ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

আ ন্ত র্জা তি ক

ভারত ও চীনের প্রভাব বিস্তারের মধ্যে চীনপন্থির চমক মালদ্বীপে

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
২ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার
mzamin

সাবেক স্পিকার এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদের গড়ে তোলা দল ডেমোক্রেটের প্রার্থী ছিলেন তিনি। কিন্তু প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারিতে তিক্ত প্রতিযোগিতায় হেরে যান। নাশিদ এবং ডেমোক্রেটরা সোলিহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, তিনি ২০১৮ সালে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মালদ্বীপের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিগুলোর বিচার নিশ্চিত করতে পারেননি। এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সরকার। ডেমোক্রেটদের সমর্থন ছাড়াই মোহামেদ সোলিহ দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে উপনীত হন। বৃটেনের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক আইনের প্রফেসর ও মালদ্বীপের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ শাহিদ মনে করেন, মোহামেদ সোলিহ কোনো জোট গঠন করতে পারেননি।

 

ভারত মহাসাগরের মাঝখানে ছোট্ট একটি দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। সেখানে প্রভাব বিস্তারের লড়াই ভারত ও চীনের মধ্যে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোতে দুটি দেশই তাদের প্রভাবের স্বাক্ষর রেখেছে। দৃশ্যত দুই শিবিরে বিভক্ত মালদ্বীপের রাজনীতি। একটি শিবির কট্টরভাবে ভারতপন্থি। অন্যটি ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনপন্থি। এই দুটি দেশকে সমর্থনকারী দুটি শিবিরের মধ্যে ৩০শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাতে ভারতপন্থি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ’কে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছেন চীনপন্থি মোহামেদ মুইজু। দুই প্রার্থী দুই শিবিরের হলেও নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে চমৎকার এক গণতান্ত্রিক রীতি ফুটে উঠেছে। ৩০শে সেপ্টেম্বরে দিবাগত রাতে যখন নির্বাচন কমিশন ফল ঘোষণা করে, তখন বিরোধী দলের প্রার্থী নির্বাচিত মোহামেদ মুইজুর কাছে পরাজয় মেনে নেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ। তিনি তাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন এক্সে (সাবেক টুইটার)। লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত মুইজুকে অভিনন্দন। নির্বাচনে জনগণ যে চমৎকার গণতান্ত্রিক উদাহরণ দেখিয়েছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 

নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীর এমন পরাজয় মেনে নেয়া, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো একটি গণতান্ত্রিক রীতি। অথচ দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান আকাশ পাতাল। ইব্রাহিম মোহামেদ সোলি প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ২০১৮ সালে। তার বিরুদ্ধে মোহামেদ মুইজুর অভিযোগের অন্ত নেই। মুইজু বলেছেন, দেশে ভারতের উপস্থিতির জন্য ‘আনচেকড’ সুবিধা দিয়েছেন সোলিহ। এই অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে সোলিহকে। এর জবাব দিতে গিয়ে সোলিহ বলেছেন, দুই দেশের সরকারের মধ্যে একটি চুক্তির অধীনে একটি ডকইয়ার্ড নির্মাণ করছে ভারত। এ জন্যই ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতি মালদ্বীপে। এতে দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা চালান মোহামেদ মুইজু। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচিত হলে মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাদের সরিয়ে দেবেন। দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভারসাম্য আনবেন। তার অভিযোগ, ভারতকে খুব বেশি সুবিধা দেয়া হয়েছে বাণিজ্যনীতিতে। 

এসব বিষয়ে মত দিয়েছেন বিভিন্ন জন। মালদ্বীপের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ শাহিদ নির্বাচনের ফলকে অর্থনৈতিক এবং প্রত্যাশিত সুশাসনে সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনগণের রায় বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতীয় প্রভাব নিয়ে সরকার যতটা উদ্বিগ্ন ছিল, এসব ইস্যুতে ততটা ছিল না। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি দেশের জনগণ ভারতের কথা মোটেও চিন্তা করেনি। 
এবারের নির্বাচনে ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ’র দল মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) ক্যারিশম্যাটিক নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদ বেরিয়ে যান। তিনি নির্বাচনে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন। নির্বাচনের খুব কাছাকাছি এসে মোহামেদ নাশিদের এমন সিদ্ধান্তে  প্রেসিডেন্ট মোহামেদ সোলিহ হোঁচট খান। ফলে নির্বাচনের প্রথম রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। তাতে কোনো প্রার্থীই শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ভোট পাননি। প্রথম রাউন্ডে সবচেয়ে বেশি ভোট পান ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ ও মোহামেদ মুইজু। পিছিয়ে পড়েন মোহামেদ নাশিদ। দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচন হয় সোলিহ ও মুইজুর মধ্যে। এ সময় একেবারে নীরব থাকেন মোহামেদ নাশিদ। এ বিষয়ে আহমেদ শাহিদ বলেন, এমডিপি থেকে মোহামেদ নাশিদ বেরিয়ে যাওয়ায় দলটির ‘মাদারবোর্ড’ সরে যায়। 

অন্যদিকে পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিন ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এ সময় তিনি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ করে নেন মালদ্বীপকে। এর ফলে দেশটিতে রেলপথ, বন্দর এবং মহাসড়ক নির্মাণ থেকে বাণিজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত হয় চীনের। মালদ্বীপে ঘাঁটি স্থাপনের মধ্যদিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় চীন। মালদ্বীপকে নিয়ে চীন এবং ভারতের নীরব এক লড়াই চলতে থাকে। কখনো তা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। 

সরকারের পরিবর্তনে শুধু দেশটির পররাষ্ট্রনীতিই পরীক্ষায় পড়বে এমন নয়, একই সঙ্গে পরীক্ষায় পড়বে এর গণতন্ত্রও।  মোহামেদ মুইজু দেশটির রাজধানী মালে’র মেয়র। সেখান থেকে এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত। তার বিরোধীরা বলছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুলাহ ইয়ামিনের অধীনে দেশ যেমন কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল, তার সরকারের অধীনেও সেই একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমনপীড়ন চালিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বিরোধী দলের প্রায় সব নেতাকে জেলে ঢুকিয়েছিলেন। বিচারকাজ চালিয়েছেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছিল দুর্নীতি। সেই দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি তহবিলের লাখ লাখ ডলার চুরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিচারকদের, আইনপ্রয়োগকারী এবং পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের ঘুষ দিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশে আল কায়েদা ও আইসিলের মতো গ্রুপের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি চোখ বন্ধ করে রাখেন। এমনকি একজন তরুণ সাংবাদিক ও একজন ব্লগারকে হত্যার পরও তার চেতনা ফেরেনি। পার্থে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি বিষয়ক রিসার্স ফেলো এবং লেকচারার আজিম জাহির বলেন, মালদ্বীপে গণতান্ত্রিক রাজনীতি এখনো অনিশ্চিত। যখন পিপিএম ক্ষমতায় ছিল তখন খুব নিকট অতীতে অভিজ্ঞতা ছিল খুবই গুরুতর। মোহামেদ মুইজু ওই সরকারে একজন মন্ত্রী ছিলেন মুইজু। ফলে তার জয়ে দেশের গণতন্ত্রের জন্য বাস্তবেই নার্ভাস হওয়ার কথা। 

তবে আশার কথা হলো নির্বাচনী প্রচারণায় মোহামেদ মুইজু বার বার তার রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ৪৫ বছর বয়সী এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বলেছেন, আমি কোনো নৃশংসতাকে সমর্থন করি না। আমার সঙ্গে মতের অমিল থাকার কারণে কোনো বিরোধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো না। রাজনীতিতে সবাই সমান সুযোগ পাবেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে তার দেয়া এই নিশ্চয়তা প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ। তিনি নির্বাচনকে গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা বলে উল্লেখ করেছিলেন। নির্বাচনের আগে তিনি সমর্থকদের বলেছিলেন, এই নির্বাচন হলো মালদ্বীপের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অন্যদিকে নৃশংসতা, আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার। 

ওদিকে নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটে তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন ইলিয়াস লাবিব। তিনি মোট ভোটের শতকরা ৭ ভাগ পেয়েছিলেন। সাবেক স্পিকার এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদের গড়ে তোলা দল ডেমোক্রেটের প্রার্থী ছিলেন তিনি। কিন্তু প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারিতে তিক্ত প্রতিযোগিতায় হেরে যান। নাশিদ এবং ডেমোক্রেটরা সোলিহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, তিনি ২০১৮ সালে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মালদ্বীপের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিগুলোর বিচার নিশ্চিত করতে পারেননি। এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সরকার। ডেমোক্রেটদের সমর্থন ছাড়াই মোহামেদ সোলিহ দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে উপনীত হন। বৃটেনের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক আইনের প্রফেসর ও মালদ্বীপের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ শাহিদ মনে করেন, মোহামেদ সোলিহ কোনো জোট গঠন করতে পারেননি। এটা দৃশ্যমান। মোহামেদ নাশিদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে কোনো অনুমোদন ছাড়া ডেমোক্রেটরা যে সোলিহকে ভোট দেবেন এমনটা মনে করার কারণ নেই। এ জন্যই মোহামেদ সোলিহ ভোট কম পেয়েছেন। সব কিছু বুঝতে পেরে তিনি শনিবার রাতের প্রথম প্রহরেই পরাজয় মেনে নিয়েছেন। আগামী ১৭ই নভেম্বর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন মোহামেদ মুইজু। তার পূর্ব পর্যন্ত সরকার চালাবেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ। 
(তথ্য সূত্র: ইন্টারনেট)

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status