নির্বাচিত কলাম
চলতি পথে
‘হামাস’ কেন মরিয়া, কার লাভ কার ক্ষতি?
শুভ কিবরিয়া
২৫ অক্টোবর ২০২৩, বুধবারফিলিস্তিন জনগণের ন্যায্য দাবিকে মানার বদলে ইসরাইল সেটা ধ্বংস করতে নানাভাবে যুদ্ধ-গণহত্যা-ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। হামাসের এই নতুন আক্রমণ ইসরাইলের পুরনো নীতিকেই পুষ্ট করবে। আর সীমাহীন দুর্ভোগ, ধ্বংস, প্রাণহানির মধ্যে পড়বে ফিলিস্তিনের জনগণ। এই ঘটনার পর বিপুলভাবে লাভবান হবে বিশ্বব্যাপী প্রভুত্ব করা সমরাস্ত্র ব্যবসায়ী লবিটি। জ্বালানি রাজনীতিতেও নতুন একটা চেহারা দেখা দেবে। সৌদি আরব তার জ্বালানি নিয়ে আমেরিকার প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়বার যে উদ্যোগ নিয়েছিল তাতে বাধা পড়বে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের পর জ্বালানির দাম যে স্বস্তিকর অবস্থায় ছিল, সেটা আর থাকবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়তে পারে। অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়বে। ইসরাইলের বর্বরতা বাড়বে সীমাহীন, বাধাহীনভাবে। অপরিসীম দুর্ভোগ বাড়বে নিরীহ ফিলিস্তিন জনগণের। ইরান, আমেরিকা, রাশিয়ার লাভ হলেও কিছুটা বেকায়দায় পড়বে সৌদি আরব। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশের মতো জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলোর অর্থনীতি আরও চাপের মধ্যে পড়বে। ইসরাইলি বর্বরতা যত বাড়বে, অস্থির হয়ে উঠবে মধ্যপ্রাচ্য। তার প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও
ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন ‘হামাস’ কি এমন জাদুর কাঠি হাতে পেলো যে, হঠাৎ করে ইসরাইলের সকল প্রযুক্তি আর নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে এমন এক সফল আক্রমণ তৈরি করতে পারলো? খোদ ইসরাইলের ভেতর ঢুকে গেরিলা কায়দায় সফল আক্রমণ আর রকেট হামলা চালিয়ে ইসরাইলের গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারলো? যে ইসরাইল গোটা পৃথিবীতে গোয়েন্দা আর সার্ভিলেন্স বা আড়িপাতার যন্ত্রপাতি সাপ্লাই দিয়ে একচেটিয়া বাণিজ্য চালাচ্ছে, বহু দেশে বহু কর্তৃত্ববাদী শাসককে জিইয়ে রেখেছে গোয়েন্দা সমরাস্ত্র সরবরাহ করে, তারাই হঠাৎ হামাসের আক্রমণ রুখতে পারলো না? বিষয়টা একটু কী সন্দেহ জাগায় না! বছরের পর বছর ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ডে যে নরহত্যা-গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল, খোদ আমেরিকা আর পশ্চিমা মিত্রদের প্রত্যক্ষ মদতে, সেখানে মৌমাছির চাকে ঢিল ছুড়ে কয়েকশত ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিক হত্যার খবরে একটা সাময়িক তৃপ্তি হয়তো আছে, কিন্তু সমস্যাটির নতুন ডাইমেনশন সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলছে নতুন করে। আসুন খেয়াল করা যাক ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের কথিত হামলার পর কি কি ঘটছে
ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাস কর্তৃক বেসামরিক হত্যার খবর চাউর হবার পর, পশ্চিমা বিশ্বসহ বহুদেশের নৈতিক ও সামরিক সহানুভূতি পেয়েছে ইসরাইল। খোদ আমেরিকা তার নতুন অস্ত্র সরবরাহ নিশ্চিত করেছে ইসরাইলে। ভারত জোর ঘোষণায় ইসরাইলের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
এই ঘটনার পর ইসরাইল গাজায় হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইসরাইলের এই বর্বর পরিকল্পনা এমনই নিষ্ঠুর যে, ফিলিস্তিনের গাজায় কয়েক দিন ধরে চলমান অবরোধ এবং বিরামহীন ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘যুদ্ধেরও একধরনের নৈতিকতা রয়েছে। এ ধ্বংসযজ্ঞ যুদ্ধের নৈতিকতাবিরোধী।’ তিনি বলেছেন, ‘প্রতিটি যুদ্ধের নীতি-নৈতিকতা আছে। সপ্তাহজুড়ে গাজায় যা চলছে, তাতে নৈতিকতার মারাত্মক লঙ্ঘন হচ্ছে।’
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তৈরির যে নৈতিক আবেদন তৈরি হচ্ছিল বিশ্বব্যাপী সেই দৃষ্টি ঘোরানোর একটা কূটকৌশল পেলো নতুন করে ইসরাইল।
কেন এমন করলো
এখন প্রশ্ন হলো, হামাসের এই আক্রমণের প্রত্যুত্তর যে ইসরাইল আরও নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার সঙ্গে দেবে, সেই অনুমান কি হামাসের ছিল না? হামাস কি সে সম্পর্কে অবহিত নয়? অবশ্যই অবহিত। তাহলে হামাস এইরকম সিদ্ধান্ত নিলো কেন?
হতে পারে হামাস জেনেশুনেই ফিলিস্তিন বিদ্রোহের একটা নয়া আগুন আবার জ্বালাতে চেয়েছে। অথবা ফিলিস্তিনের যেসব রাজনৈতিক পক্ষ আছে যারা হামাসের সশস্ত্র আন্দোলনের নীতির বিরোধী, তাদেরকে কোণঠাসা করে হামাসের চিন্তার প্রাধান্যকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। এখন ইসরাইল যত বর্বর হবে ফিলিস্তিনের লড়াইয়ের সশস্ত্র আকাক্সক্ষা তত জোর পাবে। সেটা আখেরে হামাসের রাজনীতিকেই পুষ্ট করবে।
ইরানের হিজবুল্লাহ হামাসের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ইরানের একটা রাজনৈতিক-সামরিক সমর্থন পাচ্ছে হামাস। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমেরিকার নানান চাপে আছে ইরান। ইরানের অভ্যন্তরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে আমেরিকা-ইসরাইল। ফলে নতুন একটা সুযোগ হাতের কাছে কাজে লাগাতে হামাসকে ব্যবহার করেছে ইরান।
ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত্রুপক্ষ সৌদি আরব ও তার বন্ধুদের সঙ্গে নতুন মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুলছে। হালে সৌদি আরব-ইসরাইলের সম্পর্ক দারুণতর মিত্রতার দিকে এগুচ্ছে। ইসরাইল ও আরব দেশগুলোর কারও কারও সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে যে নতুন বাঁক বদল ঘটতে চলেছে, তাকে থামানোর জন্য হামাসকে ব্যবহার করে ইরান এই কাজ করেছে। অন্যদিকে ইরানের এই সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে হামাস ফিলিস্তিন প্রশ্নে বিশ্ববাসীর নতুন মনোযোগ আকর্ষণের জন্য এই মরণপণ লড়াইয়ের সূচনা করেছে।
রশিয়া এই ঘটনাপ্রবাহে সঙ্গতকারণেই আমেরিকার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। আরব রাজনীতিতে ও মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া এখন ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সেটা সিরিয়া যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে। আবার ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে দৃষ্টি সরানোর একটা সুযোগ হিসেবে এই নতুন ঘটনাকে কাজে লাগাতে পারে রাশিয়া। ফলে হামাস ইরানের মারফত রাশিয়ার সমর্থন পেয়ে সোৎসাহে এই কাজ করতে পারে।
কি ঘটতে পারে?
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না পরিণতি যাই হোক না কেন, হামাস, ফিলিস্তিন প্রশ্নে বিশ্ববাসীর বিশেষ করে মুসলমান জনগোষ্ঠীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে নতুন করে। প্রাণহানি-গণহত্যা-আর ইসরাইলি বর্বরতা এখন যত বাড়বে ফিলিস্তিন ইস্যু মৃত থেকে তত সজীব হয়ে উঠবে।
আরব দুনিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জ্বালানি রাজনীতির যে নতুন হালচিত্র, তাতে জ্বালানি উৎপাদন ও সরবরাহ প্রশ্নে সৌদি আরব-চীন-রাশিয়ার একটা নতুন মিত্রতা তৈরি হয়েছে। যেটা জ্বালানি প্রভুত্বে আমেরিকার কর্তৃত্ববাদকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই ঘটনায় সেই মিত্রতা নানা কারণে বিঘিœত হতে পারে। ফলে, এখানে আমেরিকার একটা সাক্ষাৎ লাভ আছে।
সমরাস্ত্র ব্যবসার জন্য আমেরিকার দরকার যুদ্ধ বাণিজ্য। ইউক্রেনে সেটা সচল আছে। ইসরাইলকে সুরক্ষার প্রশ্নে আমেরিকার সমর বাণিজ্যের নতুন ফ্রন্ট আরও সক্রিয় হয়ে উঠবে।
রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ চাপিয়ে নানারকম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটে আছে। ইউক্রেন ঘটনাকে পুঁজি করে আমেরিকা রাশিয়াকে নানা চাপে রেখেছে। ফলে, রাশিয়ার দরকার ছিল ইউক্রেন দৃষ্টি ঘোরানো একটা নতুন যুদ্ধের ফ্রন্ট। হামাস সেই সুযোগ এনে দিলো। ইরানের মাধ্যমে এমনকি প্রত্যক্ষভাবে এই নতুন ফ্রন্টকে জিইয়ে রাখতে রাশিয়া যারপর নাই চেষ্টা চালাবে। এখানে রাশিয়া রাজনৈতিকভাবে তো বটেই সমরাস্ত্র বাণিজ্য বিবেচনাতেও লাভবান হবার চেষ্টা করবে।
ইসরাইলের অভ্যন্তরে কট্টরপন্থিরা এই ঘটনার পর নতুনভাবে জেগে উঠবে। আলাপ আলোচনার বদলে দমন-পীড়ন নীতির মাধ্যমে ফিলিস্তিন ইস্যু মোকাবিলার পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন বাড়বে। ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সমরাস্ত্র খাতে ব্যয় বাড়ানোর লবিটি আরও শক্তিমান হয়ে উঠবে।
একদিকে রাশিয়া-ইরান, অন্যদিকে ইসরাইল-আমেরিকা, আরেকদিকে সৌদি আরব, কাতার, মিশর-এসব বহুমাত্রিক বলয় নিজ নিজ স্বার্থ বজায় রাখার জন্য ফিলিস্তিন ইস্যুকে নতুন করে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে।
ফিলিস্তিনের জনগণ ও লড়াইরত পক্ষগুলোর মধ্যে যারা রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনাকে প্রাধান্য দিতে চান, তাদের চাইতে সশস্ত্রভাবে লড়াই চালানোর পক্ষের গ্রুপগুলো আরও সক্রিয় হয়ে উঠবে।
সমাধান না রক্তপাত
ফিলিস্তিন জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমাবিশ্ব কখনোই সুবিচার করে নাই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেদের স্বার্থকে ফিলিস্তিন জনগণের স্বাধীনতার প্রশ্নের চেয়ে বড় করে দেখেছে। ফিলিস্তিনের জনগণের মধ্যেও ইসরাইলি স্বার্থ সুরক্ষার জন্য লবি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তারা নানা চেহারায়। ফলে ফিলিস্তিন জনগণের ন্যায্য দাবিকে মানার বদলে ইসরাইল সেটা ধ্বংস করতে নানাভাবে যুদ্ধ-গণহত্যা-ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। হামাসের এই নতুন আক্রমণ ইসরাইলের পুরনো নীতিকেই পুষ্ট করবে। আর সীমাহীন দুর্ভোগ, ধ্বংস, প্রাণহানির মধ্যে পড়বে ফিলিস্তিনের জনগণ।
এই ঘটনার পর বিপুলভাবে লাভবান হবে বিশ্বব্যাপী প্রভুত্ব করা সমরাস্ত্র ব্যবসায়ী লবিটি। জ্বালানি রাজনীতিতেও নতুন একটা চেহারা দেখা দেবে। সৌদি আরব তার জ্বালানি নিয়ে আমেরিকার প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়বার যে উদ্যোগ নিয়েছিল তাতে বাধা পড়বে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের পর জ্বালানির দাম যে স্বস্তিকর অবস্থায় ছিল, সেটা আর থাকবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়তে পারে। অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়বে।
ইসরাইলের বর্বরতা বাড়বে সীমাহীন, বাধাহীনভাবে। অপরিসীম দুর্ভোগ বাড়বে নিরীহ ফিলিস্তিন জনগণের। ইরান, আমেরিকা, রাশিয়ার লাভ হলেও কিছুটা বেকায়দায় পড়বে সৌদি আরব। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশের মতো জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলোর অর্থনীতি আরও চাপের মধ্যে পড়বে। ইসরাইলি বর্বরতা যত বাড়বে, অস্থির হয়ে উঠবে মধ্যপ্রাচ্য। তার প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।