ঢাকা, ১১ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৫ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

মত-মতান্তর

তামাকমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা জরুরি

হাজী মো. আবদুল গনি

(৩ বছর আগে) ২০ জুন ২০২২, সোমবার, ৩:৫০ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৩:৫২ অপরাহ্ন

mzamin

আমেরিকায় তামাকের ব্যবহার কয়েক হাজার বছর আগে থেকে চলে আসলেও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এর ব্যবহার ৫০০ বছর আগে শুরু হয়েছে। মূলত ভাস্কো দা গামার আমেরিকা আবিষ্কারের পর বিশ্বজুড়ে তামাক ছড়িয়ে পড়ে। সেই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় উপমহাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে তামাকের বিষ। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তামাক শুধু ধূমপানের মাধ্যমে ব্যবহার করা হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় এর ব্যাপকতা অনেক বেশি। এই অঞ্চলের মানুষ বিড়ি-সিগারেটের পাশাপাশি জর্দা, গুল, খৈনি, নস্যির মতো বিভিন্ন উপায়ে তামাক ব্যবহার করে থাকে। এমনকি বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে আপ্যায়নের অন্যতম অনুষঙ্গ পান-সুপারি-জর্দা। অর্থাৎ, তামাকের সামাজিক স্বীকৃতি রয়েছে এই অঞ্চলে, যা এর ব্যবহার বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।

তামাকের বহুল ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে দিনদিন হৃদরোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এসব রোগের সাথে তামাক ব্যবহারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তামাক শুধু স্বাস্থ্য নয়, পরিবেশ, প্রকৃতিরও ক্ষতি করে। তামাকের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তার নির্দেশনা অনুসারে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনো দেশের পৌনে চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুলের মতো তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করেন (গ্যাটস ২০১৭ অনুসারে)। এর বাইরে আরো বিশাল একটি অংশ রয়েছে যারা নিজেরা ধূমপান বা কোনো তামাক ব্যবহার করেন না, কিন্তু তারাও তামাকের কারণে স্বাস্থ্যক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

অধূমপায়ী ব্যক্তি যখন ধূমপানকারীর তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসে তখন তাকে পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়ে থাকে। পরোক্ষ ধূমপান প্রত্যক্ষ ধূমপানের মতই ক্ষতিকর। কারণ, এতে রয়েছে নিকোটিন, ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানসহ আরো নানা রকম বিষাক্ত উপাদান, যা দেহের অনেক ক্ষতিসাধন করে থাকে। পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসা যেকোন শ্রেনী বা বয়সের ব্যক্তিই এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল, বিনোদন কেন্দ্রের মতো পাবলিক প্লেস এবং গণপরিবহনে প্রায় চার কোটি মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ অন্যের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। অথচ এটি নিয়ে আমরা খুব বেশি উদ্বিগ্ন নই!

পরোক্ষ ধূমপানজনিত ক্ষতি হতে অধূমপায়ীদের রক্ষার্থে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) অনুসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, হাসপাতাল ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌ-বন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্নিমাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, বিপণী ভবন, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি স্থানকে ‘পাবলিক প্লেস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ।

স্বভাবতই এসব পাবলিক প্লেস ধূমপানমুক্ত রয়েছে কিনা তা তদারকির দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত স্যানিটারি ইন্সপেক্টরগণ এবিষয়ে আইনানুগ কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কোন পাবলিক প্লেস কর্তৃপক্ষ তাদের স্থানটি আইন অনুসারে ধূমপানমুক্ত রাখতে ব্যর্থ হলে, স্যানিটারি ইন্সপেক্টরগণ আদালতে লিখিত অভিযোগ জানাতে পারেন। এছাড়া আইনের ২(চ) ধারা অনুসারে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের আওতাভুক্ত এলাকায় যেকোনো স্থানকে পাবলিক প্লেস হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে ধূমপান নিষিদ্ধ করতে পারেন।

অর্থাৎ, আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে পৌর কর্তৃপক্ষ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যেকোনো জনসমাগমপূর্ণ স্থানকে পাবলিক প্লেস ঘোষণা করতে পারেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থানীয় হাটবাজার, চায়ের দোকানগুলোকে ধূমপানমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া স্কুল, কলেজের আশেপাশে দোকানগুলোতেও ধূমপান নিষিদ্ধ করা জরুরি। এভাবে পৌর কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়ে নিজের এলাকাকে সম্পূর্ণ ধূমপানমুক্ত করে ‘মডেল পৌরসভা’ হিসেবে দৃষ্টান্ত রাখতে পারে।

স্থানীয় পর্যায়ে তামাক ও ধূমপানের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করতে পারে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো। এজন্য বিভিন্ন জনসামগমপূর্ণ স্থানে সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড, ব্যানার, ডিজিটাল ডিসপ্লে ইত্যাদি স্থাপন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে জনগণ তামাকের কুফল সম্পর্কে জানতে পারবে। সেই সাথে বাজার, বাসস্ট্যান্ড, শপিংমল, পার্ক, খেলার মাঠের মতো পাবলিক প্লেসগুলোতে ‘ধূমপান নিষিদ্ধ’ নোটিশ থাকলে তা দেখে মানুষ সচেতন হবে। এর ফলে এসব স্থানে ধূমপান বন্ধ হবে এবং অধূমপায়ীদের সুরক্ষা প্রদান করা সম্ভব হবে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হলেও ধারা ৭-এ ঐসব এলাকায় ‘ধূমপান এলাকা’ রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক রেস্তোরাঁয় ‘স্মোকিং জোন’ রাখা হয়। অথচ, যিনি ধূমপান করেন না তার অধিকার আছে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা অনেক বেশি। যেহেতু ধূমপানের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তাই ধূমপান এলাকা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হলেও ধূমপানের ধোঁয়া ধূমপানমুক্ত এলাকাতেও চলে যায়। যার ফলে অন্যরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। এজন্য সব ধরনের পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা উচিত। এর ফলে সেখানে আগত অধূমপায়ীরা বিশেষত নারী ও শিশু পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবেন।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, কানাডা, স্পেন, নেপালসহ বিশ্বের ৬৩টি দেশে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত জায়গা নিষিদ্ধ করে আইন রয়েছে। এসব দেশে কোনো পাবলিক প্লেস বা গণপরিবহনে ধূমপানের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। আমাদের দেশেও ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ এর ধারা ৭ সংশোধন করে সব ধরনের পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা এবং পাবলিক প্লেসকে শতভাগ ধূমপানমুক্ত করা জরুরি।

আশার কথা হলো, সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধন করে পাবলিক প্লেসে ‘ধূমপান এলাকা’ রাখার সুযোগ বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। অধূমপায়ীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এটা অনেক কার্যকর হবে। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথে আমরা অনেকখানি এগিয়ে যাবো বলে আশা করি।

লেখক : মেয়র, সাভার পৌরসভা, ঢাকা এবং নির্বাহী সভাপতি, মিউনিসিপ্যাল এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status