নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
ইমরানকে কারাগারে রেখে পাকিস্তানে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে?
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
২৪ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার
নওয়াজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জেলে তাই তারা সন্দেহ করতেই পারে যে দেশে ফেরা নিয়ে নওয়াজ শরীফ বা তার দল সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করেছে। তবে উভয় পক্ষই এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। নওয়াজ শরীফ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে পিএমএলএনের একজন শীর্ষ নেতা পাকিস্তানের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সভাপতি বিলাওয়াল ভুট্টোকে আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছেন
নওয়াজ শরীফ। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এক সময় তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর ঘোর বিরোধী। তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ও পরে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ। তারপর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজের (পিএমএলএন) প্রধান নওয়াজ শরীফ। কিন্তু এবারো তার কপাল ভালো যায়নি। তখনকার বিরোধী দল তার বিরুদ্ধে কয়েকমাস ধরে রাজধানী ইসলামাবাদে অবরোধ ডাকে। অবশেষে নিজের ছেলের কোম্পানি থেকে অঘোষিতভাবে বেতন নেয়ার অভিযোগে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন নওয়াজ শরীফ। আইনি ধারাবাহিকতায় তিনি বাধ্য হন জেলে যেতে। কিছুদিন জেল খাটার পর চিকিৎসার নামে উড়াল দেন লন্ডনে। এটাকে স্বেচ্ছানির্বাসন হিসেবে পরে উল্লেখ করা হয়েছে। গত চার বছর ধরে তিনি লন্ডনে অবস্থান করেন। এ সময়ে সেখানেই তার স্ত্রী কুলসুম নওয়াজ মারা যান। নওয়াজ শরীফ আস্তে আস্তে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান। তবে এই নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত আছে।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা বার বার রিপোর্ট করেছে এই নির্বাচনে ইমরান খানকে ক্ষমতায় আনতে সেনাবাহিনী মোক্ষম ভূমিকা পালন করেছে। তবে এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন ইমরান খান। শেষ পর্যন্ত যে সেনাপ্রধান জাভেদ কমর বাজওয়া তাকে ক্ষমতায় এনেছিলেন বলে বলা হয়, তার সঙ্গেই ইমরান খানের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যা হয়, তাই হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে টিকে থাকতে পারেননি ইমরান খান। গত বছর এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। এ জন্য ইমরান খান সরাসরি দায়ী করেন সাবেক ওই সেনাপ্রধানকে। পাকিস্তানের রাজনীতি এক জটিল বলয়ে আবর্তিত। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর বেশির ভাগ সময় এর ক্ষমতা ভোগ করেছে সেনাবাহিনী। বার বার নির্বাচিত সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে নিজেরা ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে এসেছে। ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পার্লামেন্টের অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) জোট। এর প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরীফের ছোট ভাই শেহবাজ শরীফ।
এই সরকারকে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় বসিয়েছে বলে অভিযোগ ইমরান খানের। বার বার তিনি সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করেছেন। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যেমন সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন, তেমনি সরকার প্রতিষ্ঠায়ও সেনাবাহিনীকে দায়ী করেন। এ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিডিয়া উইং ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসপিআর) বিষয়টি পরিষ্কার করে বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়। তারা জানায়, তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা ভিত্তিহীন। যে যা-ই বলুন না কেন, শেহবাজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পেছনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল এ নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে মিডিয়ায়। শেহবাজ প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা, সমঝোতার দরজা খুলে যায়। ফলে তিনি দেশে যেমন দৌড়ঝাঁপ করতে থাকেন, তেমনি ঘন ঘন লন্ডন উড়ে যান বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক কৌশল কী হবে তা জানতে। বলা হয়, লন্ডন থেকে তাকে পরিচালনা করেছেন নওয়াজ শরীফ। তাকে দেশে ফেরার সব পথও তিনিই করেছেন। ফলে নওয়াজ শরীফের ওপর সেনাবাহিনীর নরম দৃষ্টি আছে- এ কথা বলা যায়।

দেশটিতে এ বছর জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু সেই নির্বাচন বিলম্বিত করে আগামী বছর নিয়ে যাওয়া হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ২১শে অক্টোবর দেশে ফিরে তাতেই সম্মতি দিয়েছেন নওয়াজ। তার দল ঘোষণা দিয়েছে আগামী প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হবেন নওয়াজ। কিন্তু ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিককে বেশ কিছু ইস্যুর সমাধান করতে হবে। দেশে অর্থনৈতিক সংকট চরম। এর জন্য তার দলকে দায়ী করা হয়। কারণ, তারা সর্বশেষ ক্ষমতায় ছিল। এ ছাড়া ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। কারণ, নির্বাচনে প্রধান বিরোধী পক্ষ পিটিআইয়ের প্রধান ইমরান খান কারাবন্দি। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার এর আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, আদালত যদি ইমরান খানকে নির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাহলে তার কিছু করার থাকবে না। এ কথার মধ্যদিয়ে তিনি একটি ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আগ বাড়িয়ে তিনি যখন বলেছেন, ইমরান খানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তার কিছু করার থাকবে না।
তার অর্থ তিনি আগেভাগে আঁচ পেয়েছেন এ বিষয়ে। ফলে ইমরান খানকে জেলে আটকে রেখে যদি নির্বাচন করা হয়, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেবে। ৯ই মে’র সহিংসতার পর পিটিআইকে ব্যাপকভাবে দমনপীড়ন করা হয়েছে। ফলে ৯ই মে যেসব নেতাকর্মী ইমরান খানের জন্য জান দিয়ে দেবেন বলে মনে হয়েছিল, তাদের এখন আতশি গ্লাস দিয়ে খুঁজে পাওয়াও কঠিন। উপরন্তু ইমরান খানের খুবই ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা তাকে ছেড়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আলাদা দল করার চেষ্টা করছেন। এসবের মধ্যদিয়ে পিটিআই, তথা ইমরান খানকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। তারপর আছে শক্তিধর সেনাবাহিনী। পাকিস্তান কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে তাদের বড় চাওয়া আছে। নওয়াজ শরীফ রাজনীতিতে ফিরলে এবং প্রধানমন্ত্রী যদি হতে পারেন, তাহলে তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলাতে হবে। অথচ তিনি যখন বিদেশে ছিলেন, তখন মাঝে মধ্যেই সেনাবাহিনীর কড়া সমালোচনা করেছেন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য সে সময়ে তিনি আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান এবং সাবেক সেনাপ্রধানকে দায়ী করেছিলেন। নওয়াজ শরীফ বলেছিলেন, তিনি ভুয়া মামলার শিকার।
দেশের বিচারকরাও দূষিত হয়ে পড়েছেন বলে তিনি অভিযুক্ত করেছিলেন। তার ভাষায় এ কারণে গণতন্ত্র ভেঙেচুরে গেছে। তাই পাকিস্তানে নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেন না।
এখন যেহেতু নওয়াজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জেলে তাই তারা সন্দেহ করতেই পারে যে দেশে ফেরা নিয়ে নওয়াজ শরীফ বা তার দল সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করেছে। তবে উভয় পক্ষই এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। নওয়াজ শরীফ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে পিএমএলএনের একজন শীর্ষ নেতা পাকিস্তানের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সভাপতি বিলাওয়াল ভুট্টোকে আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, আগামীর প্রধানমন্ত্রী হবেন নওয়াজ শরীফ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশা করে থাকতে পারেন বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। তাই তাকে অনুরোধ করেছেন, অপেক্ষায় থাকতে। ওদিকে ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের নেতা জুলফি বুখারি বলেছেন, নওয়াজ শরীফ আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে আমি মনে করি না। কারণ, তার বিরুদ্ধে এখনো মামলা আছে। তিনি আদালতের নির্দেশে যাবজ্জীবনের জন্য রাজনীতিতে অযোগ্য হয়েছেন। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, পরিস্থিতি নওয়াজের পক্ষে যাবে।
তিনি রাজনীতিতে সুবিধা পাবেন এবং আগামীর প্রধানমন্ত্রী হবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াজাহাত মাসুদ বলেছেন, আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্র ও গতিধারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক চরিত্র পরিবর্তন হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এস্টাবলিশমেন্ট সুবিধা দিয়েছিল ইমরান খানকে। কিন্তু এ সময়ে সেনাবাহিনী নওয়াজের জন্য নির্বাচন করতে ব্যস্ত। তবে এমন দাবির বিষয়ে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী কোনো কথা বলেনি। ইমরান খান ও সেনাবাহিনী সব সময়ই গোপন আঁতাতের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। পিটিআইয়ের নেতা জুলফি বুখারি বলেছেন, এখনো নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। অনেক দল এ মতের সঙ্গে একমত। তিনি প্রশ্ন রাখেন কীভাবে আপনারা নির্বাচনের আগে সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন নেতাকে জেলে আটকে রাখতে পারেন? যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান, তাহলে আপনাদেরকে দেখতে হবে ইমরান খানের ভোট ব্যাংক কতো শক্তিশালী।