ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ

বৈধ অস্ত্রে সহিংসতা, জায়েদ খানের পিস্তল এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন

তারিক চয়ন
১৯ জুন ২০২২, রবিবার
mzamin

চলতি বছরের শুরু থেকে ১১ই জুন পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। অলাভজনক গবেষণা সংস্থা ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’-এর তথ্য বলছে, এই সময়ে আহত হয়েছেন আরও ১৬,৫২৭ জন। যারা মারা গেছেন তাদের অর্ধেকের বেশিই (১০,৮২৪ জন) অবশ্য আত্মহত্যা করেছেন। ট্রাম্প জমানার শেষ বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় নিহত হয়েছিলেন। এটাই দেশটির ইতিহাসে এক বছরে আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। ওই বছর একইভাবে মৃত্যুহার পাঁচ বছর আগের তুলনায় ২৫% বৃদ্ধি পেয়েছিল।

বিশ্বের যেকোনো ধনী দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হত্যার ঘটনা ঘটছে অনেক বেশি এবং সেটা প্রায় নিয়মিতভাবেই, এমনটা জেনে যদি আপনি অবাক হয়ে থাকেন; তবে, সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘স্মল আর্মস সার্ভে’- জানাচ্ছে আরও চমকপ্রদ তথ্য। ২০১৮ সালে ৩২ কোটি ৬৮ লাখ আমেরিকানের কাছে ৩৯ কোটি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল! অর্থাৎ প্রতি ১০০ আমেরিকানের কাছে গড়ে ১২০ টি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল! এর মানে ওই দেশে মাথাপিছু মানুষের চেয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা বেশি!

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে বন্দুকধারীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের কথা যেমন প্রায়ই শোনা যায়, তেমনি আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ক আইন কঠোর করার দাবিতে দেশটিতে বিক্ষোভ-সমাবেশের কথাও প্রায়ই শোনা যায়। সেখানে, আগ্নেয়াস্ত্র আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের দাবিতে মার্চ ফর আওয়ার লাইভস (এমএফওএল) বড় বড় সমাবেশ করে আসছে। এমএফওএল’র প্রথম বিক্ষোভটি হয়েছিল ২০১৮ সালে, ট্রাম্পের শাসনামলে। আয়োজকরা দাবি করেছিলেন, ওটাই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক দিনে সবচেয়ে বড় সমাবেশ।

বিজ্ঞাপন
হাজার হাজার শিক্ষার্থী সেদিন নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে সমাবেশে যোগ দিয়েছিল।

আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর করার দাবিতে সর্বশেষ ১১ই জুন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। বিক্ষোভকে সমর্থন দিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টুইটারে লিখেছেন, আমি তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কংগ্রেসের প্রতি ফের আহ্বান জানাচ্ছি: কিছু একটা করুন। এর আগেও বিভিন্ন জরিপের কথা উল্লেখ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, অধিকাংশ মানুষ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট এবং দেশের অধিকাংশ জনগণ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পক্ষে, তারপরও সেটি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়ন করা যাচ্ছে না কেন? প্রেসিডেন্ট এমন আইন নিজে না করে কেনই বা কংগ্রেসকে আহ্বান জানাচ্ছেন? ২০১৫ সালে বিবিসি ব্যাখ্যা দিয়েছিল এভাবে, ‘এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মতামত খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং, কংগ্রেস সদস্যদের মতামতই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর, কংগ্রেস আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে। কংগ্রেসের ‘জটিল হিসাব- নিকাশের’ কারণে অনেক সময় কংগ্রেসম্যানদের চিন্তাধারায় সার্বিকভাবে দেশের অধিকাংশ জনগণের মনোভাবের প্রতিফলন হয় না। সেজন্য, বন্দুকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধের জন্য প্রেসিডেন্টের আগ্রহ থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।’

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী তার নাগরিকদের আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অধিকার দিয়ে বলেছে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য একটি সুসংগঠিত সেনাবাহিনী প্রয়োজন, কিন্তু মানুষের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকারকে লঙ্ঘন করা যাবে না’। 

২০০৮ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীর আলোকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য আদালতে মামলা করা হলেও আদালত সেটি শুনতে চাননি। তাছাড়া, দেশটির সিনেটে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের নিয়ে গঠিত আন্তঃদলীয় গ্রুপ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কথা বলে এলেও সবসময়ই তাতে রিপাবলিকানদের বিরোধিতা করতে দেখা গেছে। আশার কথা এই যে, অতি সম্প্রতি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে সম্ভাব্য একটি আইন প্রণয়নে সিনেটের আন্তঃদলীয় গ্রুপ একমত হয়েছে। রিপাবলিকানরা এতে সমর্থন করার মানে, এটিকে আইনে রূপান্তরিত করার মতো যথেষ্ট ভোট রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘এটা সঠিক পথে যাত্রা’- হলেও আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা কমাতে যা প্রয়োজন তার চাইতে অনেক কম। বোঝাই যাচ্ছে, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়নের জন্য কীভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন বাইডেন।

লক্ষণীয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে ক্রয় করা ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে নানা ধরনের বিভেদ বা মত থাকলেও দেশটিতে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে কখনোই তেমন কোনো কথা ওঠেনি। এমনকি বন্দুকের গুলিতে মানুষ হতাহত হওয়ার প্রায় প্রতিটি ঘটনারই বিচার নিশ্চিত করা হচ্ছে। আসামি কেউই আইনের কাঠগড়া থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমরা যদি নিজ দেশের দিকে নজর দিই তাহলে দেখতে পাবো একেবারে অন্যরকম এক চিত্র।

বাংলাদেশে জনপ্রতি আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা যে যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছেও নেই, সেটাতো সবাই জানেন। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) হালনাগাদ বৈধ অস্ত্রের তথ্যভাণ্ডার ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফএএমএস) সূত্রে গত বছরের শেষের দিকে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়- সারা দেশে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪৪ হাজার ১০৪টি, যার মধ্যে ব্যক্তির নামে রয়েছে ৪০ হাজার ৭৭৭টি অস্ত্র। বাকি অস্ত্রগুলোর লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে মানুষের চেয়ে অস্ত্রের সংখ্যা বেশি, সেখানে বাংলাদেশের মুষ্টিমেয়-হাতেগোনা মানুষের কাছে রয়েছে বৈধ অস্ত্র।

কিন্তু, বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার দেখা গেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরাও সরকারের কাছ থেকে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছে বলে নানা সময়ে খবর বের হয়েছে। তাছাড়া, বৈধ অস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা চালানোরও খবর বেরিয়েছে। অবৈধ অস্ত্র দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে কিংবা সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখানোর খবর প্রায়শই শোনা যায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্বাচন, সংঘর্ষ কিংবা হামলার সময় বিশেষ করে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রের ছবি পত্রপত্রিকায় পর্যন্ত ছাপা হয়েছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ওই আগ্নেয়াস্ত্র কোত্থেকে এলো, কীভাবে এলো, অস্ত্রধারী অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য কিনা, ওই অস্ত্র বৈধ কিনা কিংবা বৈধ অস্ত্র হলেও সেটা জনসম্মুখে প্রদর্শন করে জনমনে ভীতির সঞ্চার করাটি বৈধ কিনা এসব নিয়ে কেউ সেভাবে প্রশ্ন  তোলেন না। কেউ প্রশ্ন করলেও নির্বাচন, আন্দোলন, সংঘর্ষ, আহত, নিহত ইত্যাদি শব্দের আড়ালে তার উত্তর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অজানা রয়ে যায়।

সম্প্রতি ঢাকার নায়ক জায়েদ খানের বিরুদ্ধে আরেক নায়ক ওমর সানীকে জনসম্মুখে অস্ত্র দেখিয়ে গুলি করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বসুন্ধরা কনভেনশন হলে খল অভিনেতা ডিপজলের ছেলের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সেদিন  উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার অতিথি। তারকাদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল ওই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে সানী জায়েদকে চড় মারায় জায়েদ পিস্তল বের করে তাকে গুলি করার হুমকি দেন। অভিযোগ উঠেছে- দীর্ঘদিন ধরেই সানীর স্ত্রী চিত্রনায়িকা মৌসুমীর সঙ্গে জায়েদ খারাপ আচরণ করে আসছিলেন। বিষয়টি নিয়ে জায়েদের ওপর ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত সানী অনেকদিন ধরেই তাকে খুঁজছিলেন। শেষে শুক্রবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে সামনে পেয়ে চড় মেরে বসেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়- চড় মারার সময় জায়েদকে উদ্দেশ্য করে সানী বলেন, ‘তোরে না নিষেধ করছি, আমার বউরে ডিস্টার্ব করবি না। কোনো ফাজলামি করবি না। অসম্মান করে কথা বলবি না।’ আর চড় খেয়ে জায়েদ কোমর থেকে পিস্তল বের করে বলেন, ‘গুলি করে দেবো’।

রোজিনা, অঞ্জনা এবং সুচরিতাদের মতো জ্যেষ্ঠ অভিনেত্রীদের সামনেই এমন ঘটনা ঘটে। ডিপজলও পরোক্ষভাবে ঘটনা স্বীকার করে বলেছেন, ‘দুজনের মধ্যে একটু ধাক্কাধাক্কি হয়েছে।’ এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি হয়। এক পর্যায়ে জায়েদ ঘটনাটিকে মিথ্যা দাবি করে জানান, যেহেতু ওই কনভেনশন সেন্টারের ভেতর কোনোরকম অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করাই নিষেধ, সেহেতু পিস্তল বের করার প্রশ্নই ওঠে না। অন্যদিকে সানীর দাবি, সেখানকার ভিডিওচিত্র দেখলেই প্রমাণ হবে জায়েদ মিথ্যা বলছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও খল অভিনেতা যাদু আজাদও জানিয়েছেন তিনি জায়েদের মুখ থেকে ‘গুলি করে দেব’- বলতে শুনেছেন। তার কাছে পিস্তল থাকা প্রসঙ্গে যাদুর প্রশ্ন, ‘জায়েদ খানকে কেন পিস্তল দেয়া হয়েছে? সে কি বড় ব্যবসায়ী? সে কি কোনো বিখ্যাত মানুষ? কেন তার কাছে এ ধরনের পিস্তল থাকবে? আমি মনে করি এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে তার পিস্তলের লাইসেন্স বাতিল হওয়া উচিত’। 

কেবল যাদু-ই নন, জায়েদের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন অনেকেই। বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াতের প্রশ্ন, ‘তার কাছে কে পিস্তল দিলো? মানে পিস্তল রাখার সৌভাগ্য তার কীভাবে হলো? কী-ই বা সে ব্যক্তিত্ব? কত টাকার মালিক যে তার আত্মরক্ষার জন্য আর্মস দিতে হবে সরকারের?’ লক্ষণীয় যে, জায়েদের মতো মানুষের কাছে পিস্তলের লাইসেন্স থাকা নিয়ে আপত্তি তুলছেন খোদ চলচ্চিত্র অঙ্গনেরই লোকজন।

যাই হোক, দেশের বৈধ ৪৪ হাজার ১০৪টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে জায়েদ খানের পিস্তলও একটি কিনা, সে সম্পর্কে ধারণা নেই। আগ্নেয়াস্ত্র বৈধ হলেও তা দিয়ে প্রকাশ্যে এভাবে অন্যকে ভয় দেখানোর সুযোগ যে নেই, তাতো বলাবাহুল্য। মানুষকে অস্ত্রের ভয় দেখালে লাইসেন্স বাতিল করার দাবি সবসময়ই সব মহল থেকে উঠে এসেছে। দেশে বৈধ অস্ত্রের পরিসংখ্যান জানা গেলেও অবৈধ অস্ত্রের ক্ষেত্রে সেটি জানা সম্ভব নয়। দেশজুড়ে প্রায়ই এখানে- সেখানে গোলাগুলির ঘটনা, গুলিতে হতাহতের ঘটনা, আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনার কথা শোনা যায়। অনেক ক্ষেত্রে পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেসব অস্ত্রধারী, অস্ত্রের উৎস, আসামিদের গ্রেপ্তার সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।

এই সেদিনও (২৬শে মে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইকোর্ট এলাকায় ছাত্রদলের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে গুলির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে শটগান হাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের এক কর্মীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার প্রমাণ গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সময়েই পাওয়া গেছে। মে মাসের শুরুর দিকে পাবনার সুজানগর উপজেলার ছাত্রলীগ নেতা আবু বক্কার সিদ্দিকী রাতুলের অস্ত্র হাতে ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। এ নিয়ে ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত ‘অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ নেতার ছবি ভাইরাল, খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ’- শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটি ভাইরাল হওয়ার দুইদিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় সচেতন মহলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

গত বছরের ২৭শে জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আ.ফ.ম সাইফুদ্দিনকে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে তার গুলি ছোড়ার দৃশ্য ধরা পড়ে। ৩০কে জানুয়ারি সমকালে প্রকাশিত ‘ভোটে গুলি চালানো সেই ছাত্রলীগ নেতা ধরাছোঁয়ার বাইরে’- শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়: কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, নগরীর পাথরঘাটা এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করা অস্ত্রধারী যুবক নগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আ.ফ.ম সাইফুদ্দিন। তিনি পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

এছাড়া, গত ৭ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় ১৬টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে অন্তত ৬টি ইউনিয়নে ব্যাপক অস্ত্রবাজি ও সংঘর্ষ হয় যাতে নিহত হন দু’জন। অস্ত্রধারী কামরুল আলম আজাদ ওরফে সুমন, শওকত হোসেন ওরফে শাখাওয়াত, মো. এজাহার ও মো. আবছারের সুস্পষ্ট ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ঘটনার দুই মাস পর প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘এখনো গ্রেপ্তার হয়নি চার অস্ত্রধারী’- শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ত্রধারীদের মধ্যে তিনজন খাগরিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. আকতার হোসেনের ও অপরজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. জসিম উদ্দিনের সমর্থক। আট অস্ত্রধারীকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। চিহ্নিত আট অস্ত্রধারীর সাতজনই ছিলেন নৌকার প্রার্থী আকতার হোসেনের পক্ষে। 

অস্ত্রধারীদের মধ্যে চারজন ধরা পড়ে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর  চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী সে সময় এর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ কাজে অবহেলা করছে, যার জন্য চিহ্নিত চারজনসহ আরও অনেক অস্ত্রধারী এখনো বাইরে রয়ে গেছে- এটা হতাশার। এই দায় তারা এড়াতে পারেন না। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- অভিযানের নামে নিরীহ লোকজনকে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশ না করে খাগরিয়ার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, অস্ত্র উদ্ধার ও অভিযানের নামে এলাকার নিরীহ লোকজনকে হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ চিহ্নিত অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও নিরীহ লোকজনকে হয়রানির বিষয়টি অস্বীকার করে পুলিশ।

এমন অসংখ্য ঘটনার ভিড়ে উক্ত ঘটনাগুলো সামান্য কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্রের মহড়া এবং প্রয়োগের ঘটনাতো হরহামেশাই দেখা যায়। কিছুদিন আগেও ঢাকা কলেজের সংঘর্ষের ঘটনায় নিরীহ মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। গণমাধ্যমের সামনে নিরীহ বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে মেরে ফেলার দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে।

দেড় বছর পর দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ভাষায়- আনুষ্ঠানিক না হলেও বাংলাদেশে যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া তা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মতো দেশে নির্বাচন নিয়ে কথা বললেই যে সহিংসতার কথা চলে আসে সেটা বোধ করি বেশ ভালোভাবেই জানেন পিটার হাসের পূর্বসূরি আর্ল মিলার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে রাষ্ট্রদূত হয়ে বাংলাদেশে আসা মিলার ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি?’ এই লেখকের এমন এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন ‘সব পক্ষকে অবশ্যই সহিংসতা এড়াতে এবং তার নিন্দা জানাতে হবে। সহিংসতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে তাদেরই লাভ হয় যারা গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করতে চায়। প্রত্যেক যোগ্য প্রার্থীর প্রচারণার সমান সুযোগ থাকা উচিত। প্রত্যেক যোগ্য ভোটারের নির্বাচনে সমান সুযোগ থাকতে হবে।’

একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের উৎস এবং রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষও চায় কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়া একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। পিটার হাসের ভাষ্য অনুযায়ী, যদি ইতিমধ্যেই দেশে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এখন থেকেই নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে যে কোনো ধরনের নির্বাচনী সহিংসতা এড়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর কে না জানে, নির্বাচনী সহিংসতার ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। সেক্ষেত্রে, দেশে অবৈধ অস্ত্রধারীদের সঠিক তালিকা করে দল মতনির্বিশেষে তাদের গ্রেপ্তার এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের কাজটি এখন থেকেই শুরু করতে হবে। 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status