নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক
বৃটিশ সিভিল সার্ভেন্টদের আদলে নিরপেক্ষ আমলা গড়ে তুললে নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নই উঠতো না
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার
বৃটিশ সিভিল সার্ভেন্টদের মতো এমন নিরপেক্ষ আমলা গড়ে তুললে বাংলাদেশে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নই উঠতো না। আমরা কথায় কথায় বৃটিশ মডেল বা ওয়েস্ট মিনস্টারের উদাহরণ দেই। কিন্তু বৃটিশ সিভিল সার্ভেন্টদের মতো নিরপেক্ষ আমলা আমরা গড়ে তুলতে পেরেছি? শুধু বর্তমান সরকারই নয় বরং বিগত ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনো সরকারই বৃটিশ আদলে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় আমলা গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন না। জাতির ব্যর্থতা এখানেই। আর এই ব্যর্থতা থেকেই সৃষ্ট রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক অবিশ্বাস, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, জনগণের মৌলিক অধিকার ভোটাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা
প্রায়ই মন্ত্রীরা বলে থাকেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় ঠিক সেভাবে বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তারা বৃটেনের কথা উল্লেখ করে থাকেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৃটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে এক বৈঠকের পর ওয়েস্টমিনস্টারে কীভাবে নির্বাচন হয় সাংবাদিকদের কাছে সেই প্রশ্নও তুলেছেন।
বস্তুত রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীরা হলেন আমলাদের পলিটিক্যাল মাস্টার তথা রাজনৈতিক প্রভু আর আমলারা হলেন দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পাদনাকারী রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ কর্মচারী ও কর্মকর্তা। তাদের ‘সিভিল সার্ভেন্টস অব দ্য গভর্নমেন্ট অব দ্য ডে’ বলা হয়। বৃটেনে মন্ত্রীরা বা প্রধান বিরোধী দলের ছায়া মন্ত্রীরা রাজনৈতিকভাবে পার্লামেন্টে ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস’ যুদ্ধ করলেও তারা সর্বাবস্থায় সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের রাজনৈতিকভাবে দৃশ্যত ও আক্ষরিক অর্থে নিরপেক্ষ রাখেন। উভয় শ্রেণির সীমারেখা সুনির্দিষ্ট।
বৃটেনে নির্বাচনের শিডিউল যখন ঘোষণা করা হয় তখন ক্ষমতাসীন সরকার মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হয়। চালু হয় পর্দাপ্রথার (Rules of Purdah-pre-election period) কঠোর নিয়ম এবং চলে প্রায় ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত। নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা শেষ হওয়া পর্যন্ত। কেবিনেট অফিস থেকে সিভিল সার্ভেন্ট ও পলিটিশিয়ানদের জন্য শক্ত নির্দেশনা জারি করা হয়। পর্দাপ্রথার অধীনে সেই তত্ত্বাবধায়ক চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি শ্রদ্ধা, তার সমান অধিকারের স্বীকৃতি, কোনো পলিসিগত সিদ্ধান্ত না নেয়া, রাজনীতিবিদদের সংযত আচরণ এবং প্রশাসন ও রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভূমিকা আক্ষরিক অর্থে নিশ্চিত করা। পর্দাপ্রথা অনুসারে প্রশাসনের নিরপেক্ষতার নীতি শুধু যে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ওপর প্রযোজ্য হয় তা নয়; বরং সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ কাউন্সিল ও নগর পরিষদও এ নীতি প্রতিপালনে বাধ্য। বেসরকারি বা বাণিজ্যিক রেডিও-টিভিকেও সব দলের প্রতি সমান সুযোগ প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপিত হয়।
চিন্তা করতে পারেন বৃটেনে ভোটগ্রহণ ও গণনার জন্য নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কোনো কর্মী বাহিনী বা লোকবল নেই। বিভিন্ন কাউন্সিলের সিভিল সার্ভেন্টস তথা সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারাই মূলত এ কাজটি করে থাকেন। কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী (সিইও তথা চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তা) সাধারণত রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। কাউন্সিলের সব আইনি দিকসহ নির্বাচন পরিচালনার আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা সঠিকভাবে সম্পাদন করা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করে থাকেন কাউন্সিলের লিগ্যাল ও গভর্নেন্স ডাইরেক্টর যিনি মনিটররিং অফিসার হিসেবে অধিক পরিচিত।
১.৭ বিলিয়ন পাউন্ডের বাজেটের ক্ষমতাসম্পন্ন লন্ডনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার কাউন্সিলের ডেপুটি স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি চার বছর। অনেক সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিভিল সার্ভেন্টদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে তার ইন্ডাকশন ও ইন্টেনসিভ ট্রেইনিং দেয়া হয়েছে সব নির্বাচিত প্রতিনিধিকে। কোনো অবস্থাতেই সিভিল সার্ভেন্টদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ করা যাবে না, তাদের সার্ভিস ডেলিভারি ও অপারেশনাল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের কোনো সমস্যা বা ইস্যু নিয়ে সার্ভিস ডেলিভারি বা অপারেশনে থাকা জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বা কথা বলা যাবে না। কোনো অনুসন্ধান করতে হলে বা তথ্য জানতে হলে যোগাযোগ করতে হবে ডিরেক্টর লেভেলে বা সেন্ট্রাল মেম্বারস্ ইনকোয়ারি সেকশনের মাধ্যমে। পুরো কাউন্সিল লেবার পার্টির (পুরো ৬০ জন কাউন্সিলর লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত ছিল) হওয়ার পরও সিভিল সার্ভেন্টদের নিরপেক্ষ রাখার জন্য এই বিধি-নিষেধ, তাহলে সিভিল সার্ভেন্টরা কেন নিরপেক্ষ হবেন না বা কেন নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করবেন না?

বাংলাদেশে নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসে তখন নির্বাচন কমিশন ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অনেকটা দৌরাত্ম্য চলে। মিডিয়ায় ফলাও করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দেখায়। বৃটেনে আছি আজ প্রায় ৩৪ বছর হতে চললো, এখনো জানলাম না বৃটেনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে? কোনোদিন জানার চেষ্টাও করিনি, দরকারও নেই। বৃটেনে ‘ইলেকশন কমিশন’ বা ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ টার্মিনোলোজিই নেই বা ব্যবহার করা হয় না। এখানে আছে ‘ইলেক্টোরাল কমিশন’ আর ‘কমিশনারের চেয়ার’। মোট ১০ জন কমিশনার আছেন। এই ১০ জনকে কয়জনই বা চেনে বা তাদের নাম জানে? বৃটেনের অন্ততপক্ষে ৯৯% মানুষ তাদের নামই জানে না। জিজ্ঞেস করলে হয়তো গুগল সার্চ করে বের করবে! সিস্টেম গড়ে তুললে ব্যক্তির বা ব্যক্তিসমূহের অবস্থান ও পরিচয় হয় গৌণ। আর এটি যখন হয়, তখন কমিশনের চিফকে বলতে হয় না নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে! ওভজারভাররা এসেও সার্টিফাই করতে হয় না। জনগণ তাদের নিজ চোখে দেখে।
বৃটেনে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও যেসব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দ বা অনুদান পেয়ে থাকে তাদের ক্ষেত্রেও পর্দাপ্রথা নীতি অবশ্য পালনীয়। রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি কখনো দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় হয় না, বরং পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতার মাপকাঠিতেই হয়ে থাকে। এর ফলে নির্বাচনে দলীয় প্রভাব খাটানো বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মোটেই কোনো অবকাশ থাকে না। আর এজন্য তো দেখি বৃটেনে সিভিল সার্ভেন্টরা সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টানা ১৫ ঘণ্টা ভোট গ্রহণ করে থাকেন ও এরপর সুচারুরূপে স্বচ্ছভাবে গণনা করে ফলাফল ঘোষণা করেন। কেউ তাদের কখনো সন্দেহ করে না, করার কোনো কারণও উদ্ভব হয় না। বৃটেনের পরিবেশ ও পারিপার্শিক অবস্থা এবং সিভিল সার্ভেন্টদের নিরপেক্ষতার মান এমন যে তাদের মধ্যে ভোট গ্রহণে বা গণনায় একটু এদিক সেদিক করার স্পৃহা, ইচ্ছা, আকাঙ্খা, মনোবাসনা বা আগ্রহের লক্ষণ মোটেই পরিলক্ষিত হয় না। সিভিল সার্ভেন্টরা অন্যের ভোট নিজে কাটা, জাল ভোটপ্রদান, একের ভোট অন্যে দেয়াতে সহযোগিতা করা ও দিনের ভোট রাতে দেয়ার কথা বা দৃশ্য এখানে কল্পনাতীত।
বৃটিশ সিভিল সার্ভেন্টদের মতো এমন নিরপেক্ষ আমলা গড়ে তুললে বাংলাদেশে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নই উঠতো না। আমরা কথায় কথায় বৃটিশ মডেল বা ওয়েস্ট মিনস্টারের উদাহরণ দেই। কিন্তু বৃটিশ সিভিল সার্ভেন্টদের মতো নিরপেক্ষ আমলা আমরা গড়ে তুলতে পেরেছি? শুধু বর্তমান সরকারই নয় বরং বিগত ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনো সরকারই বৃটিশ আদলে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় আমলা গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন না। জাতির ব্যর্থতা এখানেই। আর এই ব্যর্থতা থেকেই সৃষ্ট রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক অবিশ্বাস, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, জনগণের মৌলিক অধিকার ভোটাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।
লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার ও লন্ডন বার অব নিউহ্যামের সাবেক ডেপুটি স্পিকার।
ই-মেইল: [email protected]
পাঠকের মতামত
ধন্যবাদ লেখক এবং মানবজমিন কর্তৃপক্ষকে। চমৎকার, বাস্তবতাভিত্তিক ও সময়োপযুগি নিবন্ধ। " নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণে কঠোর বিধি-নিষেধ, আইন ও কোড অব কন্ডাক্ট দ্বারা সিভিল সার্ভেন্টরা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত" লাইনটি হল লেখার মূূল নির্যাস। দেশকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রীক দুর্বৃৃত্তপনার হাত থেকে উদ্ধার করার পথ হল উল্লেখিত লাইনটি অনুযায়ী দেশে আইন প্রনয়ন করা।