নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
যে কারণে আলোচনায় পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার
২০২২ সালে প্রধান বিচারপতি হয়েই তিনি দ্রুত বিচারের বিধান নিশ্চিত করতে কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সহ সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন অঙ্গে সংস্কার শুরু করেছিলেন। তিনি বিল্ডিং কমিটি, রেকর্ড এনরোলমেন্ট কমিটি, সুপ্রিম কোর্টের গবেষণা বিষয়ক শাখা এবং আইন কেরানি প্রোগ্রাম সহ প্রশাসনিক ও বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোকে পুনর্গঠন করেছিলেন। তিনি কাজী ফয়েজ ইসা, সরদার তারিক মাসুদ, ইজাজুল আহসান, মাজহার আলম এবং সাজ্জাদ আলী শাহকে যথাক্রমে বেলুচিস্তান, ইসলামাবাদ, পাঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখোয়া এবং সিন্ধুর প্রাদেশিক সন্ত্রাসবিরোধী আদালতের মনিটরিং বিচারক হিসেবে নিয়োগ করেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে উমর আতা বান্দিয়াল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, জুডিশিয়াল কমিশন অব পাকিস্তান এবং ল’ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই তিনটি সংস্থার পরিচালনা পরিষদ পুরোপুরি পাল্টে দেন তিনি।
কিছু ঐতিহাসিক রায় আর কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। এসব মিলে পাকিস্তানের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচনা করে বিদায় নিলেন প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল। বলা হয়, তিনি রাজনীতিকে শাসন করেছেন। ২০২২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি শপথ নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেনাবাহিনী এমনকি সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেছেন রায় দেয়ার ক্ষেত্রে। এ জন্য পাকিস্তানের ইতিহাসে যে কয়েকজন বিচারপতি ইতিহাস হয়ে থাকবেন তার মধ্যে তিনি অন্যতম।

এ পদ থেকে বান্দিয়ালের বিদায় নেয়ার পর সোমবার নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন বেলুচিস্তানের বিচারক কাজী ফয়েজ ইসা।
চমক দেখাতে চান পাকিস্তানের নতুন প্রধান বিচারপতিও। একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন হাতে। সুপ্রিম কোর্ট (প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রসিডিউর) অ্যাক্ট, ২০২৩ নিয়ে পাকিস্তানে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে একরকম ঠাণ্ডা লড়াই রয়েছে। কারণ, এই আইনের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির সুয়োমটো ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। ক্ষমতা থেকে যাওয়ার আগে এই আইনের সংশোধনী বাতিল করে গেছেন সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল। তার দেয়া রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে পিটিশন করা হয়েছে। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে সেই পিটিশনের শুনানি করেন নতুন প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ইসা। প্রধান বিচারপতি এদিন কোনো প্রটোকল ছাড়া ব্যক্তিগত গাড়িতে পৌঁছেছেন সুপ্রিম কোর্টে। স্টাফদের তিনি বলেছেন, সমস্যা সমাধানের আশায় সুপ্রিম কোর্টে আসেন জনগণ। ভিজিটরদের সঙ্গে অতিথির মতো আচরণ করবেন। তিনি আরও বলেন, বিচারের দরজা উন্মুক্ত থাকা উচিত।
তবে নতুন প্রধান বিচারপতি কতোটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবেন তা নিয়ে প্রশ্নের মধ্যেই স্মরণ করতে হবে সাবেক প্রধান বিচারপতি বান্দিয়ালকে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট যখন আস্থার সংকটে ভুগছিল, তখন নিজেকে লোহার মতো কঠিন রেখেছেন তিনি। সাধারণ মানুষ, রাজনীতিকরা যখন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন, তখন তিনি তাদেরকে দেখিয়েছেন আশার আলো। পাকিস্তানে বর্তমান যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তাতে তিনি এমন সব অবদান রেখেছেন, যা অনেকের পক্ষেই যায়নি। এ প্রসঙ্গে সেখানকার বিচারক আতহার মিনাল্লাহ বলেছেন, আদালত যখন রাজনৈতিক পক্ষপাতী হয়ে পড়ে তখন জনআস্থায় পচন ধরে। গত চারজন প্রধান বিচারপতির সময়ে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে রাজনীতির ছোঁয়া লেগেছে। যখন বিচারক ও রাজনীতিকের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকে না, তখন তাদের কাছে বিচার চাওয়া আর না চাওয়া এক হয়ে যায়। উমর আতা বান্দিয়ালের অধীনে সুপ্রিম কোর্ট অনেকটাই রাজনীতিকীকরণ হয়েছে বলে রাজনীতিবিদদের অভিযোগ।
এর ফলে সদ্য বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলে বসেন, বিচার বিভাগের স্বৈরতন্ত্র গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তার মধ্যে থেকেও তিনি বিবেককে সতেজ রেখে সঠিক রায় দিয়েছেন। গত ৯ই মে পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)-এর চেয়ারম্যান ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে নেয়া হয় রিমান্ডে। কিন্তু উমর আতা বান্দিয়াল জরুরি ভিত্তিতে কোর্ট বসান। তিনি অবিলম্বে ইমরান খানকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেন। যখন ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে নামানো এবং তার পরের পটপরিবর্তনের নেপথ্যে সেনাবাহিনীর অঙ্গুলি ইশারা কাজ করছিল, তখন সেই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রায় দিয়েছেন উমর আতা বান্দিয়াল। তাকে নিয়ে পাকিস্তানে সদ্য বিদায়ী পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) সরকার রাজনীতি কম করেনি। তারা প্রধান বিচারপতির সুয়োমটো ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে আইন পাস করে। এতে ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত হন উমর আতা বান্দিয়াল। এ নিয়ে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে তাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে জাতির প্রয়োজনে কথা বলতে হয়েছে।
উমর আতা বান্দিয়ালের জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর লাহোরে। তিনি পাঞ্জাব মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন। ২০২২ সালের ১৩ই জানুয়ারি তাকে নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে অনুমোদন করেন প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি। শপথ নিয়ে দায়িত্ব শুরু করেন একই বছর ২রা ফেব্রুয়ারি। ১৯৭৩ সালে তিনি রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট মেরি’স একাডেমি থেকে তার সিনিয়র কেমব্রিজ সার্টিফিকেট পান। এরপর তিনি তার উচ্চতর সিনিয়র কেমব্রিজ সার্টিফিকেটের জন্য লাহোরের আইচিসন কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৯৭৯ সালে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮১ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল’ ট্রিপোস ডিগ্রি অর্জন করেন।
বান্দিয়াল ১৯৮৩ সালে লাহোর হাইকোর্টে এডভোকেট হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত লাহোরের পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ল’ কলেজে টর্টস আইন এবং চুক্তি আইন পড়ান। এরপর তাকে লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি করা হয়। লাহোরে আইনি চর্চা করার সময় বিচারপতি বান্দিয়াল প্রধানত বাণিজ্যিক, ব্যাংকিং, ট্যাক্স এবং সম্পদ বিষয়ক মামলা দেখাশোনা করেছেন। ১৯৯৩ সালের পর তিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বিরোধ মোকাবিলায় দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর তিনি লাহোর হাইকোর্টের একজন বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০০৭ সালের নভেম্বরে সাবেক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের সময়ে প্রভিশনাল কনস্টিটিউশন অর্ডারের অধীনে নতুন করে বিচারক হিসেবে শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানান। ২০১৪ সালের জুন মাসে তিনি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হন।
২০২২ সালে প্রধান বিচারপতি হয়েই তিনি দ্রুত বিচারের বিধান নিশ্চিত করতে কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সহ সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন অঙ্গে সংস্কার শুরু করেছিলেন। তিনি বিল্ডিং কমিটি, রেকর্ড এনরোলমেন্ট কমিটি, সুপ্রিম কোর্টের গবেষণা বিষয়ক শাখা এবং আইন কেরানি প্রোগ্রাম সহ প্রশাসনিক ও বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোকে পুনর্গঠন করেছিলেন। তিনি কাজী ফয়েজ ইসা, সরদার তারিক মাসুদ, ইজাজুল আহসান, মাজহার আলম এবং সাজ্জাদ আলী শাহকে যথাক্রমে বেলুচিস্তান, ইসলামাবাদ, পাঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখোয়া এবং সিন্ধুর প্রাদেশিক সন্ত্রাসবিরোধী আদালতের মনিটরিং বিচারক হিসেবে নিয়োগ করেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে উমর আতা বান্দিয়াল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, জুডিশিয়াল কমিশন অব পাকিস্তান এবং ল’ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই তিনটি সংস্থার পরিচালনা পরিষদ পুরোপুরি পাল্টে দেন তিনি। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট প্রথম মাসেই সিদ্ধান্ত নেয়, ১৭৬১টি মুলতবি হয়ে থাকা মামলা সমাধানে। ২০২২ সালে উমর আতা বান্দিয়ালকে বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ মানুষের তালিকায় স্থান দেয়।