ঢাকা, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৮ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে, রাজনীতি

খেলা কি শুরু!

শুভ কিবরিয়া
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবারmzamin

শেখ হাসিনা এককভাবে নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেন। সেটা তার শক্তিমত্তাও হতে পারে। আবার কোনো বিকল্প না থাকাও হতে পারে। তবে, বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচনের চেষ্টা কতোটা সফল হবে-সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল যেভাবে স্বপক্ষ ত্যাগ করলেন এবং তারপর যা ঘটলো, এর রেশ বাড়তে পারে। সরকারের অনেক ক্ষেত্রেই এ রকম বিদ্রোহ যে, ঘটবে না বা তার আয়োজন যে চলছে না- সেটা বলা কঠিন। এ রকম ঘটতে থাকলে, সরকারের ভেতর থেকে সরকারকে দুর্বল করার প্রক্রিয়া পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারে।

 

আমাদের এক বন্ধু আছেন, তার এক চেনামানুষ ক্ষমতাশালী বন্ধু এক দেশের দূতাবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। ফলে আমরা আমাদের বন্ধুটির কাছে, তার বন্ধুর মারফত রাজনীতির কিছু খবরাখবর শুনতে চাই। অনেকদিন তার কাছ থেকে নতুন কোনো খবর না পেয়ে একটু অবাকই হচ্ছি। একদিন জিজ্ঞেস করলাম আসলে খবরটি কি? বন্ধুর উত্তর সেটা ঠিক বলা যাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন
তবে তার বন্ধু নাকি তাকে বলেছে, সেই বন্ধুপ্রতিম দেশটি ডিপ্লোমেসি করবে, না, একটিভিজম করবে তা ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। এই কথাটা আমার খুব মনে ধরেছে। কেননা গত  ক’মাসে আমাদের রাজনীতি অনেকটাই বহুজাতিক দেশের প্রায় একটিভিজমের পর্যায়েই পড়ে গেছে। দেশে সরকারও তাতে উৎসাহ দিচ্ছে। বিরোধী দলগুলোরও তাতে সায় আছে। সরকার বোঝাতে চাইছে ভারত, চীন, রাশিয়া তার পক্ষে। অন্যদিকে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো এবং জাতিসংঘ বোঝাতে চাইছে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে আগ্রহী করে তুলতে চাইছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের এই এজেন্ডাকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই দেশি ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও নানা খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে।

শুরু করেছিলাম দূতাবাসের ডিপ্লোমেসির কথা দিয়ে। সেটা কখন যে একটিভিজম আর কখন যে ডিপ্লোমেসি সেটা বোঝা কঠিন হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে এসে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। মি. ল্যাভরভ জি-২০ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের অনুপস্থিতিতে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছেন। যুদ্ধসহ পুতিনের সকল কট্টর কাজের সহযোগী ল্যাভরভ গোটা বিশ্বে একজন গোঁড়া পুতিনপন্থি হিসেবেই পরিচিত। তিনি বাংলাদেশ সফরে এসে সংবাদ সম্মেলনে বলে গেলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের পরও বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছে, যা প্রশংসনীয়।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে এক প্রশ্নের উত্তরে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘আমরা যদি পরিস্থিতি বিবেচনা করি, তাহলে দেখবো ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের নামে তাদের লক্ষ্য চীনকে প্রতিহত ও রাশিয়াকে একঘরে করে ফেলা, যা কার্যত বৈশ্বিক পরিসরে ন্যাটোর সম্প্রসারণেরই অংশ।’

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ন্যাটের সম্প্রসারণ তত্ত্বের’- এই আওয়াজ সহজ করে দেখার বিষয় নয়। এর মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা ও প্রতিপক্ষ প্রতিহতকরণের একটা গন্ধও আছে। কেননা, বাংলাদেশে আমেরিকার কার্যক্রমকে বৃহত্তর অর্থে রাশিয়ার যদি বৈশ্বিক পরিসরে ন্যাটোর সম্প্রসারণেরই অংশ বলে মনে হয়, তাহলে রাশিয়া কি তা প্রতিহত করতে পদক্ষেপ নেবে? এই একই যুক্তিতে কিন্তু ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছে রাশিয়া। তাই সের্গেই ল্যাভরভের এই আশঙ্কা বা মন্তব্যকে হালকা ভাবে নেয়া যায় না।

অন্তত বাংলাদেশে যা ঘটছে তাতে রাশিয়ার অংশগ্রহণ যে খুব সক্রিয় তা বোঝা যায়। কেননা রাশিয়া বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নানা বিনিয়োগ ও ব্যবসায় জড়িয়েছে।  রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরে সেসব বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গাজপ্রমের গ্যাসকূপ খনন অব্যাহত রাখা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে এই সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাশিয়ার স্টেক বা আগ্রহ বোঝা গেল। চীনের বিষয়ে সরকারের আগ্রহ ভারত কীভাবে দেখছে, সেটাও আমাদের রাজনীতির জন্য একটা বড় বিষয়। এ সম্পর্কে ভারত সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের পর সে দেশের আনন্দবাজার পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে- ‘চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আর্থিক হলেও রক্তের বন্ধুত্ব ভারত, মোদির বাসভবনে বৈঠক সেরে বার্তা হাসিনার’- এই শিরোনামে। এই খবরে বলা হয়, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে তার সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ও চাপের কথা যেমন তুলেছেন তেমনিভাবে নরেন্দ্র মোদিকে আশ্বস্ত করেছেন চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিতান্তই বাণিজ্যিক ও আর্থিক। রক্তের সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গী ভারতের সঙ্গেই। অর্থাৎ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নেহাতই বাণিজ্যিক- এটা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কিছু নেই।

এতো গেল বিদেশের কথা। দেশে ঘটছে নতুন নতুন ঘটনা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরকার শেষ অবধি কি করতে চান, সেটা এখনো পরিষ্কার না। তবে বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক নিউএজ পত্রিকা খবর করেছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে মোট ১৭৪টি মামলা আছে। যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, শ্রমিক আইন লঙ্ঘন ও মানি লন্ডারিং মামলা আছে। আর এই মামলাগুলো করা হয়েছে গত এক দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। এসব মামলার মধ্যে ঢাকার শ্রম আদালতে ১৩৭টি, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে ৩টি, হাইকোর্টে ১০টি, আপিল বিভাগে ৬টি, যুগ্ম জেলা জজ আদালত ও ভূমি জরিপ আদালতে ১টি এবং বাকিগুলো বিচারাধীন রয়েছে। ১৬টি মামলা অন্যান্য আদালতে। এই মামলার বহর পরিষ্কার কিছু ইঙ্গিত করছে। বোঝা যাচ্ছে- সরকার শক্তভাবে অধ্যাপক ইউনূসকে প্রতিপক্ষ ঠাওরেছেন। তাকে জেল, দণ্ড, শাস্তি দিয়ে কাবু করতে চাইছেন। ইতিমধ্যে ড. ইউনূসের পক্ষে- বিপক্ষে দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলের বিবৃতিযুদ্ধ আমরা দেখেছি। সম্প্রতি সরকারের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের সরকারপক্ষ ত্যাগ, তার চাকরি থেকে অব্যাহতি, মার্কিন দূতাবাসে গমন ও ঘরে ফেরতকাণ্ডও আমরা লক্ষ্য করছি। প্রতিটি ঘটনাই রাজনীতির ভেতরের খেলা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থাও ক্রিটিক্যাল বলে খবর বেরিয়েছে। সংবাদমাধ্যমকে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেছেন, লিভার ও কিডনি সমস্যা আরও জটিল হওয়ায় খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে তার চিকিৎসকেরা শঙ্কিত। মেডিকেল বোর্ডের দু’জন সদস্য জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণে’- রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থাও রাজনীতির একটা অনুঘটক হতে পারে।
এখন তাহলে ঘটবে কী? রাজনীতিতে সত্যি সত্যিই কি খেলা হবে? সেই খেলার ধরন কেমন হবে? খেলায় কি স্বাভাবিক নিয়ম মানা হবে? নাকি খেলা চলবে গায়ের জোরে? এর একটা ইঙ্গিত মিলবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার পর তিনি কি বলছেন, করছেন তার ওপর। তবে কতগুলো বিষয় লক্ষণীয়-

১. এই অঞ্চলে আধিপত্যের লড়াইয়ে আমেরিকান ভূমিকার সঙ্গেই থাকতে হচ্ছে ভারতকে। চীন তার শক্ত প্রতিপক্ষ। রাশিয়া তার পুরনো মিত্র। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতকে আমেরিকা ও পশ্চিমি দুনিয়ার দিকেই হাত বাড়াতে হচ্ছে। রাশিয়া ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ সফররত রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাতেও সেই ইঙ্গিত আছে। অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও চলছে নানান পালাবদল। নরেন্দ্র মোদিকে শক্তভাবে চ্যালেঞ্জ করছে সম্মিলিত বিরোধী জোট। ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় ফেরত আশার ক্ষেত্রে পশ্চিমি মিত্রতাও একটা বড় প্রভাবক। সেটাও হাতছাড়া করতে চাইবেন না মোদি ও তার থিঙ্ক ট্যাঙ্ক।

২. শেখ হাসিনা এককভাবে নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেন। সেটা তার শক্তিমত্তাও হতে পারে। আবার কোনো বিকল্প না থাকাও হতে পারে। তবে, বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচনের চেষ্টা কতোটা সফল হবে- সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল যেভাবে স্বপক্ষ ত্যাগ করলেন এবং তারপর যা ঘটলো, এর রেশ বাড়তে পারে। সরকারের অনেক ক্ষেত্রেই এ রকম বিদ্রোহ যে, ঘটবে না বা তার আয়োজন যে চলছে না- সেটা বলা কঠিন। এ রকম ঘটতে থাকলে, সরকারের ভেতর থেকে সরকারকে দুর্বল করার প্রক্রিয়া পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারে।
৩. ড. ইউনূস ইস্যু হঠাৎ করে নিয়মিত রাজনৈতিক উত্তাপকে ছাড়িয়ে বড় ইস্যু হয়ে উঠলো কেন? নিশ্চয় এর পেছনে কোনো কারণ আছে। তাহলে মাঝে-মধ্যে যে জাতীয় সরকারের কথা শোনা গেছে সেরকম কি কিছু ঘটতে পারে?
৪. এই বহুমাত্রিক রাজনৈতিক টানাপড়েনের ফলে, একটা ব্যালান্সও ঘটতে পারে। সব পক্ষই ক্ষতির সম্মুখিন হওয়ার বিপদ দেখলে, চাপের মুখে শর্তসাপেক্ষে নিজেদের মধ্যে একটা আপস করে ফেললেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

রাজনীতিতে সত্যি সত্যিই কি ঘটবে সেটা বলা খুব মুশকিল। ঘটনাটচক্র বিশ্লেষণ করে কিছু অনুমান করা ছাড়া কিন্তু যেটা নিশ্চিত করে বলা যায়, আমাদের রাজনীতিবিদরা দেশের ভবিষ্যৎ না দেখতে পারলে, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ক্ষুদ্র স্বার্থে ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকতে চাইলে, কিংবা যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যেতে চাইলে, দেশের স্বার্থ বিলীন হবে। বহুপক্ষীয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে দেশের স্বার্থ, জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেই হবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

 

 

পাঠকের মতামত

আমাদের রাজনীতিবিদরা দেশের ভবিষ্যৎ না দেখতে পারলে, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। আশা করি সকলের শুভবুদ্ধির উয়দ হোক।

Eusuf Ali Khan
৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৯:২৯ অপরাহ্ন

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

বেহুদা প্যাঁচাল/ অর্থমন্ত্রীর এত বুদ্ধি!

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status