নির্বাচিত কলাম
খোলা কলম
কেমিক্যাল আলীর ফিরে আসা
এহ্সান মাহমুদ
১৯ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার২০০৯ সালের ১৩ই মে রাশিয়ার সঙ্গে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে প্ল্যান্টের প্রথম ইউনিট এবং ২০২৫ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হতে পারে। আমরা এই প্রকল্পের চুক্তিতে দেখতে পাচ্ছি-‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে তিনি যেভাবে বলছেন- ‘বিএনপি নেতাদের মাথায় ঢেলে ঠাণ্ডা করে’ দেয়া হবে, সেটি কি শান্তিপূর্ণ থাকার বার্তা দিচ্ছে?
পারমাণবিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের রাজনীতিকদের এমন বক্তব্য কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ রাজনীতির বার্তা হতে পারে না। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য পারমাণবিক ব্যবহারের হুমকি তাই সাধারণ ছেলেখেলা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই
বিষয়টা ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীতের মতো মনে হতে পারে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইরাকের কেমিক্যাল আলী!
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের আমলে টেলিভিশনের খবরে তাকে দেখা যেতো। মোহাম্মদ সাঈদ আল সাহাফ। লম্বা গড়ন। শরীরে জলপাই রঙের সামরিক পোশাক। কোমরে পিস্তল। ইরাকের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী। বাগদাদে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে নিয়মিত ব্রিফ করতেন তিনি। সেই সময়ে অনেকেই টিভির সামনে সাঈদ আল সাহাফের বক্তব্য শুনে আশাবাদী হতেন, মনে পড়ে? বিশেষ করে, এখানেও ইরাকের নেতা সাদ্দামের ভক্ত-অনুরাগীর সংখ্যা কম ছিল না। যুদ্ধের সময়ে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা প্রচারণা- এটা যাচাই করাও একটি বড় ঝক্কির কাজ। যুদ্ধাকালীন পরিস্থিতিতে তাই প্রচারমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ থাকাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেখানে ইরাকের খোদ তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ঘিরে বিশ্বজুড়েই একটা আগ্রহ দেখা দিয়েছিল। প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি সংবাদমাধ্যমের সামনে হাজির হতেন। তার বক্তব্য সত্য কি মিথ্যা- সেসব অবশ্য অল্পদিন পরেই প্রমাণ হয়েছিল। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তার রোজকার বক্তব্য বেশ চমক জাগাতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী ইরাকের রাজধানী বাগদাদে প্রবেশ করার পরেও সাহাফ দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, পুরো বাগদাদ শহরে একটিও বিদেশি সৈন্য নেই। সব বাকোয়াস। উল্টো তিনি মার্কিন বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, এটাই ভালো উপায়। না হলে আমরা তাদের কচুকাটা করবো। পরে দেখা গেল তার বক্তব্য মিথ্যা ছিল। এত বছর পরেও যেটি সবচেয়ে কৌতুককর মনে হতে পারে সেটি হচ্ছে- সেই সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনীর বাগদাদ অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হওয়ার পরে সাহাফ বলেছিলেন, ‘ওটা হলিউডের মুভির দৃশ্য।’
সেই সময়ে যারা ইরাক যুদ্ধের খোঁজখবর রাখতেন তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন, মার্কিন মিডিয়া মোহাম্মদ সাঈদ আল সাহাফের নাম দিয়েছিল ‘বাগদাদ বব’। অপরদিকে বৃটিশ মিডিয়া তাকে চিহ্নিত করেছিল ‘কেমিক্যাল আলী’। আলী হাসান আল মজিদ নামে ইরাকের এক জেনারেল কুর্দি জনগোষ্ঠীর ওপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের আদেশ দিয়েছিলেন বলে সেই সময়ে খবরে প্রকাশ পেয়েছিল। অবশ্য সেটি চরম বিতর্কিত বিষয় ছিল। এরপর থেকেই তাকে ‘কেমিক্যাল আলী’ নাম দেয়া হয়েছিল। কেমিক্যাল আলী থেকে সাহাফের নামও দেয়া হয় কেমিক্যাল আলী। সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রতিদিন এমন সব আত্মবিশ্বাসে ভরপুর বক্তব্য তিনি দিতেন যে, অনেক নিরীহ ইরাকির সঙ্গে বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ইরাকের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষরাও মনে করতেন বাগদাদের পতন হবে না। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী ২০০৩ সালের ৯ই এপ্রিল বাগদাদের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরে অনেকের কাছে খবরটি বিস্ময়কর মনে হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতায় সেটা মোটেও বিস্ময়কর কিছু ছিল না।
এইবার মূল ঘটনায় আসা যাক। ইরাক যুদ্ধের পর থেকে ইরাকের কেমিক্যাল আলীর খবর পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেমিক্যাল নিয়ে বেশ হইচই শুরু হয়েছে। এর শুরুটা অবশ্য করেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একইসঙ্গে তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। গত ৯ই সেপ্টেম্বর ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “বিএনপি নাকি অক্টোবরে ঢাকা অচল করে দেবে। ঢাকা অচল করতে এলে নিজেরাই অচল হয়ে যাবে, ঢাকাবাসী তাদের অচল করে দেবে। তারা নাকি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেবে। বেশি লাফালাফি, নাচানাচি করতে এলে রাশিয়ার ইউরেনিয়াম মাথায় ঢেলে ঠাণ্ডা করে দেবো।” রাজধানী ঢাকার গাবতলী এলাকায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ আয়োজিত শান্তি সমাবেশে এ কথা বলেছেন ওবায়দুল কাদের।
ক্ষমতাসীন দলের নেতার এমন মন্তব্যের জবাবে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন-“ওবায়দুল কাদের প্রত্যক্ষভাবে বিএনপি নেতাদের হত্যার হুমকি দিয়েছেন। ইরাকে এক মন্ত্রী ছিলেন। তার নাম আলী। মনে করা হতো বিষাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র বানানোর ক্ষেত্রে উনি তত্ত্বাবধান করেছেন। তাই তাকে সবাই ‘কেমিক্যাল আলী’ নামে ডাকতো। বাংলাদেশেও একজন ‘কেমিক্যাল কাদেরের’ উদয় হয়েছে।” ১০ই অক্টোবর দুপুরে বগুড়া জেলা বিএনপি’র নবনির্বাচিত কমিটির নেতাদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ফাতেহা পাঠের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নর জবাবে এই কথা বলেন রিজভী।
রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় প্রধান যখন প্রতিপক্ষকে রাসায়নিক ঢেলে ‘ঠাণ্ডা’ করে দেয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে থাকেন, তখন সেটি আর নিছক কথার কথা থাকে না। অতীতে এমন কথার জন্য মামলা এবং গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার নজিরও আছে। আমরা স্মরণ করতে পারি, গত ১৯ই মে রাজশাহী জেলার পুঠিয়ার শিবপুরে রাজশাহী জেলা ও মহানগর বিএনপি’র আয়োজনে একটি সমাবেশ হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জেলা বিএনপি আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ। সেখানে তার দেয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘হত্যার হুমকি’ দেয়ার অভিযোগ সম্পর্কিত একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। এ নিয়ে বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদের বিরুদ্ধে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একডজনেরও বেশি মামলা হয়। এরপর থেকে আটক হয়ে তিনি কারাগারে আছেন।
এইবার আমরা তাকাতে পারি ওবায়দুল কাদেরের ‘ইউরেনিয়াম ঢেলে ঠাণ্ডা’ করার দিকে। সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরেনিয়ামের চালান গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতিতে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে (গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনি) রুশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রোসাটম তেজস্ক্রীয় জ্বালানি হস্তান্তর করে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের পারমাণবিক জ্বালানি ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান ২৮শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়। রাশিয়া থেকে একটি বিশেষ এয়ার কার্গোর মাধ্যমে ইউরেনিয়ামের চালানটি ঢাকায় এসে পৌঁছায়। পরদিন কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সড়ক পথে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাশিয়ার নভোসিবির্সক কেমিক্যাল কনসেনট্রেট প্ল্যান্টে (এনসিসিপি) এই জ্বালানি উৎপাদিত হয়, যা রোসাটমের জ্বালানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তেভেলের সহায়ক প্রতিষ্ঠান। রুশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রোসাটম ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিটে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লি ২০২১ সালের অক্টোবরে এবং দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য চুল্লি ২০২২ সালের অক্টোবরে বসানো হয়। সরকার ২০০৯ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের ধারণাটি হাতে নেয় এবং ২০০৯ সালের ১৩ই মে রাশিয়ার সঙ্গে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে প্ল্যান্টের প্রথম ইউনিট এবং ২০২৫ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হতে পারে।
আমরা এই প্রকল্পের চুক্তিতে দেখতে পাচ্ছি-‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে তিনি যেভাবে বলছেন- ‘বিএনপি নেতাদের মাথায় ঢেলে ঠাণ্ডা করে’ দেয়া হবে, সেটি কি শান্তিপূর্ণ থাকার বার্তা দিচ্ছে?
পারমাণবিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের রাজনীতিকদের এমন বক্তব্য কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ রাজনীতির বার্তা হতে পারে না। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য পারমাণবিক ব্যবহারের হুমকি তাই সাধারণ ছেলেখেলা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।