নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
নির্বাচন নিয়ে সরব এশিয়া, শান্তির বার্তা আমেরিকার
তারিক চয়ন
৩ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবারদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যখন পরস্পর মারমুখী অবস্থানে ঠিক তখনই (৩১শে অক্টোবর, সকাল) সবাইকে অবাক করে দিয়ে নির্বাচন ভবনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস্। বৈঠক শেষে বরাবরের মতোই আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী নির্বাচন চাইলেও অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ খুঁজতে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানান
ঢাকার রাজপথে ব্যাপক সহিংসতা এবং হতাহতের জেরে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল-বিএনপি আয়োজিত ২৮শে অক্টোবর তথা গত শনিবারের মহাসমাবেশ প- হয়ে যায়। এর মাত্র দু’দিন পর (সোমবার) ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজ থেকে ‘কীভাবে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ইতিবাচক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে তা জানুন’ ক্যাপশনে ‘শেয়ার আমেরিকা’র ভিডিও সহ একটি লিংক শেয়ার করা হয়। উল্লেখ্য, দেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে শেয়ার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট’র একটি ওয়েব মাধ্যম যেখানে চিত্তাকর্ষক বিভিন্ন নিবন্ধ ও ছবির মাধ্যমে ধর্মীয় স্বাধীনতা, আইনের শাসন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, মানবিক মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে থাকে।
যাই হোক, শেয়ার আমেরিকার ওই ভিডিও’র শিরোনাম হলো- ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ক্ষমতা’। ‘মুক্ত গণতন্ত্রের সুস্থ অংশ হলো প্রতিবাদ করা’ লেখা ওই ভিডিওতে এক নারী কণ্ঠকে ইংরেজিতে যা বলতে শোনা যায় তা বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কি সত্যিই পার্থক্য গড়ে দিতে পারে? গবেষণা বলছে যে, ১৯০০ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে অহিংস আন্দোলনগুলো সহিংস প্রতিবাদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি কার্যকর ছিল। এমনকি নিপীড়নমূলক কর্তৃত্ববাদী পরিস্থিতিতেও প্রতিবাদকারীরা এভাবে তাদের প্রচারাভিযানকে সফল করতে পারে। যখন বড় মাপের, অহিংস জনগোষ্ঠীরা বর্জন বা ধর্মঘটের মতো বিক্ষিপ্ত পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি প্রতিবাদের মতো পদ্ধতিগুলোতে নিজেদের সংগঠিত করে তখন এমনকি সবচেয়ে নৃশংস শাসকদের ক্ষেত্রেও প্রতিরোধকে অনির্দিষ্টকালের জন্য দমিয়ে রাখতে সমস্যা হয়।
ভিডিওতে বলা হয়, ‘যেসব আন্দোলনের ক্ষেত্রে সহিংসতা বেছে নেয়া হয় সেগুলো প্রায়শই তাদের সমাজের জন্য ভয়ানক ধ্বংস ডেকে আনে, সেগুলোতে সাধারণত তাদের লক্ষ্যও অর্জিত হয় না। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে সমর্থন করার জন্য সাধারণ নাগরিকরা তাতে গিয়ে দাঁড়াবেন কিনা কিংবা বসে পড়বেন কিনা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অহিংস আন্দোলনে সব ধরনের মানুষই কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। লিঙ্গ, বয়স, জাতি, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই এতে অংশ নিতে পারে। আর তাই, অহিংস প্রতিবাদ সহিংস প্রতিবাদের চেয়ে গড়ে চারগুণ বেশি বড় হয়ে থাকে। যা আন্দোলনকারীদেরকে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি সংখ্যক জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার দিকে পরিচালিত করে। এটি যে কেবল সম্ভাব্য সংখ্যার সুবিধা তাই নয়, এতে কৌশলগত সুবিধাও রয়েছে। সহিংস অভ্যুত্থানগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শক্ত সামর্থ্য যুবকদের দ্বারা (সংঘটিত) হয়ে থাকলেও অহিংস প্রতিবাদে প্রায়ই নারী, পেশাজীবী, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব কিংবা বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও যুক্ত হন এবং সেটা নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক সহিংস ক্র্যাকডাউনের ঝুঁকিও হ্রাস করে। সুতরাং, আপনি যেখানেই থাকুন বা যে-ই হোন না কেন, অহিংস ‘সিভিল ডিজঅবিডিয়েন্স’- এর মাধ্যমে আপনার কণ্ঠস্বর শোনা যাবে। এর মাধ্যমে সকলের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। কারণ যাই হোক না কেন, সত্যিকারের সুশীল সমাজের নিশ্চয়তা প্রদানকারী এটাই একমাত্র উপায়।’
উক্ত ভিডিওর পর মার্কিন দূতাবাস শেয়ার আমেরিকার আরেকটি লিংক শেয়ার করে ক্যাপশন দেয়, ‘আমেরিকানরা সবসময় তাদের মতামত জানাতে একত্রিত হয়েছেন, এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেকোনো বিষয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার জন্য তার নাগরিকদের অধিকারকে সম্মান এবং রক্ষা করে। সমাবেশের অধিকার গণতন্ত্র ও আমেরিকানদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যা মানুষকে দল গঠন, ধারণা বিনিময় এবং মানবাধিকারকে মূল্য দেয় এমন একটি স্থিতিশীল সমাজ গঠনে অবদান রাখতে ভূমিকা রাখে।’ ওই লিংক ক্লিক করলে ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারে- এবং আমেরিকায় এটাই রীতি’ শিরোনামে লেখা রয়েছে, ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ আমেরিকায় আদর্শ নীতি। যদিও এমনকি বেশির ভাগ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের সময়ও সংবাদ শিরোনামগুলো সর্বদা যেকোনো সহিংসতার উপরই ফোকাস করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রেরও অহিংস এবং অত্যন্ত কার্যকর প্রতিবাদের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ আমেরিকার কিছু উল্লেখযোগ্য সামাজিক সংস্কারের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ না করলে ১৯২০ সালে অর্জিত নারীদের ভোটাধিকার এবং ১৯৬০-এর দশকের যুগান্তকারী নাগরিক অধিকার আইন বাস্তবায়িত হতো না। বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ঐতিহ্য আজকের বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা বিশ্বে জীবন্ত এবং এটা ভালো।’ সবশেষে লেখা আছে, ‘সমাবেশের অধিকার গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এটি আমেরিকানদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার সম্প্রসারণ। সমাবেশ বা প্রতিবাদ, মানুষকে দল গঠন করতে এবং ধারণা বিনিময় করার সুযোগ করে দেয় এবং স্থিতিশীল সমাজ গঠনে অবদান রাখে যে সমাজ মানবাধিকারকে মূল্য দেয়। আন্তর্জাতিকভাবে, মার্কিন সরকার মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের মূল্যবোধের দ্বারা প্রত্যেকের সুরক্ষিত হওয়া উচিত এই বিশ্বাস নিয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক কাজ করে থাকে।’
সহিংস আন্দোলনকে নিরুৎসায়িত এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে উৎসাহিত করে মার্কিন দূতাবাসের উপরোক্ত পোস্টদ্বয়ের মাঝে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, কোরিয়া, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটি যৌথ বিবৃতি পোস্ট করেছে দূতাবাস। ওই বিবৃতিতেও রয়েছে সহিংসতা পরিহার এবং শান্তির বার্তা৷ বিবৃতিতে ‘গত ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় রাজনৈতিক সমাবেশের সময়় সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ এবং হতাহতের জন্য সমবেদনা’ জানিয়ে ‘অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে সকল অংশীজনকে সংযম প্রদর্শন, সহিংসতা পরিহার এবং একযোগে কাজ করার আহ্বান’ জানানো হয়।
এখানে লক্ষণীয় যে, পশ্চিমা দেশগুলো আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার আহ্বান জানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের যৌথ বিবৃতি দিয়ে আসলেও এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এশিয়ার দুই দেশ জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। দুটি দেশই অর্থনৈতিক দিক থেকে এশিয়া তো বটেই, গোটা বিশ্বেও একেবারে সামনের কাতারে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে এশিয়া। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় জাপান- কোরিয়া উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তবে, এর আগে বিভিন্ন সময় জাপান বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কথা বললেও দক্ষিণ কোরিয়া কখনো কিছু বলেনি।
ঢাকা ত্যাগের আগে বাংলাদেশে দীর্ঘ তিন বছর দায়িত্ব পালন করা দক্ষিণ কোরিয়ার বিদায়ী রাষ্ট্রদূত লি জ্যাং-কিউন এই লেখকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় (১৮ই মে, মানবজমিনে প্রকাশিত) নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সরকার এবং জনগণের ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আশা করি, বাংলাদেশের ভালোর জন্য তারা সঠিক সিদ্ধান্তটিই গ্রহণ করবেন।’
২৮শে অক্টোবরের উত্তাপ যখন ঠাণ্ডা হয়নি, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যখন পরস্পর মারমুখী অবস্থানে ঠিক তখনই (৩১শে অক্টোবর, সকাল) সবাইকে অবাক করে দিয়ে নির্বাচন ভবনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস্। বৈঠক শেষে বরাবরের মতোই আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী নির্বাচন চাইলেও অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ খুঁজতে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানান।
বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট হতে উত্তরণে বিভিন্ন সময় বিবদমান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা উত্থাপিত হলেও ‘বিএনপি শর্ত দিয়ে সংলাপ করতে চায়, শর্ত দিয়ে সংলাপ হয় না’ এই যুক্তিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেহেতু বারবার সংলাপের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছিল সেহেতু ‘শর্তহীন সংলাপে’ বসার জন্য সব পক্ষের প্রতি রাষ্ট্রদূতের আহ্বানকে খুব স্বাভাবিকভাবেই স্বাগত জানিয়েছিলেন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক নির্বিশেষে সকল শান্তিকামী জনগণ। সহিংসতা এড়িয়ে যারা রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চান, তারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন এই ভেবে যে, এবার বুঝি কিছু হলো! এই বুঝি আওয়ামী লীগ-বিএনপি একসঙ্গে বসে শান্তিপূর্ণভাবে একটা সমাধান খুঁজে বের করলো!
কিন্তু, সে আশায় গুড়েবালি! শান্তিকামী জনগণের সকালের ওই আশা সন্ধ্যা না গড়াতেই দুরাশায় পরিণত হয়! ওইদিন বিকালে সংলাপের তাগিদ দিয়ে পিটার হাস্-এর বক্তব্য উল্লেখ করে জনৈক সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি সংলাপের সম্ভাবনা সাফ নাকচ করে দিয়ে বলেন, “যারা খুন করছে তাদের সঙ্গে ডায়ালগ করতে বলে, ট্রাম্প সাহেবের সঙ্গে কী বাইডেন ডায়ালগ করেছে? যেদিন ট্রাম্প সাহেব আর বাইডেন ডায়ালগ করবে, সেদিন আমিও ডায়ালগ করবো’ (বিবিসি বাংলা)।