে। আপনি যদি ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন, এক্স ব্যবহার করে থাকেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে এরই মধ্যে ফিলিস্তিনি উপায়হীন শিশুদের কান্না আপনার কানে পৌঁছে গেছে। আপনি হয়তো ধ্বংসস্তূপের নিচে একফোঁটা পানি চেয়ে আর্তনাদ করা কোনো শিশুর বা মায়ের বা কোনো পিতার কান্নার আওয়াজ শুনেছেন। ইথারে হয়তো আপনার অন্তর্কানে ভেসে এসেছে সেই কান্না। মিডিয়ার এই যুগে এসব কান্নাকে ঢেকে রাখার কোনো উপায় নেই। গাজা উপত্যকা থেকে যেসব দৃশ্য, খবর প্রচার হয়েছে, হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি খবর, বাস্তব চিত্র ওই ইনস্টাগ্রাম রিল, টিকটক ভিডিও অথবা ইউটিউব শর্টসে। বৈষম্যমূলকভাবে ফিলিস্তিনের ওপর কি এক ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল তার চিত্র বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে ভেসে উঠছে।

যারই ইন্টারনেট সংযোগ আছে, তিনিই দেখতে পেয়েছেন গাজার, দখলীকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব তীর, জেনিন শরণার্থী ক্যাম্প, জাবালিয়া শরণার্থী ক্যাম্পে বোমা হামলায় ক্ষতবিক্ষত শিশুর ভিডিও। শত শত টন কংক্রিটের স্তূপের নিচ থেকে টেনে বের করা হচ্ছে নারীকে। কোনো মা তার মৃত সন্তানের দেহ বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন পাগলের মতো। অন্যদিকে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং কয়েক দশকের দখলদারিত্ব নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তারা গাজাকে বাফার জোন বানানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। বলেছে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা নিয়ন্ত্রণ করবে গাজা। এর অন্য অর্থ হলো গাজাকে তারা এরই মধ্যে প্রায় পুরোটা দখল করে ফেলেছে। হামাস যুদ্ধ করলেও ইসরাইলের অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে তারা আসলে যুদ্ধ বলতে যা বোঝায় তা পেরে উঠছে না। সর্বশেষ এই যুদ্ধে এরই মধ্যে কমপক্ষে ৫৩ জন সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীকে হত্যা করেছে ইসরাইল। তাদের পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করা হয়েছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস এসব তথ্য দিয়েছে। আল জাজিরার আরবি বিভাগের গাজা প্রতিনিধি ওয়ায়েল দাহদু হারিয়েছেন তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে এবং নাতিকে। সরাসরি খবর দেয়ার সময় তিনি এ খবর পান। গাজায় প্রবেশ করতে কোনো বিদেশি সাংবাদিককে অনুমোদন দিচ্ছে না ইসরাইল।
সম্প্রতি সিএনএনের ফরিদ জাকারিয়া স্বীকার করেছেন ইসরাইলি সেনারা এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ওইসব বিদেশি সাংবাদিককে প্রবেশ করতে দিচ্ছে, যারা তাদের সব ম্যাটেরিয়াল এবং ফুটেজ ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কাছে জমা দেবে। অর্থাৎ ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিয়ে কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা বড়। এসব মাধ্যমে কি প্রচার হবে কি হবে না, জনগণের মত কি হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ইসরাইল। মূলধারার সংবাদ মাধ্যম যখন এ কাজটি করতে পারছে না তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রকাশ করে দিচ্ছে ফিলিস্তিনে চালানো ইসরাইলের নৃশংসতা, ফিলিস্তিনি জনগণের বিভীষিকাময় দিনকাল, পিতামাতা হারা শিশুর আকাশ-বাতাস ফাটানো আর্তনাদের কথা। সেসব দৃশ্য দেখতে দেখতে মনের অজান্তেই হয়তো আপনার চোখ থেকে টপ করে ঝরে পড়ছে একফোঁটা অশ্রু। এই অশ্রু ফোঁটাই লিখে দিচ্ছে ফিলিস্তিনবাসীর, গাজাবাসীর বিজয়গাঁথা।
অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরাইলের নৃশংসতা নিয়ে বানানো হচ্ছে উপহাসমূলক কন্টেন্ট। ২৯শে নভেম্বর হ্যাশট্যাগ উই ওয়ান্ট বি সাইলেন্সড প্রচারণা শুরু হয়। এতে একজনের মুখ অন্যজন বন্ধ করে রেখেছে, এমন ছবি এবং সংশ্লিষ্ট লেখা দিতে বলা হয়। বলা হয় পোস্টার দিতে। এই প্রচারণা শুরুর পর লাখো মানুষের ইমপ্রেশন পেয়েছে তারা। মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদেরকে এখন সামাল দেয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধে ইসরাইল পিছিয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে পলিটিকো রিপোর্ট করেছে যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন- অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির মধ্যে সাংবাদিকদেরকে গাজায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে কেন তা নিয়ে। তাদের কেন গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ধারণ করতে দেয়া হলো। গাজায় যে গণহত্যা করা হয়েছে তা আরও প্রকাশ হয়ে পড়লে পক্ষান্তরে জনমত চলে যাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বোমা হামলার পর থেকেই জনমত পাল্টে যাওয়া শুরু হয়েছে। লেখাটা শেষ করতে চাই নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা থমাস এম ফ্রেডম্যানের একটি লেখার অংশবিশেষ দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘অন্ধ এক ক্ষোভে ইসরাইল অভিযান চালাচ্ছে। তারা যে লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে তা অর্জন হবে না। তারা চাইছে পৃথিবীর বুক থেকে হামাসকে মুছে ফেলতে। কিন্তু এরপরও তো সকাল হবে- তখনকার পরিকল্পনা কী তা নেই ইসরাইলের। ফলে চিরদিনের জন্য গাজায় আটকে থাকতে হবে ইসরাইলকে।’
বিজ্ঞ কনফুসিয়াসের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তা হলো- ‘তুমি কোনো প্রতিশোধ নিতে যাওয়ার আগে দুটি কবর খুঁড়বে। তার একটি হবে তোমার শত্রুর জন্য। আরেকটি তোমার নিজের জন্য।’