মত-মতান্তর
আন্তর্জাতিক যোগ দিবসের প্রত্যাশা
সালেক উদ্দিন
২১ জুন ২০২২, মঙ্গলবার
২০১৫ সালে জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে ২১ জুনের দিনটিকে বিশ্ব যোগ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যোগ ধ্যান বা মেডিটেশনের বহুমুখী মনোদৈহিক উপকারিতার কথা বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত। অধিবেশনে পৃথিবীর ১৭৫ টি দেশের সমর্থনে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সে বছরই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক যোগ দিবস উদযাপিত হয় মহাসমারোহে। দিবসটি উদযাপন কালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন যোগ মেডিটেশনের অংশ নিয়েছিলেন। ঐদিন শ্রীলংকার কলম্বোতে সহস্রাধিক মানুষ মেডিটেশনে অংশ নিয়েছিলেন। ভারতে দিল্লির রাজপথে মেডিটেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ!
কুয়ালালামপুর স্কটল্যান্ড লন্ডন ওয়াশিংটন ডিসি ক্যালিফোর্নিয়ার সহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে যোগ মেডিটেশনের বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছিল ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস। সেই থেকেই প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ জুন মাসের ২১ তারিখকে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। যোগ ধ্যান বা মেডিটেশন হলো মনের ব্যায়াম। সেই প্রাচীন কালে উদ্ভূত এ এক বিশেষ ধরনের শারীরিক ও মানসিক ব্যায়াম এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলন প্রথা। এর মাধ্যমে মনের জট মুক্তির মধ্য দিয়ে মানুষ মানসিক শান্তি পেতে পারে দৈহিক জটিল রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভ করতে পারে।
চিকিৎসাশাস্ত্রের ব্যাপক বিস্তার লাভের পরও এই প্রাচীন মাধ্যমটির অপরিহার্যতা কমেনি বরং বেড়েছে। যোগকে সারা বিশ্ব শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যোগব্যায়ামই বলি অথবা ধ্যানই বলি বা মেডিটেশনই বলি এটি মানুষের মনোযোগ সচেতনতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। মনের জট খুলে দেয়। হতাশা ও নেতিবাচকতা দূর করে মানুষকে ইতিবাচক করে গড়ে তোলে। মানুষের মনের টেনশন দূর করে। বিশেষজ্ঞদের মতে টেনশনের কারণে মানবদেহে যে মারাত্মক রোগ গুলো হয় তা এই মাধ্যমটির মাধ্যমেই নিরাময় সম্ভব এবং মানুষকে সুস্থ রাখা সম্ভব। তাঁরা বলেন, সাধারণত মানুষ যা ভাবে বা প্রত্যয় করে তা সে সচেতন মনে করে। সচেতন মনের প্রত্যয় স্থায়ী হয় না! সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যায়। যোগী বা ধ্যানিরা মেডিটেটিভ লেভেলে গিয়ে দেহের রোগ মুক্তি, নিজের ও অন্যের কল্যাণের জন্য যে প্রার্থনা করে যে প্রত্যয় করে তা হয় অবচেতন মনে।
অবচেতন মনের চিন্তা চেতনা প্রত্যয় দীর্ঘ স্থায়িত্ব লাভ করে। এভাবেই মেডিটেশন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়ে জীবনের সফলতা আনতে পারে। সমাজকে উপহার দিতে পারে রোগমুক্ত সুস্থ প্রত্যয়ী সু-শৃংখল অসাম্প্রদায়িক মানুষ। একটি দেশের জন্য যোগ মেডিটেশন কার্যক্রম যে কত প্রয়োজন তা উল্লেখ করতে গিয়ে ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের হৃদরোগ ক্যান্সারের পরই স্ট্রেসের ফলে সৃষ্ট রোগ গুলোর পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে ম্যাসাচুসেট্স জেনারেল হাসপাতাল পরিচালিত গবেষণার যে ফলাফল উল্লেখ করা হয়েছিল তা হল, ৪৪০০ জন রোগীকে নিয়মিত মেডিটেশন করানোর ফলে তাদের জনপ্রতি বাৎসরিক চিকিৎসা ব্যয় ৪৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, নিয়মিত মেডিটেশন করার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার অন্তত ৮৭ভাগ কমে গিয়েছে। ৯১ ভাগ মানুষই মেডিটেশন করে ঘুমের ওষুধ বা স্লিপিং পিল খাওয়া বাদ দিতে পেরেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যোগমেডিটেশনের অপরিহার্যতা বিবেচনা করে এর সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য নানবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ২০১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যোগমেডিটেশন কার্যক্রমের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, মেডিটেশন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের জন্য ১০ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করেছিল এবং ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস মেডিটেশনকে মূল ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে সে দেশের চিকিৎসকদের একটি বৃহৎ অংশ রোগীদের মেডিটেশন প্রেসক্রাইব করছেন।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও মেডিটেশনের ওপর ভ্যাট ট্যাক্স স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। সারা বিশ্বের মতো আমরাও মেডিটেশনের বিষয়ে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান মেডিটেশনের উপর ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে! সুস্থ দেহের প্রশান্ত মনের কর্মব্যস্ত আলোকিত মানুষ তৈরীর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা নীতিমালায়ও স্ট্রেস আক্রান্ত ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের নিয়মিত যোগ মেডিটেশন শিথিলায়ন দমচর্চা ইত্যাদিও পণ্য নয়। এটি মানুষের জন্য অপরিহার্য একটি পরিপূরক চিকিৎসাসেবা। পরামর্শ দেয়ার জন্য চিকিৎসকদের বলা হয়েছে। অতএব বলতে দ্বিধা নেই মেডিটেশন কোন বিলাসিতা নয় ভোগ্য এই লেখা টি যখন লিখছি তখনো মেডিটেশনের মত সেবামূলক কল্যাণমূলক কার্যক্রমের উপর ভ্যাটের প্রস্তাব করা হয়েছে দেশের ২০২২-২৩ অর্থ বাজেটে। এর আগেও একাধিকবার আমাদের অর্থ বাজেটে মেডিটেশন কার্যক্রমের উপর ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। মেডিটেশন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং যারা মেডিটেশন করছেন তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবারই তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল। ২০১৫-১৬ অর্থ বাজেটে মেডিটেশন সেবার উপর প্রস্তাবিত ভ্যাট প্রত্যাহারের সময় কারণ হিসেবে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, 'মেডিটেশন সেবা গ্রহণ করে হতাশাগ্রস্ত অনেক মানসিক ও শরীরের ব্যাধিগ্রস্থ মানুষ মুক্তির প্রয়াস পায়।
সে কারণেই মেডিটেশন সেবার উপর প্রযোজ্য ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হলো। পরবর্তী অর্থ বাজেটে পুনরায় মেডিটেশন কার্যক্রমের উপর ভ্যাট প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং তা প্রত্যাহারের সময়ও অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, 'কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনকে একটি সমাজ কল্যাণ কার্যক্রম হিসেবে আমরা বিবেচনা করব এবং আগামী দুই বছরের জন্য ধ্যান যোগ ও মেডিটেশনের উপর কোনরকম ভ্যাট আরোপ না করার প্রস্তাব করছি। আমরা আশা করছি যেহেতু মেডিটেশন সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম হিসেবে পৃথিবীময় স্বীকৃত সেহেতু পার্শ্ববর্তী আরোপের বিষয়টি স্থায়ীভাবে অব্যাহতি লাভ করবে। দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও যোগ ধ্যান মেডিটেশন কার্যক্রমের উপর ভ্যাট এবছরের আন্তর্জাতিক যোগ দিবস সফল হোক। সারা বিশ্বেই মহাসমারোহে পালিত হোক এই দিবস। আরো অনেক বেশি বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাক যোগ মেডিটেশনের মাহাত্ম্য। এর মাধ্যমে শারীরিকভাবে মানসিকভাবে ও আত্মিকভাবে বিশ্ববাসী সেরে উঠুক। সুস্থ দেহের প্রশান্ত মনের কর্মব্যস্ত আলোকিত মানুষে ভরে উঠুক এই পৃথিবী।
- সালেক উদ্দিন,কথা সাহিত্যিক, জীবন সদস্য বাংলা একাডেমি।
মন্তব্য করুন
মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন
মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]