নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
নির্বাচনের নতুন মডেল শরিকদের অভিমান
শামীমুল হক
১ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার
অপরদিকে আমেরিকা, ইইউ’র অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আহ্বান যে সরকার ভালোভাবে নিচ্ছে না- তা তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট। গতকালও এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে পিটার হাসের চলাচলের, কার্যক্রমের একটা সীমানা আছে। আমরা বিশ্বাস করি তিনি সেটা মেনে চলবেন
তিনি আরও বলেন, পক্ষপাতমূলক আচরণ আওয়ামী লীগের কাম্য নয়। পিটার হাসকে আমরা আমাদের পক্ষে চাই না। অন্য কোনো দলের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করেন তাও চাই না। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এরইমধ্যে বলেছে, তারা কোনো দলের পক্ষাবলম্বন করবে না। আমরা চাই বাস্তবে যেন তার প্রতিফলন ঘটে।
নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। এর মাধ্যমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ট্রেন চলা শুরু হয়েছে। শেষদিনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী, স্বতন্ত্র হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার হিড়িক দেখা গেছে। অবশ্য তফসিল ঘোষণার পর থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই ঘোষণা দিয়েছেন স্বতন্ত্র লড়ার। বলেছেন, দলীয় প্রধানের নির্দেশনা অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত। আর তাই আন্দাজ করা যাচ্ছে আসন্ন নির্বাচনে লড়াই হবে আওয়ামী লীগ বনাম স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ প্রাথীর মধ্যে। এমনটা হলে দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক নতুন পালক যুক্ত হবে। অবশ্য এর আগে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নানা মান- অভিমান প্রকাশ্যে এসেছে। বিশেষ করে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় পার্টির প্রধান উপদেষ্টা বেগম রওশন এরশাদ দলীয় মনোনয়ন নেননি। তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বলতে গেলে নির্বাচন বর্জন করেছেন। তার পুত্র সাদ এরশাদও এ তালিকায় রয়েছেন। ওদিকে তৃণমূল বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের একটি ভিডিও তো এখন ভাইরাল। যেখানে তিনি বলছেন, আমি নারায়ণগঞ্জ-৫ এ নির্বাচন করবো না। রূপগঞ্জে নির্বাচন করবো। যেখানে বলার সেখানে আমি বলে এসেছি। আর এ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাবেক সচিব, কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরীর আসনে লড়ছেন আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, একাধিকবারের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ। তৃণমূল বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা মরহুম নাজমুল হুদার কন্যা অন্তরা হুদা নিজের আসন ছেড়ে তিনি নির্বাচন করছেন মুন্সীগঞ্জ থেকে। নির্বাচনকে ঘিরে অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দলের উপর চাপ ছিল নির্বাচনে অংশ নেয়ার। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এ চাপ কতটুকু সফল হয়েছে। বিভিন্ন সময় চাউর হয়েছে বিএনপিসহ সমমনা জোটের বহু নেতা নির্বাচনে অংশ নেবেন। কিন্তু মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষদিনে তেমনটা দেখা যায়নি। তবে বিএনপি নেতা, সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান ওমর এখন আলোচনায়। বুধবার দুপুরে তিনি জামিন পান। সন্ধ্যায় কারাগার থেকে মুক্ত হন। বৃহস্পতিবার তিনি ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ থেকে তিনি নির্বাচন করবেন। তার জামিন ও মুক্তি এতো দ্রুততার সঙ্গে হয়েছে যা অকল্পনীয়। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে বিএনপি নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আলহাজ সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সাবেক এমপি মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনীর পুত্র আবুল হাসানাত ইসলামী ঐক্যজোট থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এছাড়া এ আসনের সাবেক এমপি সদ্য প্রয়াত উকিল আবদুস সাত্তারের পুত্র মাঈনুল হাসান তুষার তৃণমূল বিএনপি’র হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর আগে তিনি সরাইলে শো-ডাউন করেন। হবিগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এ আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলম। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগে বিশাল এক জনসমাবেশে তিনি চুনারুঘাটবাসীর সমর্থন নেন। সেখানে তিনি প্রতিমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা মেনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাচ্ছি। মাহবুব ভাই আপনি খুব ভালো মানুষ। আপনার প্রতি অনুরোধ দয়া করে আমাদের কোনো প্রকার বাধা দেবেন না।
বগুড়া-৪ আসন থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ওই আসন থেকে বিএনপি’র মনোনয়ন নিয়ে ৪ বারের নির্বাচিত এমপি ডা. জিয়াউল হক মোল্লা। বুধবার তিনি কাহালু উপজেলা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. মেরিনা আফরোজের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। যেমনটা ভাবা হচ্ছিল বিএনপি থেকে বহু নেতা নির্বাচনে অংশ নেবেন তেমনটা বাস্তবে দেখা যায়নি।

সে যাইহোক, মূল কথা হলো- একটি বৃহৎ অংশকে বাইরে রেখে নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য? যেখানে দেশ- বিদেশ থেকে বলা হচ্ছে নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক। দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচনকে কি অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে? এছাড়া বিএনপি’র সঙ্গে রয়েছে সমমনা দল। এ নির্বাচনে টিআইবি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ দেখা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, তফসিল ঘোষণার আগে ও পরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এ পর্যবেক্ষণে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে যে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ বলতে যা বোঝায়, তা আমরা এবারও দেখতে পাচ্ছি না। গতকাল বৃহস্পতিবার ধানমণ্ডির টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হয়তো এই নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে ক্ষমতায় কারা অধিষ্ঠিত থাকবেন সেটিও নির্ধারণ করার সুযোগ হবে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে জনগণের ভোটের অধিকারের যে নির্বাচন সেটি নিশ্চিত করা যাবে না। এই নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা বা ভোটের ওপর জনগণের আস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভব হবে বলে মনে করি। টিআইবি সবসময় এসব কথা বলে আসছে। কিন্তু এসব কথা কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
ফিরে আসা যাক নির্বাচনের দিকে। এ নির্বাচন আরেকটি দিক দিয়ে মনে রাখার মতো। তা হলো- নির্বাচনের আগেই বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তাদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া ধারাবাহিকভাবে মামলায় কারাদণ্ড দেয়া হয় বহু নেতাকে।
বুধবার জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম জানিয়েছেন, গত ২ মাসে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অন্তত ৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে সাজা দেয়া হয়েছে। কারও কারও ৬ মাস থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হয়েছে। ২৮শে অক্টোবর মহাসমাবেশের পর থেকে ৮৩৭ মামলায় ৭৩ হাজার ১২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ হাজার ৩২৬ জনকে। এই সময়ের মধ্যে এক সাংবাদিক ও ১৭ জন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে বিএনপি’র আইন-বিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল।
২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এক লাখ পঞ্চাশ হাজারেরও অধিক মামলায় বিএনপি ও বিএনপি’র সহযোগী সংগঠনসমূহের ৫০ লাখের বেশি নেতাকর্মী-সমর্থককে আসামি করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। সবচেয়ে বড় বিষয় যেটি তা হলো- বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের না পেয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজন, অসুস্থ, পঙ্গু এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দেশব্যাপী বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর করা হচ্ছে। এমনকি গভীর রাতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে প্রবেশ করে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করা হচ্ছে। বিএনপি’র ভাষায় নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই সরকার এমনটা করছে। সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- যাদের কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে সবই পুরনো মামলায়। ২০১৩-১৪ সালের আগুন সন্ত্রাস, ভাঙচুর ইত্যাদি মামলায় আদালত কারাদণ্ড দিচ্ছেন। এতে সরকারের করার কি আছে?
বৃহস্পতিবার বিএনপি’র সমমনা দলের এক রাজনীতিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন ব্যাপক চাপে ছিলাম নির্বাচনে যেতে। বিশেষ করে বুধবার দিনটি ছিল আমাদের জন্য কঠিন এক সময়। সেই কঠিন সময় পার করে এসেছি।
অপরদিকে আমেরিকা, ইইউ’র অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আহ্বান যে সরকার ভালোভাবে নিচ্ছে না তা তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট। গতকালও এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে পিটার হাসের চলাচলের, কার্যক্রমের একটা সীমানা আছে। আমরা বিশ্বাস করি তিনি সেটা মেনে চলবেন। তিনি আরও বলেন, পক্ষপাতমূলক আচরণ আওয়ামী লীগের কাম্য নয়। পিটার হাসকে আমরা আমাদের পক্ষে চাই না। অন্য কোনো দলের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করেন তাও চাই না। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এরইমধ্যে বলেছে, তারা কোনো দলের পক্ষাবলম্বন করবে না। আমরা চাই বাস্তবে যেন তার প্রতিফলন ঘটে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নির্বাচনের জন্য পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, এ নির্বাচন নিয়ে যত বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে, যত অপবাদ ছাড়ানো হয়েছে... সেখানে কিন্তু অনেকে ভেবেছিল বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সাড়া দেবেন না। কিন্তু ইতিমধ্যে শতাধিক পর্যবেক্ষক সাড়া দিয়েছেন। এ নিয়ে আমরা চিন্তিত না।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক না পাঠালেও যুক্তরাষ্ট্র ও কমনওয়েলথসহ অনেকে পাঠাচ্ছে। এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে প্রায় শতাধিক পর্যবেক্ষকের নাম চলে এসেছে। নির্বাচনে বিএনপি’র অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে সেতুমন্ত্রী বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বিএনপি তাদের শেষ কথা বলে দিয়েছে। দলীয় প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের নির্বাচনী আচরণবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের অংশগ্রহণে একটি ভালো নির্বাচন হবে। বিশেষ করে নারী ভোটারদের মধ্যে জাগরণ দেখা যাচ্ছে। এই নির্বাচন ভোটারবিহীন হবে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায় স্পষ্ট নির্বাচন নিয়ে তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু জনগণ কি সন্তুষ্ট?