নির্বাচিত কলাম
পাচার হওয়া ‘কালো’ টাকা ‘ভালো’ হলে...
শুভ কিবরিয়া
১৭ জুন ২০২২, শুক্রবার
প্রশ্ন হচ্ছে- দেশের আইন ও নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যারা পাচার করে টাকা দেশের বাইরে নিয়ে গেছেন, টাকা সেখানে সুরক্ষিত থাকলে, দেশে তারা ফেরত আনবেনই বা কেন? অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ‘টাকার একটি ধর্ম আছে। কেউ স্যুটকেসে করে টাকা নিয়ে যায় না। টাকা যেখানে বেশি সুখ পায়, সেখানে চলে যায়।’ সেটাই যদি সত্যি হয়, তাহলে বিদেশে পাচার করা টাকার কি এমন ‘অসুখ’ দেখা দিলো যে তার ঘরে ফেরার সম্ভাবনা তৈরির প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন সরকারকে প্রস্তুত করতে হচ্ছে?
কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলে চায়ের দোকানে লোক-আড্ডায় একটা মজার আলাপ একবার শুনেছিলাম। এক মুরব্বিই আলাপ প্রসঙ্গে সেটির অবতারণা করেছিলেন। বহু আগে এক গ্রামে এক লোক অনেক টাকা খরচ করে হজ করে এসেছেন। হাজী বাড়ি হিসেবেই তখন থেকে সবাই সে বাড়িকে চিনতো। একবার এই বাড়িতে এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলো। বাড়ির বড় ছেলে এক অসম প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে দূর-সম্পর্কের এক চাচিকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন। তখন থেকে বাড়ির নামই পরিবর্তন হয়ে গেল। যে মুরব্বি এই গল্প বলছিলেন তার ভাষায়, ‘বাপ হজ করে কত লোক চিনলো তার চেয়ে ছেলের এই অস্বাভাবিক কাজে বেশি লোক এই বাড়িকে চিনলো।’ এ লোককথা নতুন করে মনে পড়লো সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের পর।
গত ৯ই জুন ২০২২ বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ বৈধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। কর দিয়ে এসব অর্থ বৈধ হয়ে গেলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যেকোনো কর্তৃপক্ষ। সে বিধানও যুক্ত হয়েছে এই প্রস্তাবে। বাজেট বক্তৃতায় আয়কর অধ্যাদেশে নতুন এ বিধান যুক্ত করার প্রস্তাবের পক্ষে অর্থমন্ত্রীর যুক্তি হচ্ছে, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য একদিকে অধিক পরিমাণে রাজস্ব জোগান দিতে হবে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনতে হবে। এ অবস্থায় বিদেশে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ অর্থনীতির মূল স্রোতে আনার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রবাহ বৃদ্ধি হবে। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে ১০ শতাংশ ও বাংলাদেশে পাঠানো (রেমিটকৃত) নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ, কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ আনেন, তাহলে ৭ শতাংশ কর দিলেই হবে।
আর বিদেশে অবস্থিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে অবস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে এর ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। আগামী ১লা জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছরের জন্য এই সুবিধা বহাল থাকবে। ০২. স্বভাবতই অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণা নানা মহলকে বিস্মিত করেছে। অনেকেই এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়াও দিয়েছে। বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক- তিনভাবে অগ্রহণযোগ্য বলছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বাজেট পেশের পরদিনই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) আনুষ্ঠানিকভাবে এক বিবৃতিতে বলেছে, অর্থমন্ত্রী যেভাবেই ব্যাখ্যা করেন না কেন- নামমাত্র কর দিয়ে প্রশ্নহীনভাবে পাচার করা অর্থ বিদেশ থেকে আনার সুযোগ স্পষ্টতই অর্থ পাচারকারীদের অনৈতিক সুরক্ষা ও পুরস্কার প্রদান। অথচ অর্থপাচার রোধ আইন ২০১২ এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অর্থপাচার গুরুতর অপরাধ, দেশের আইন অনুযায়ী যার শাস্তি পাচারকৃত অর্থ বাজেয়াপ্ত করা এবং তার দ্বিগুণ জরিমানা ও ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড নির্ধারিত রয়েছে।
এই সুযোগ অর্থ পাচার তথা সার্বিকভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে, যা সংবিধান পরিপন্থি এবং প্রধানমন্ত্রীর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’ ঘোষণার অবমাননাকর। অন্যদিকে, যারা বৈধ উপার্জন নির্ভর করদাতা তাদের জন্য এই প্রস্তাব প্রকটভাবে বৈষম্যমূলক, কারণ তারা ৭ শতাংশের কমপক্ষে তিনগুণ হারে কর দিয়ে থাকেন। এটি বৈষম্য ও সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থি। এসব প্রতিক্রিয়ার প্রত্যুত্তরও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী ও সরকারি পক্ষ। বাজেট পেশের পরদিন যে প্রথাগত প্রেসমিট হয় সেখানে অর্থমন্ত্রী তার ঘোষণার পক্ষে শুধু সাফাইই গাননি, পাচার করা অর্থ ফেরত দিলে ফেরতকারীর সুরক্ষার কথাও জোর দিয়ে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নরওয়েসহ বিশ্বের ১৭টি দেশ এভাবে টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে। তার যুক্তি হচ্ছে, ‘পাচার হওয়া টাকা মানুষের হক।’ অর্থমন্ত্রী বরং সবার কাছে অনুরোধ করেছেন, টাকা ফেরত আনতে যাতে কেউ বাধা না দেয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবার যদি কেউ পাচার করা টাকা ফেরত আনে তবে তাদের ‘সংসদ অনুমোদিত আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা দেয়া হবে।’
সরকারের প্রভাবশালী নেতা ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক যুক্তি দিয়েছেন দেশে যেহেতু সাংবিধানিক সরকার আছে ফলে যারা টাকা ফেরত আনবেন, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। বোঝা যাচ্ছে পাচারকারীদের টাকা ফেরত আনতে সরকার সব রকম প্রটেকশন দিতে শক্ত অবস্থানই নিয়েছেন। উল্লেখ্য, ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। ০৩. পাচার করা টাকাকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে চাইছে কেন সরকার? অনেক রকম নৈতিক ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকার এই বিষয়টিকে এমন প্রকাশ্যে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে কেন? যেহেতু বাজেটে ‘পাচার করা’ টাকার সপক্ষে অর্থমন্ত্রী নীতিগত প্রস্তাবনা রেখেছেন, তাহলে বুঝতে হবে, সরকারের মধ্যে রাজনীতি ও অর্থনীতির ‘নীতি’ যারা প্রভাবিত করেন, তাদের শক্ত লবিরও এ বিষয়ে সমর্থন আছে। সরকার হয়তো ভাবছে, এর ফলে যদি পাচার করা টাকা ফিরে আসে, তাহলে অর্থনীতিতে যে সংকট তৈরি হচ্ছে বা হবে, তার একটা সমাধান এই পথে আসতে পারে। টাকা যখন দেশ থেকে বের হয়েই গেছে, তখন তার যেটুকু অংশই ফিরে আসুক না কেন, সেটাই তো লাভের কথা- এটা সরকারের একটা বিবেচনা হলেও হতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- দেশের আইন ও নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যারা পাচার করে টাকা দেশের বাইরে নিয়ে গেছেন, টাকা সেখানে সুরক্ষিত থাকলে, দেশে তারা ফেরত আনবেনই বা কেন? অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ‘টাকার একটি ধর্ম আছে। কেউ স্যুটকেসে করে টাকা নিয়ে যায় না। টাকা যেখানে বেশি সুখ পায়, সেখানে চলে যায়।’ সেটাই যদি সত্যি হয়, তাহলে বিদেশে পাচার করা টাকার কি এমন ‘অসুখ’ দেখা দিলো যে তার ঘরে ফেরার সম্ভাবনা তৈরির প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন সরকারকে প্রস্তুত করতে হচ্ছে? তাহলে কী যেসব ক্ষমতাবান মানুষেরা নানা অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছেন, সেখানে টাকার নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে বা দিতে পারে? বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব ‘পাচারকৃত দুর্বৃত্তায়িত লুটেরা’ অর্থের নিরাপত্তার কোনো সংকট তৈরির সম্ভাবনা কি তৈরি হতে পারে? তার আগাম আভাস পেয়েই কি, বাজেটে পাচার করা কালো টাকাকে ‘ভালো’ করার এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে? আপাতত এসব প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর নেই বটে, কিন্তু জনভাবনায় এসব প্রশ্নের উদ্রেক হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর বাইরেও সরকার বা রাষ্ট্রের যেকোনো কাজের একটা দার্শনিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক নিকট ও দূরগামী ফলাফল বা প্রভাব থাকে।
সে বিবেচনা বা দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা যায়, প্রথমত, যেকোনো আর্থিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক অনৈতিকতা যখন প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়, রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান অংশের আনুকূল্য পায়, তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্রের নিজের নৈতিকতার ভিত অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। যেকোনো রাষ্ট্রের নৈতিকতার ভিত যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন তার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতায় ধস নামে। রাষ্ট্রকে তা ভীষণভাবে দুর্বল করে তোলে। এই দুর্বলতার সুযোগে কোন কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংঘ সাময়িক সময়ের জন্য বিশেষ সুবিধা পেতে পারে হয়তো, কিন্তু যেকোনো সংকটে তাদের নিজেদের সুরক্ষাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। দ্বিতীয়ত, যেকোনো রাষ্ট্রিক সংকটে বা বিপণ্নতায় রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ হচ্ছে তার নৈতিক ও পেশাদার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা। সেটা যখন অনৈতিকতার চাপে দুর্বল ও নতজানু হয়, সংকটে তা দিশাহারা হয়ে পড়ে। সেটা ক্ষমতাবান ব্যক্তি-গোষ্ঠী-সংঘ-দল-প্রতিষ্ঠান সবাইকে আরও বড় বিপদের মধ্যে ফেলে দেয়। শুধু সংকটকালেই নয়, স্বাভাবিক সময়ে এই অনৈতিকতার বীজ এমনই আবহ তৈরি করে যে, রাষ্ট্র শক্তিমান-সুনীতিনির্ভর-জনকল্যাণমূলক কাজ করতে চাইলেও, তা কঠিন হয়ে পড়ে।
সবচাইতে বড় বিষয় যেটা ঘটে, সেটা হচ্ছে জনসন্দেহ তৈরি হয়। আস্থাহীনতার আবহ জনমনকে ঘিরে রাখে। জনদৃষ্টি তখন কেবল সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখে সরকার, রাষ্ট্রকে দেখতে থাকে। তৃতীয়ত, মানুষ যখন চোখের সামনে দেখতে পায় পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করলে আয়কর বেশি দিতে হয়, অন্যায়ভাবে উপার্জন করে দেশ থেকে টাকা পাচার করলে, কম আয়কর দিয়ে তা ‘সাদা’ ও ‘সৎ’ করা যায়, তখন সে নীতিগতভাবে একটা বিভ্রমে পড়ে। বহু বছরের অভিজ্ঞতায়, পরিবারে-সমাজে-শিক্ষায়তনে সে যাকে নৈতিক ও ভালো বলে শিখে এসেছে, সেটা তাকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। চিরায়ত ‘সৎ’ ও ‘সুন্দর’ বিষয়ে তার মধ্যে নতুন নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়। সে যখন দেখতে থাকে সরকার, রাষ্ট্র, সরকারি দল, সরকারের আস্থাভাজন বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী-জনসমাজ ‘পাচার করা কালো টাকা’র সপক্ষে, অন্তত বিপক্ষে নন, তখন সে নিজেও এই কাজে জড়িত হওয়ার সামাজিক প্রণোদনা পায়। এটাই হচ্ছে সবচাইতে বিপদের কথা। দেশের নতুন প্রজন্ম যদি ‘অনৈতিকতাকেই’ শক্তিমান ও আদর্শ ভাবতে শুরু করে, তবে দেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা খুবই সংকটের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। এই সংকট পরিবারে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে এক বিপুল-বিশাল অনাচার তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে। এটার একটা মাল্টিপল চেইন ইফেক্ট আছে। সেটা আমাদের বর্তমান তো বটেই, ভবিষ্যৎকেও বহুমাত্রিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিপদের কথা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, [email protected]