নির্বাচিত কলাম
স্বপ্নের স্বদেশের সন্ধানে
তফসিল ঘোষণা- এরপর কি সব সমাধানের সুযোগ শেষ?
সুবাইল বিন আলম
২২ নভেম্বর ২০২৩, বুধবারএকটা লেখাতে দেখিয়েছিলাম দেশের এই নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য আমাদের ২০০০ কোটি টাকার অধিক অপচয় হচ্ছে- যা আসলে জনগণের ট্যাক্সের টাকা। কিন্তু যার সুফল আমরা পাচ্ছি না। যেখানে ভোট হচ্ছে সব কিছুর সূচনা মাত্র। আর আফসোস আমাদের স্বাধীনতার ৫২ বছরে এখনো আমরা কীভাবে নির্বাচন হবে তা ঠিক করতে পারি নাই, আমরা এখনো ভোটের অধিকার খুঁজছি। দেশে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র সেই নির্বাচনই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে- যা পরিচালিত হয়েছে নিরপেক্ষ সরকার দ্বারা। আমাদের সংসদ অকার্যকর হওয়ার একটা বড় কারণ সংবিধানের ৭০ ধারা যা সংশোধন না করলে সংসদ কখনোই কার্যকর হবে না। এ ছাড়া আনুপাতিক সরকার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতি- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্যকরণ, প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা-নির্বাচন কমিশন, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ, প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা সহ অনেক কিছু এখন সুশাসনের জন্য প্রয়োজন
তফসিল ঘোষণার আগে আমরা অনেক নড়াচড়া দেখলাম। সবার মধ্যে কী হয় কী হয় ভাব। সরকারি দল ব্যস্ত বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের উদ্বোধনে। বিরোধী দল অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বিভিন্ন হুঙ্কার দিচ্ছে। আবার কিছু ছোট দল চেষ্টায় আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর কষাকষি করে কিছু আসন বাগিয়ে নেয়া যায় কিনা দেখতে। এদিকে বিদেশিদের নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে চেষ্টাও করতে দেখা যাচ্ছে। আর আমরা সাধারণ মানুষ দেখছি, দেশের গণতন্ত্র আর গণমানুষের হাতে নাই। সব চেষ্টার মধ্যেও দেশ একটা ২০১৪/২০১৮ মডেলের ইলেকশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক সূচক আরও নামিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। ভি ডেম ইন্সটিটিউট অফ সুইডেনের র্যাংকিং অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭, ১৭৯টা দেশের মধ্যে। যা আসলে মোটেও ভালো না (প্রথম আলো ৩রা মার্চ, ২০২৩)।
রাজনীতিতে যেহেতু শেষ কথা নাই। তাই কী হবে না হবে- বলা কারও দ্বারা সম্ভব না। আমি নিজেও সংবিধান বিশেষজ্ঞ না। কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর যা বিভিন্ন আলোচনাতে উঠছে- আগের বিভিন্ন তথ্য থেকে দেয়ার চেষ্টা করছি।
তফসিল কি বাতিল হওয়া সম্ভব:বাংলাদেশের ইতিহাসে একবারই তফসিল বাতিল হয়েছিল ২০০৬ সালে। ২০০৬ সালে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক সংকটের মুখে নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের তারিখটি রয়ে গিয়েছিল। সেই তারিখ পরে বাতিল করেছিল আদালত (বিবিসি বাংলা ১৪ই নভেম্বর, ২০২৩)। কিন্তু তফসিল পরিবর্তন (বিভিন্ন তারিখ) নির্বাচন কমিশনই করতে পারে- এবং তার উদাহরণও আছে।
নির্বাচন কি পেছাতে পারে?
চলুন দেখে নেই আমাদের সংবিধান কি বলছে নির্বাচন নিয়ে।
“১২৩-(৩) সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে
(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং
(খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে।”
তাই উপধারা (ক) অনুসারে নির্বাচন কমিশনের ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে। আর তাই তারা নিজেদের কাজও শুরু করেছে। আর তফসিল ঘোষণার পরই আসলে অনেক কিছুর ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে চলে যায়, তারা কতোটুকু কী করবে তার উপরেই নির্বাচনী পরিবেশ কেমন হবে নির্ভর করে।
এখন কথা আছে, উপধারা (খ) অনুসারে যদি সংসদ ভেংগে দেয়া হয় তাহলে সে ভেংগে দেয়া সময় থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে করতে হবে। বর্তমান সংসদের মেয়াদ আছে ৩০শে জানুয়ারি, ২০২৪ পর্যন্ত (উইকিপিডিয়া)। এখন কোনো কারণে দ্বাদশ নির্বাচনের আগে যদি সংসদ ভেংগে দেয়া হয় তাহলে নির্বাচন পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে করতে হবে। এটাকে দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে ভাবা যেতে পারে। (প্রথম আলো ০১, ২০১৩ ইং)।
সংসদ ভেংগে নির্বাচন বাংলাদেশের বিরোধীদের একটা দাবি। কারণ সংসদ রেখে আসলে কোনোভাবেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করা সম্ভব না।
নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা কীভাবে সম্ভব?
বর্তমান সরকার একটা জায়গাতে আটকে রেখেছে যে, সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচন হতে হবে। আর এখানেই সব সমস্যার শুরু। সংবিধানের মধ্যে থেকে নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা সম্ভব কিনা এটা নিয়ে অনেক লেখা দেখা যায়। এদের মধ্যে নেত্রা নিউজ ১৫ই জুন ২০২৩ সালে একটা সাংবিধানিক প্রস্তাবনা দেয় যা সব থেকে কাছাকাছি ছিল। কিন্তু এই প্রস্তাবনাতে অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার প্রয়োজন আছে। এই প্রস্তাবনা তখনই বাস্তবে সম্ভব যখন একজন সর্বজন স্বীকৃত রাষ্ট্রপতি থাকবে, নির্বাচন বিষয়ক ট্যাকনোক্র্যাট মন্ত্রি কে হবেন, মন্ত্রিসভায় কারা থাকছেন, সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচন কমিশন, প্রধান মন্ত্রীর পদত্যাগ এবং সংসদ ভেঙে দেয়ার ব্যাপারে সবাই যখন একমত হতে পারবে। আর সেই ঐকমত্যের জন্য সবাইকে এক সঙ্গে বসতে হবে। সেই বসাটাই এই দেশের রাজনীতিবিদেরা করতে পারছেন না। এখানে সরকারের সদিচ্ছা খুব বেশি দরকার ছিল- যা আসলে দেখা যাচ্ছে না।
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। কিন্তু ঐ ব্যবস্থা যদি ফিরেও আসে- তাহলে কি বিএনপি আগের প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে মেনে নিতে পারবে? আমাদের সাংবিধানিক সংকট কিন্তু ২০০৬ সালে বিদায়ী বিচারপতিকে মেনে নিতে না পারা থেকেই শুরু।
এদিকে অনেকে বলছেন- জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচন। যা ২০০৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় নিজেই চেয়েছিলেন (প্রথম আলো ১৫ই নভেম্বর, ২০২৩)। এর জন্য সংবিধান পরিবর্তনের ঝামেলা নাই। এখানে দুটি উপায় আছে- জাতিসংঘ নিজে থেকে নির্বাচন পরিচালনা করতে আসতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটোর ঝামেলা আসবে। কিন্তু মেম্বার দেশ যদি নিজে অনুরোধ করে- তখন আর কোনো সমস্যা থাকবে না। এখানেও সরকারের সদিচ্ছা বা ঐকমত্য দরকার। যদিও এটা ‘ওয়ান টাইম’ সমাধান। জাতিসংঘ অনেক দেশেই সার্বিক নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনর্গঠনে কাজ করেছে (জাতিসংঘ ওয়েবসাইট)।
সমাধান সম্ভব?
এখনো যেহেতু সংসদ আছে, তফসিল বাতিল করে যেকোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব। সংবিধান বদলের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারের আছে। আর তাদের হাতে সময় আছে ৩০শে জানুয়ারি বা নির্বাচন যেটা আগে হবে। রাজনৈতিক সমাধান রাজনীতিবিদদেরই আসলে করা উচিত।
না হলে কি হবে?
এটা আসলে আমরা কেউই জানি না। হয়তো আগের মতো নির্বাচন করে এই সরকার থেকে যাবে। কিন্তু হরতাল অবরোধে আমাদের অবস্থা হবে ত্রাহি মধুসূদন। এদিকে বিদেশিরা যদি স্যাংশন দিয়েই ফেলে দেশের অর্থনীতির জন্য যা আসলে মোটেও ভালো হবে না। আবার ক্ষমতায় থাকার জন্য অন্য দেশকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে দেয়াও কাম্য না। উদাহরণ আছে কম্বোডিয়া যেখানে যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা আর চীন নিয়েছে ঘাঁটি। সেনা শাসন ছাড়া ও আবার আমরা দুইবার রাজনীতি সংবিধানের বাইরে অনির্বাচিত সরকারের হাতে চলে যেতে দেখেছি। ’৯০ সালে সবার ঐকমত্যের সরকার এবং ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদিও দুই সরকারই অবশ্য রাজনীতিবিদদের হাতেই ক্ষমতা দিয়ে গিয়েছিল।
প্রথম আলো ১২ই নভেম্বর অনলাইনে প্রকাশিত একটা লেখাতে দেখিয়েছিলাম দেশের এই নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য আমাদের ২০০০ কোটি টাকার অধিক অপচয় হচ্ছে- যা আসলে জনগণের ট্যাক্সের টাকা। কিন্তু যার সুফল আমরা পাচ্ছি না। যেখানে ভোট হচ্ছে সব কিছুর সূচনা মাত্র। আর আফসোস আমাদের স্বাধীনতার ৫২ বছরে এখনো আমরা কীভাবে নির্বাচন হবে তা ঠিক করতে পারি নাই, আমরা এখনো ভোটের অধিকার খুঁজছি। দেশে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র সেই নির্বাচনই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে- যা পরিচালিত হয়েছে নিরপেক্ষ সরকার দ্বারা। আমাদের সংসদ অকার্যকর হওয়ার একটা বড় কারণ সংবিধানের ৭০ ধারা যা সংশোধন না করলে সংসদ কখনোই কার্যকর হবে না। এ ছাড়া আনুপাতিক সরকার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতি- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্যকরণ, প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা-নির্বাচন কমিশন, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ, প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা সহ অনেক কিছু এখন সুশাসনের জন্য প্রয়োজন।
বর্তমান বিশ্বে সুশাসনের মানদণ্ড নির্ধারিত হয় নাগরিক অধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকারের ভিত্তিতে। কোনো একটি বাদ দিয়ে সুশাসন সম্ভব নয়। আমাদের দরকার অর্থবহ গণতন্ত্র, সুশাসন যেখানে থাকবে সবার সম অধিকার। মানবজমিনে ৩১ শে অক্টোবর প্রকাশিত লেখাতে আমি আশা করেছিলাম ২০২৪ থেকে কি দেশ সুশাসনের দিকে যেতে পারে কিনা। যে দেশের গণতন্ত্র যত উন্নত, তারা সার্বিক ভাবেও উন্নত দেশ। আর তা যাওয়ার জন্য এখনো শিশু অবস্থায় আছি। কি হয়- তা সময়েই বলবে। রাজনীতিতে দলগুলোর উচিত শুধু ক্ষমতা ধরে রাখা নয়, ক্ষমতা থেকে নেমে যাওয়ার রাস্তা খোলা রাখা এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতাতে ফিরে আসারও পথ খোলা রাখতে হয়।
লেখক: টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক কলামিস্ট