ঢাকা, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার, ৭ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০ রজব ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সময় অসময়

চলো উৎসবে মিলি

রেজানুর রহমান
১৩ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবারmzamin

মঞ্চের দর্শক কমে গেছে বলে অনেকে মনে করেন। উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে সময়টা বেশ জরুরি। আমাদের দেশে সাধারণত শীতকালেই উৎসব জমে। তাই বলে বছরের অন্য সময়ে উৎসব হবে না? আমরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? নিশ্চয়ই না। তবে এবার উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে মাথায় রাখা উচিত ছিল। ক্রিকেট হাসলেই বাংলাদেশ হাসে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট বলে কথা। যে সময়ে প্রতিদিন উৎসবের কর্মসূচি শুরু হয় সেই সময় টিভি পর্দায় বিশ্বকাপের খেলা থাকে। খেলার প্রেমে পাগল অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উৎসবের নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আগামীতে এই বিষয়গুলো উৎসব কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন আশাকরি। জয় হোক গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের

 

মঞ্চ নাটকের দর্শক কী কমে যাচ্ছে? ক’দিন ধরে এই প্রশ্নটাই বার বার নিজেকে অস্থির করে তুলছে। কেন এমনটা হচ্ছে সেটাই আগে বলি। ঢাকায় চলছে গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব। বিশাল আয়োজন। বাংলাদেশ ও ভারতের ১৪৫টি দল এই উৎসবে অংশ নিয়েছে। একক শিল্পীই আছেন প্রায় ৮০ জন। সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ৫টি মঞ্চ এবং বেইলী রোডে মহিলা সমিতির একটি মঞ্চে একই সময়ে মঞ্চ নাটক, সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন থাকছে প্রতিদিন। ঢাকায় এত বড় আয়োজন বছরে একবারই হয়। ‘গঙ্গা যমুনা নাট্য উৎসব’ নামে এই আয়োজনটি শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। পরবর্তীতে ‘নাট্য’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘সাংস্কৃতিক’ শব্দটি যুক্ত করা হয়। ‘সাংস্কৃতিক’ শব্দটি যুক্ত করায় উৎসবটির গুরুত্ব ও ব্যাপ্তি অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ যে আয়োজনে নাটকের পাশাপাশি সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্যও থাকে সেই আয়োজনে সাংস্কৃতিক উৎসব কথাটিই যথার্থ। 
আমরা কথায় কথায় বলি বাঙালির ১২ মাসে তের পার্বণ। পার্বণ মানেই উৎসব। আর উৎসব মানেই বিপুলসংখ্যক মানুষের আনন্দমুখর উপস্থিতি। হৈ চৈ আর আনন্দের মাঝেই যে কোনো উৎসবের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে যায়। উৎসব মানেই ঢোলের বাদ্য, রঙবেরঙের পোশাক পরা আনন্দ মিছিল, দলবেঁধে ছুটে আসা। নাটক, সংগীতের প্রতিটি অনুষ্ঠানে উপচে পড়া ভিড়। উৎসবকে আমরা মেলার সঙ্গেও তুলনা করতে পারি। প্রিয় শিল্পী মাকসুদের গানের ভাষায়- মেলায় যাইরে... এক কথায় উৎসব মানেই অগুণিত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। চলো যাই উৎসবে মিলি, মানসিক টানটাই হলো বড় কথা। 

কিন্তু আমাদের এবারের গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব কী যথার্থ অর্থে উৎসবের বর্ণিল রঙ ছড়াতে পারলো? শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের আর বাকি ৫টা দিন দর্শক খরায় অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমন তো নয় যে ছুটির দিন বাদে মানুষ নাটক, গানের অনুষ্ঠান দেখতে আসে না। আসে। অতীতে এমনটাই দেখেছি আমরা। তখন ছিল বেইলী রোডে মহিলা সমিতি মঞ্চ আর গাইড হাউজ মিলনায়তনই একমাত্র নাটকের জায়গা। বেইলী রোডকে বলা হয় নাটক সরণি। মঞ্চ নাটকের পরিচয় ও প্রভাবকে পুঁজি করে অখ্যাত বেইলী রোড দিনে দিনে জৌলুসপূর্ণ অভিজাত এলাকা হয়ে ওঠে। মহিলা সমিতি ও গাইড হাউজ মঞ্চে নাটক দেখতে হলে এক সময় অগ্রিম টিকিট কিনতে হতো। নতুন নাটকের ক্ষেত্রে ‘হাউজফুল’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটতো। টিকিট না পেয়ে অনেক দর্শক মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে যেতেন। এখন সেই বেইলী রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চেও নাটকের ক্ষেত্রে দর্শক খরা উদ্বেগের বিষয়। মঞ্চ নাটকের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে বেইলী রোড আভিজাত্য অর্জন করেছে। অথচ মঞ্চ নাটকের ভূমিকার কথা কেউ মনে রাখেনি। গঙ্গা, যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের আওতায় মহিলা সমিতি মঞ্চে প্রতিদিন নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। কিন্তু দর্শক খরা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নিয়মিত মঞ্চ নাটক দেখেন এমন একজন দর্শক অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন- একটা সাইনবোর্ড অথবা ব্যানার ঝুলিয়ে দিলেই উৎসবে মানুষ আসবে না। দরকার প্রচারের অভিনবত্ব। বেইলী রোডে মহিলা সমিতি মঞ্চে যে নাটকের উৎসব চলছে তা বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। নিদেনপক্ষে প্রতিদিন নাটক শুরুর ঘণ্টা খানেক আগেও যদি বাদ্য-বাজনার আয়োজন রাখা যেতো তাহলে উৎসব নিয়ে মানুষের কিছুটা হলেও আগ্রহ তৈরি হতো। 

কথা সত্য। তবুও একটা জরুরি কথা বলতে চাই। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ৫টি হল ও মহিলা সমিতির একটি হলকে ঘিরে চলছে গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব। মহিলা সমিতিতে নাটক শুরুর আগে দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন নেই। তবে মূল উৎসব প্রাঙ্গণ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে উৎসব শুরুর আগে প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে উন্মুক্ত মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকছে। এজন্য উৎসবের মূল অনুষ্ঠান নাটক ও সংগীতের আয়োজনে খুব যে একটা দর্শক বাড়ছে তা কিন্তু নয়। তবে উন্মুক্ত মঞ্চের এই অনুষ্ঠান উৎসবের প্রচার-প্রচারণায় বেশ ভূমিকা রাখছে। এই বিবেচনায় মহিলা সমিতিতেও উন্মুক্ত অনুষ্ঠান থাকা উচিত ছিল বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। 

তবে উৎসব আয়োজনের প্রশংসা করছেন সবাই। তবে উৎসবে অন্তর্ভুক্ত নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য আয়োজন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। একজন দর্শক বললেন, দেশ-বিদেশের প্রায় দেড়শটি দল নিয়ে প্রতি বছর এত বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে এজন্য উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানাই। তবে উৎসবে অন্তর্ভুক্ত নাটকের ব্যাপারে কিছু কথা আছে। উৎসবে অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ নাটকই অনেক পুরনো। যেহেতু উৎসবটি প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাই আগামীর জন্য একটি নতুন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন উৎসব কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্তটি হলো নতুন নাটকের অগ্রাধিকার। তার মানে এই নয় যে পুরনো আলোচিত নাটক থাকবে না। আলোচিত পুরনো নাটকও থাকবে। তবে গত এক বছরে ঢাকার মঞ্চে আসা নতুন আলোচিত নাটক যেন অগ্রাধিকার পায়। এটা করা গেলে এই উৎসবে অংশ নেয়ার জন্য বিভিন্ন নাট্য সংগঠন নতুন প্রযোজনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নাট্য সংগঠক বললেন, আমাদের অনেক সৌভাগ্য যে, প্রতি বছর গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের মতো এত বড় একটি উৎসব করতে পারছি। শ্রদ্ধেয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুস ও নাট্যজন আখতারুজ্জামানের সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি এই উৎসবের অন্যতম প্রেরণা ও প্রাণশক্তি। বিভিন্ন দলের প্রায় ২০০ জন কর্মী প্রতিদিন উৎসবের বিভিন্ন স্তরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আন্তরিক দায়িত্ব পালন করছেন। এটাও উৎসবের প্রাণশক্তি। এখন প্রয়োজন উৎসবটিকে আরও আধুনিক ধ্যান- ধারণায় গতিশীল করা। সময় এবং বাস্তবতা দুটো বিষয়কেই সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া জরুরি। 

বলে রাখা ভালো মানসম্পন্ন নাটক, ভালো সিনেমা, ভালো গানের প্রতি এখনো মানুষের আগ্রহ আগের মতোই আছে। এখন হলো কনটেন্ট এর যুগ। শুধুমাত্র কনটেন্ট বিক্রি করে অনেকে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে যাচ্ছেন। নাটক, সিনেমার ক্ষেত্রে কনটেন্ট অর্থাৎ বিষয়বস্তু এবং এর উপস্থাপনার কারিশমাই দর্শকের ব্যাপক আগ্রহের বিষয়। আমরা সার্বিক অর্থে এই জায়গাটায় কতোটা দাঁড়াতে পেরেছি সেটাই বড় প্রশ্ন। আরেকটি জরুরি প্রসঙ্গ তুলে ধরতে চাই। ক্লাব টাইপের নাটকের দল করে এখন বোধকরি বেশি দূর যাওয়া যাবে না। অ্যামেচার থিয়েটার করার যুগ বোধকরি শেষ। ‘যাত্রা করে ফাতরা মানুষ, নাটক করে বেকার মানুষ এই ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নাটক, সিনেমায় পেশা দারিত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে বোধকরি মঞ্চের চলমান অস্থিরতা দূর করা সম্ভব। এক্ষেত্রে গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের মতো বৃহৎ আয়োজনের অনেক ভূমিকা আছে। ভবিষ্যৎ এই ধরনের আয়োজনে আন্তর্জাতিকমানের সেমিনার, গ্রুপ ডিসকাশনের মতো কর্মসূচি এবং চলচ্চিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছি। 

আমার মতে, গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব ‘প্রত্যেকে আমরা পরের তরে এই চেতনাকেই শানিত করেছে। সময় ও বাস্তবতার কথা উঠলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রসঙ্গ বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটি মোবাইল ফোন এখন জাদুর বাক্সে পরিণত। এমন কোনো বিষয় নাই যা মোবাইল ফোনে দেখা যায় না। মোবাইল ফোন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক জরুরি অনুষঙ্গ। এমনও দেখা যায় পরিবারের ৪ জন সদস্যের ৬/৭টি ফোন। বাবা, মা একমাত্র সন্তান এবং কাজের মেয়ে সকলেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। বাবা-মার একাধিক ফোন সেট। ফেসবুক, ইন্টারনেটে ঢোকার অবাধ স্বাধীনতা। যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এত আধিপত্য ছিল না তখন সিনেমা হল, নাটকের মঞ্চ, গানের অনুষ্ঠান, যেকোনো উৎসবের প্রতিই মানুষের আগ্রহ ছিল বেশি। এখন মোবাইল ফোনেই বিনোদনের অবারিত সুযোগ। নাটক, সিনেমা গান, আড্ডা, রান্নাবান্না, বাজার সদায়, কী করতে চান অথবা কী দেখতে চান আপনি? সবই পাবেন মোবাইল ফোনে। ফলে হলে গিয়ে সরাসরি সিনেমা দেখা অথবা মিলনায়তনে বসে সরাসরি মঞ্চ নাটক দেখা, গানের অনুষ্ঠান উপভোগ করার আগ্রহে ভাটা পড়েছে। সে কারণে মঞ্চের দর্শক কমে গেছে বলে অনেকে মনে করেন।   
উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে সময়টা বেশ জরুরি। আমাদের দেশে সাধারণত শীতকালেই উৎসব জমে। তাই বলে বছরের অন্য সময়ে উৎসব হবে না? আমরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? নিশ্চয়ই না। তবে এবার উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে মাথায় রাখা উচিত ছিল। ক্রিকেট হাসলেই বাংলাদেশ হাসে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট বলে কথা। যে সময়ে প্রতিদিন উৎসবের কর্মসূচি শুরু হয় সেই সময় টিভি পর্দায় বিশ্বকাপের খেলা থাকে। খেলার প্রেমে পাগল অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উৎসবের নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আগামীতে এই বিষয়গুলো উৎসব কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন আশাকরি। জয় হোক গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Bangladesh Army

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status