ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

খোলা চোখে

ঢাকার পোয়া বাজার এবং মন্ত্রীর ভোটের ব্যবসা

লুৎফর রহমান
২৭ আগস্ট ২০২৩, রবিবারmzamin

তিনি যে ভোটের ব্যবসার কথা বলেছেন এটিই আসলে সত্য। রাজনীতি এখন একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ভোটের ব্যবসা। এখানে সবাই লাভের চিন্তা করে। এ কারণে বড় বড় ব্যবসায়ীরাও রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে চাইছেন। বড় আমলারা রাজনীতিবিদ হতে চাইছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতিক নেতার মতো বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসতে চাইছেন। আর এ কারণে দেশে আমলা রাজনীতিক বাড়ছে। ব্যবসায়িক রাজনীতিবিদ বাড়ছে। মাঠ থেকে উঠে আসা মানুষের জন্য রাজনীতি করা রাজনীতিবিদের সংখ্যা কমছে। এ কারণেই সাধারণ মানুষের জন্য কথা বলা রাজনীতিবিদের সংখ্যা যে কমে যাচ্ছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এমন বাস্তবতার কারণেই হয়তো বাজার সিন্ডিকেট আরও বড় হচ্ছে। আয় বৈষম্য বাড়ছে।


পল্লবীর ছোট বাজারটিতে প্রায়ই যাওয়া হয় বাসা থেকে কম দূরত্বের কারণে। সড়কের ওপর গড়ে ওঠা বাজারটি অনেকটা অস্থায়ী ধরনের। ভাসমানও বলা চলে। মাঝে মাঝে সিটি করপোরেশনের লোকজন অভিযান চালালে কিছু সময়ের জন্য উধাও হয়ে যায় বাজার। তখন সড়কটি বেশ চওড়া দেখায়। আভিযান শেষ হয়ে গেলে সড়কে অর্ধেক জুড়ে আবার দোকানিরা বসে যান। আশপাশের অনেকে এখান থেকে নিত্যপণ্য কিনে নিয়ে যান। ক্রেতাদের একটা বড় অংশ নিম্নœআয়ের। বাজারে প্রথম কেউ গিয়ে পণ্যের দাম জিজ্ঞেস করতে গেলে প্রথমে একটু খটকা লাগতে পারে। এখানে অনেক পণ্যের দাম হাঁকা হয় পোয়া হিসেবে। ছোট বা দেশি মাছের দাম জিজ্ঞেস করলে বিক্রেতা এক পোয়া মানে ২৫০ গ্রামের দাম বলবেন। তেমনি টমেটো বা শিমের দাম জানতে চাইলে  কেজির দাম না বলে এক পোয়ার দাম বলবেন বিক্রেতা। এই পোয়ায় দাম বলায় অনেকে এই বাজারকে পোয়া বাজারও বলে থাকেন। এই বাজারে আসা ক্রেতাদের অনেকে এই পোয়ায় দাম শোনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ তাদের কেজিতে পণ্য কেনার মতো সামর্থ্য  নেই।
পল্লবীর এই বাজারটি থেকে এক দেড় কিলোমিটার দূরত্বে মিরপুর-৬ এ আরেকটি স্থায়ী বাজার রয়েছে। স্থানীয় ঈদগাহ মাঠকে এখানে স্থায়ী বাজারে রূপ দেয়া হয়েছে। এ বাজারে টাটকা মাছ, শাক-সবজির জন্য আশপাশের মানুষের কাছে পরিচিত। পণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি। আশপাশের এলাকার ধনী মানুষেরাই এখানে বাজার করতে যান। এ বাজারে অবশ্য কোনো পণ্যেরই পোয়ায় দাম হাঁকাতে দেখা যায় না। ক্রেতারাও খুব একটা দরদাম করে পণ্য কিনেন না। এই বাজারের বিক্রেতাদের দাবি ক্রেতাদের অনেকেই পরিচিত । তাই এসে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে নিয়ে যান। দরদাম খুব একটা করেন না। বড় ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, বাড়ির মালিক এমন ক্রেতারাই এখানে আসেন বেশি। 

ঢাকার পাশাপাশি দুটি বাজারের এই চিত্র অনেক কিছুরই ইঙ্গিত বহন করে। দুই বাজারের চিত্র বলে দেয় যে, নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্যের মধ্যেও একশ্রেণির মানুষের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। সমস্যায় আছেন নির্ধারিত শ্রেণির মানুষ। স্বল্প বা মধ্যম আয়ের মানুষ বড় কষ্টে সময় পার করছেন। তারা কেমন আছেন পোয়া বাজারের চিত্রই তা অনেকটা বলে দেয়। 
দেশের বহু বছর ধরেই নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট কাজ করছে বলে আলোচনা হচ্ছে। সিন্ডিকেটের কারণে দাম বাড়ে এমন আলোচনাও পুরনো। সরকার আসে, সরকার যায় কিন্তু এই সিন্ডিকেট কেউ ভাঙতে পারে না। করোনা মহামারির পরে নিত্যপণ্যের বাজারে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ। এ বছরের শুরু থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে ওঠানামা করছে। প্রায় এক দশকের মধ্যে এবারই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির হিসাব দিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। বলা হচ্ছে, করোনা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বে যে টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে এর জেরে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হয়েছে। বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও ক্রেতাদের অতিরিক্ত মাশুল দিতে হচ্ছে। 

করোনা আর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের জেরে বিশ্বে যে অস্থিতিশীল অবস্থা ছিল তা কিন্তু এখন কমে আসছে। এ কারণে বিশ্বের দেশে দেশে নিত্যপণ্যের দাম কমছে। কমছে বিভিন্ন সেবা মূল্যও। কিন্তু দেশের বাজারে ঠিক উল্টো অবস্থা বিরাজ করছে। 
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে,  আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে গমের দাম কমেছে প্রতি টনে ৩৫ শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটার দাম ২৫ শতাংশ এবং খোলা আটার দাম ১৩ শতাংশ বেড়েছে। পিয়াজের দামেও একই অবস্থা। মসুর ডালের দাম বিশ্ব বাজারের চেয়ে কম হারে কমেছে দেশে। অপরিশোধিত চিনির দাম বিশ্ব বাজারে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে বাড়ার হার দ্বিগুণের কাছাকাছি। আদার দাম বিশ্ব বাজারে ১৭২ শতাংশ বাড়লেও দেশের বাজারে বেড়েছে ২২২ থেকে ২৪৫ শতাংশ পর্যন্ত। ভোজ্য তেলের দামের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ৪৪ শতাংশ কমলেও দেশের বাজারে খোলা তেলের দাম কমেছে ২ শতাংশ। আর পাম তেলের দাম বিশ্ব বাজারে ৪৯ শতাংশ কমার বিপরীতে দেশে কমেছে ২০ শতাংশ। 

মাছ-মাংসের বাজারে সাধারণ মানুষ এখন ঘেঁষতে পারছেন না। কম আয়ের মানুষের পুষ্টির নির্ভরতার একটা জায়গা ছিল ডিম। সেটাও এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজারে এক হালি ডিম কিনতে এখন ক্রেতাকে গুণতে হচ্ছে ৫৫ টাকা। ডজন হিসেবে ১৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হঠাৎ করে প্রতি ডজন ডিমের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে গেল। কেন দাম বাড়লো এর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ কিন্তু সামনে আসেনি।  দেশের বাজারে ডিমের এমন আকাশছোঁয়া দাম নেয়া হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক দামে ডিম বিক্রি হচ্ছে। দেশটির ডিমের দাম পর্যালোচনা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি ডিমের দাম ছয় থেকে সাত টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। দিল্লিতে এই দাম আরও কম। নিত্যপণ্যের সঙ্গে দেশের বাজারে আমদানি করা ফলের বাজারেও অস্থিরতা রয়েছে। আমদানি লাগাম টানায় ফলের দাম বেড়ে গেছে অনেক। কোনো কোনো ফলের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর ফলে অনেকে এখন আর ফল কেনার সাহস পাচ্ছেন না। ফলের বাড়তি দামের কারণে বড় পুষ্টি ঘাটতি তৈরি হচ্ছে এমন তথ্যও সামনে আসছে। 

এবার ফিরে আসি পোয়া বাজারে। এই বাজারের চিত্র বলে দেয় একটি নির্ধারিত শ্রেণির মানুষ তাদের খাবারের তালিকা ছোট করে দিচ্ছেন। আগের চেয়ে পরিমাণে কম কিনছেন। এই কম কেনা, কম খাওয়া মানুষরা কিন্তু দেশের অর্থনীতির বড় একটি অনুষঙ্গ। তাদের কেউ গার্মেন্টে কাজ করেন। কেউ কলকারখানার কর্মী। কেউ গৃহকর্মী। কেউ গাড়ি চালান। কেউ ক্ষেতে-খামারে কাজ করেন। কেউবা আবার ছোট চাকরি বা ছোট ব্যবসা করেন। তাদের শ্রমের ঘামে অর্থনীতি সামনে এগোচ্ছে। কিন্তু এই শ্রেণির মানুষরা আর বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে এগোতে পারছেন না। 
এমন বাস্তবতার মাঝে সরকারের একজন মন্ত্রী ভোটের ব্যবসার একটি তত্ত্ব সামনে হাজির করেছেন। তিনি বলেছেন, ব্যবসায়ীরা যেমন ব্যবসা করে রাজনীতিবিদরা ব্যবসা করেন। সেটা ভোটের ব্যবসা। দুই ব্যবসার লক্ষ্যই এক। আর তা হলো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। 

বৃহস্পতিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে অংশ নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ভোটের ব্যবসার এই তত্ত্ব নিয়ে কথা বলেন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ব্যবসার উৎপাদন বৃৃদ্ধিতে একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতি দরকার। পরিবেশ দরকার যাতে ধারাবাহিকভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়। রাজনীতির ক্ষেত্রেও স্থিতিশীল পরিবেশ দরকার। এতে ব্যবসার পরিধি বাড়ে, উৎপাদন বৃৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। একইভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে সামনের দিকে ভালোভাবে এগিয়ে নেয়া যায়।

মন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানে কাজ করছে সরকার। সরকার প্রধান কোনো দেশ সফর করলে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা সঙ্গে থাকেন। হয়তো আমাদের মতো ছোট কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দূরত্ব থাকতে পারে। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ে দূরত্ব নেই। 
মন্ত্রী মান্নান একজন সজ্জন কর্মকর্তা ছিলেন। রাজনীতির মাঠেও তিনি সজ্জন হিসেবে পরিচিত। মাঝে মধ্যেই তিনি সত্য বয়ান করে গণমাধ্যমের শিরোনাম হন। যা সত্য তা অকপটে প্রকাশ করে থাকেন। 

তিনি যে ভোটের ব্যবসার কথা বলেছেন এটিই আসলে সত্য। রাজনীতি এখন একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ভোটের ব্যবসা। এখানে সবাই লাভের চিন্তা করে। এ কারণে বড় বড় ব্যবসায়ীরাও রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে চাইছেন। বড় আমলারা রাজনীতিবিদ হতে চাইছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতিক নেতার মতো বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসতে চাইছেন। আর এ কারণে দেশে আমলা রাজনীতিক বাড়ছে। ব্যবসায়িক রাজনীতিবিদ বাড়ছে। মাঠ থেকে উঠে আসা মানুষের জন্য রাজনীতি করা রাজনীতিবিদের সংখ্যা কমছে। এ কারণেই সাধারণ মানুষের জন্য কথা বলা রাজনীতিবিদের সংখ্যা যে কমে যাচ্ছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এমন বাস্তবতার কারণেই হয়তো বাজার সিন্ডিকেট আরও বড় হচ্ছে। আয় বৈষম্য বাড়ছে। সাধারণের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। মধ্য আর নিম্নআয়ের মানুষের জীবন দিনকে দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। 

আর কয়েক মাসের ব্যবধানে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের মাঠে নামবে।  ভোটের ব্যবসার আসল সময় এটি। বছর বছর দেখা না মেলা নেতারাও মানুষের কাছে যাবেন। এবারের ভোটে তাদের সামনে একটা বড় প্রশ্ন হয়ে আসবে নিত্যপণ্যের দাম। বছরের পর বছর ধরে থাকা সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারার দায়, নানা অজুহাতে যখন তখন বাজার অস্থির করে ক্রেতাদের পকেট কাটা ব্যবসায়ীদের ধরতে না পারার দায় নিয়েও সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারে ভোটের সময়। মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারে এক কেজির জায়গায় পোয়ার এককে ক্রয়ক্ষমতা নেমে আসা নিয়েও। সত্যিকারের ভোটে এসব প্রশ্ন হয়ে উঠতে পারে বড় ফ্যাক্টর।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক/ পিতা ও কন্যার পরিণতি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status