নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক
মন্ত্রীর অসহায়ত্ব, ব্যবসায়ীদের রাজত্ব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
এম এম মাসুদ
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার
সচিবালয়ের এক অনুষ্ঠানে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা আসলে কঠিন বলে মন্তব্য করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। আমরা চেষ্টা করছি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। এ ছাড়া গত ২৬শে জুন জাতীয় সংসদে বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী। শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাজারে গিয়ে মানুষ কাঁদছে, তার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।’ মানুষও এটি বোঝে। শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দায় চাপালে হবে না। ডিমের বাজারে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে সিন্ডিকেট। হাঁস-মুরগির ডিম ইউক্রেন থেকে আসে না। এমন প্রশ্নের জবাবে টিপু মুনশি বলেছিলেন, চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে, সেটাও তো সইতে আমাদের কষ্ট হবে
দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দাম সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
সমস্যা মূলত এখানেই। দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা কার্যকর নেই। কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। এই অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীকে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। কোনো কোনো সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী চাহিদা সামনে রেখে কম দামে কিনে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করেন। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাধ্য হয়েই ভোক্তাকে এসব পণ্য কয়েকগুণ বেশি দামে কিনতে হয়।
সাধারণত চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেলে বাজারে যেকোনো জিনিসের দাম বাড়বে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতে শুল্ক বাড়ানোর খবরে কেন দেশের বাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বাড়বে? বেশি দামে আমদানি করা হলে, এর পর দাম বেশি রাখলে মেনে নেয়া যায়। অথচ দেশে ওই পণ্য আমদানি করাই হয়নি। বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এই সিন্ডিকেটই বারবার সুযোগ নিয়ে থাকে। এরা একেক সময় একেকটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।
এত কিছুর পরও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি দাবি করেছেন, অর্থনীতি ভালো আছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, যারা অর্থনীতি ভালো নেই বলছেন, তারা অর্থনীতিই বোঝেন না।
এ বিষয়ে দেশের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন- সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি অর্থনীতির সমস্যা স্বীকার না করেন, তাহলে সমাধানের পথও কঠিন হয়ে যাবে। সম্প্রতি দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের যৌথ জরিপে উঠে এসেছে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, অর্থনীতি ভুল পথে এগোচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যে হয়নি, তা নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইনে কিছু সমস্যা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম বেড়ে আবার কমেছে এবং কমার এ প্রবণতা অব্যাহত। এর সঙ্গে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখিয়ে অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। এক্ষেত্রে চরম সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি এক বছর আগে ৭০ শতাংশে উঠেছিল। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে তাদের মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নেমেছে। এই অঞ্চলের ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড সহ কিছু দেশে এখন এক বছরের আগের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কম।
আর আমাদের মূল্যস্ফীতি কয়েক মাস ধরে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, অর্থনীতির সংকট নিয়ে নীতিনির্ধারকরা কোনো সিরিয়াস আলোচনাতেই যেতে চান না। তারা এক প্রকার ‘আত্মতুষ্টি’ নিয়ে বসে আছেন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বছর দুয়েক আগে যখন ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়, তখন অর্থনীতির ব্যবস্থাপকরা এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ছিলেন। বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতে বেশি ঋণ আনার সুযোগের ফলে রিজার্ভ ফুলেফেঁপে ওঠে। সেই রিজার্ভ এখন ২২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
বিশ্বব্যাংক প্রতি তিন মাস পর ‘কমোডিটি মার্কেট আউটলুক’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংস্থাটি প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যের হালনাগাদ পরিসংখ্যান দেয়। গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্যমূল্য কমার প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, ২০২৩ সালে সামগ্রিকভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম কমবে গত বছরের চেয়ে ২১ শতাংশ। জ্বালানি পণ্যের দাম কমবে ২৬ শতাংশ। গত মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় দর ছিল ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার। গত জুলাই মাসে তা ৮০ ডলারে নেমেছে। সয়াবিন তেলের গড় দর ছিল প্রতি টন ১ হাজার ৬৬৭ ডলার। গত জুলাইয়ে যা ১ হাজার ১৩৬ ডলারে নেমেছে। একই সময় পাম অয়েলের দাম ১ হাজার ২৭৬ ডলার থেকে কমে ৮৭৯ ডলার হয়েছে। গরুর মাংসের গড় দাম কেজিপ্রতি ৬ ডলার থেকে ৫ ডলারে নেমেছে। মুরগির মাংসের দামও আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। দাম বেড়েছে চিনির মতো হাতেগোনা দু’একটি পণ্যের। অথচ বাংলাদেশে হঠাৎ কোনো কোনো পণ্যের দাম এক লাফে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার নজির রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পিয়াজ ও রসুন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ভারত ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় পিয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়।

সম্প্রতি ডাব কেনাবেচায় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের থাবা লক্ষ্য করা গেছে। গ্রামে একটি ডাব ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হলেও রাজধানীতে খুচরা পর্যায়ে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। চাল, ডাল, পিয়াজ, চিনি, আটা, লবণ, ভোজ্য তেল, মাছ, সবজি ও মুরগি- এসব পণ্য নিয়ে যেন চলছে দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা।
বাজারে সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। প্রায় সব নিত্যপণ্য নিয়েই বাজারে চলছে কারসাজি। বাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। রসুনের দাম বেড়ে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি বিআর-২৮ চাল কিনতেও খরচ হচ্ছে ৬০ টাকা পর্যন্ত। খোলা আটার কেজি ৫০ টাকার উপরে।
গত কয়েক বছর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাজারে পণ্যের দাম বাড়লেই ব্যবসায়ী নেতারা আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। ঘোষণা দেন, চাহিদার অতিরিক্ত পণ্যের মজুত থাকায় কোনো পণ্যেরই দাম বাড়বে না। বাণিজ্যমন্ত্রীও তখন মানুষকে আশ্বাসের বাণী শোনান। তারপর বাজারে গিয়ে ভোক্তারা বোকা হতে শুরু করেন। একই চিত্র চলছে বছরের পর বছর। সরকারি দু’-একটি সংস্থা কোনো কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে নামমাত্র জরিমানা করছে। এতে জরিমানার অর্থ তুলতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
বাজারের এমন অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিনের। বাজারে অভিযানও চালানো হয়। ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করা হয়। কিন্তু কোনো সুফল দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মূল কথা হলো- যারা মজুত ধরে রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ধরে শাস্তি দেয়া হোক, জেলে দেয়া হোক, তাহলেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? তারা তো সরকারের চেয়ে শক্তিশালী না। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের করণীয় আছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আছে। আছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এসব সংস্থা কি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে?
কঠোরভাবে বাজার নজরদারি করা হলে এই কারসাজি রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। বাজারের নিয়ন্ত্রণ সরকার নিতে না পারলে কোনোভাবেই পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হবে না। কাজেই সরকারকে মূল ভূমিকা নিতে হবে।
সম্প্রতি সচিবালয়ের এক অনুষ্ঠানে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা আসলে কঠিন বলে মন্তব্য করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। আমরা চেষ্টা করছি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। এ ছাড়া গত ২৬শে জুন জাতীয় সংসদে বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী। শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাজারে গিয়ে মানুষ কাঁদছে, তার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।’ মানুষও এটি বোঝে। শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দায় চাপালে হবে না। ডিমের বাজারে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে সিন্ডিকেট। হাঁস-মুরগির ডিম ইউক্রেন থেকে আসে না। এমন প্রশ্নের জবাবে টিপু মুনশি বলেছিলেন, চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে, সেটাও তো সইতে আমাদের কষ্ট হবে।