নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
তারকার সংসার, ব্যক্তিগত বলে কী কিছুই থাকবে না?
রেজানুর রহমান
২৫ আগস্ট ২০২৩, শুক্রবারসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ভাবছি রাজ, পরীমনি, অপু, বুবলী, খানসাব, জায়েদ ব্রো এরা না থাকলে বিনোদন সাংবাদিক ভাইদের কি হতো? কথাগুলোর মধ্যে কৌতুকপূর্ণ ইঙ্গিত আছে। কিন্তু কথা তো সত্যি! টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ প্রচার মাধ্যমের সর্বত্র হয় রাজ, পরীমনি, না হয় অপু, বুবলী, শাকিব খান অথবা জায়েদ খানকে নিয়েই যত কথাবার্তা। সকালে এক কথা, বিকালে একই তারকা নিয়ে অন্য কথা প্রচার, প্রকাশ হচ্ছে। রাজ আর পরীমনির কথাই যদি ধরি। প্রেমের বিয়ে। সে কি সখ্যতা। আজীবন দু’জনে দু’জনার... সূর্য পূর্ব দিকে না উঠে পশ্চিম দিকে উঠতে পারে। কিন্তু পরী আর রাজের দাম্পত্য জীবনের সূর্যের বেলায় কোনো নড়চড় হবে না। দাম্পত্য জীবনের সূর্য প্রতিদিন পূর্বদিক থেকেই উঠবে। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল সূর্য উঠছে না। পরী আর রাজ এক সঙ্গে থাকছেন না। চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের মতো করে পরীমনিও প্রচার মাধ্যমে কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, রাজের সঙ্গে তিনি আর থাকতে চান না। অর্থাৎ রাজের সঙ্গে দাম্পত্য জীবন কাটাতে চান না। নেতিবাচক খবর বাতাসের আগে ছোটে। যদিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে বাতাস পেরে উঠতে পারছে না। বাতাসের আগেই নেতিবাচক খবর গোটা পৃথিবীতে পৌঁছে যায়।
রাজ আর পরীমনির বিচ্ছেদ হচ্ছে। এই নিয়ে সংবাদপত্রে মুখরোচক সংবাদ, প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে। টেলিভিশনের পর্দায় খবর প্রকাশের নানান কারিশমা দেখানো শুরু হয়। ভাবটা এমন পরীমনি, রাজ ছাড়া বিনোদন দুনিয়ায় আর কোনো খবর নাই। হঠাৎ শোনা গেল ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে রাজ ছেলেকে আগাম উইশ করার জন্য পরীমনির বাসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু পরীমনি বাসার দরজা খোলেননি। প্রচার মাধ্যমে বেশ গুরুত্ব সহকারে খবরটা প্রচার ও প্রকাশ হলো। বিলাসবহুল হোটেলে জমকালো পরিবেশে ছেলের জন্মদিন পালন করলেন পরীমনি। সেখানে রাজকে দেখা গেল না। এই ঘটনার মাত্র দুই দিন পর পরীমনি আর রাজের আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবির সঙ্গে খবর বের হলো, ভেদাভেদ ভুলে এক হয়েছেন রাজ ও পরীমনি। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই আবার খবর বের হলো রাতে পরীর বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন রাজ। এমন কথাও শোনা গেল রাজের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখেছেন কেউ কেউ। পরীমনি অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রচার মাধ্যমে শিরোনাম হলো- ‘হাসপাতালে পরীমনি, রক্তাক্ত মাথায় রাজকে ঘিরে রহস্য।’ অথচ একদিন আগে তাদেরকে নিয়ে সংবাদের শিরোনাম ছাপা হয়েছিল- ‘পরীর বাসায় রাজ, বললেন, আমরা ভালো আছি, ঠিকঠাক আছি।’
প্রিয় পাঠক, পরী এবং রাজ সিনেমার মানুষ। অথচ তাদের কর্মকাণ্ডে আদৌ কি সিনেমা গুরুত্ব পাচ্ছে? এই যে সকাল-বিকাল নতুন নতুন খবরের জন্ম দিচ্ছেন তারা সেখানে সিনেমা কোথায়? শুধু কী পরী আর রাজই সিনেমাবহির্ভূত সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন তা কিন্তু নয়। শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, বুবলী, জায়েদ খান সহ আরও অনেকে তারকা অভিনয়ের চেয়ে অকাজেই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন? জায়েদ খানের কথা একটু বলি। সুদর্শন নায়ক। ধরা যাক জায়েদ খান আজ থেকে আর সিনেমায় অভিনয় করবেন না। দর্শক তাকে কতোদিন মনে রাখবে? একজন প্রকৃত অভিনেতা- অভিনেত্রীর মূল কাজ হওয়া উচিত ভালো সিনেমায় ভালো চরিত্রে অভিনয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখা। জায়েদ খানের অভিনয় সংক্রান্ত সংবাদ তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে হ্যাঁ তিনি নারীদের কাছে কাক্সিক্ষত পুরুষ। নারীরা তাকে নাকি পাগলের মতো ভালোবাসে, এমন রসালো সাক্ষাৎকারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশ সরগরম। একজন প্রকৃত অভিনেতার কাজ কী এমন রসালো, কৌতুকপূর্ণ সাক্ষাৎকার দেয়া? বিশেষ কোনো সিনেমায় অভিনয়ের জন্য কী জায়েদ খান দর্শকের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন? নায়করাজ রাজ্জাক, কবরী, শাবানা, আলমগীর, ফারুক, ববিতা, সোহেল রানা, ইলিয়াস কাঞ্চন, রোজিনা, নতুন.... আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনের একেকজন উজ্জ্বলতম তারকা।
প্রত্যেকেই আমাদের চলচ্চিত্রের গর্বিত ইতিহাসের অংশ। তারা কোনোদিন অভিনয়ের বাইরের বিষয় অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রচার মাধ্যমে কথা বলতেন না। কারণ তারা অভিনয়কে উপাসনা ভাবতেন। আর হাল আমলের তারকারা না চাইতেই ব্যক্তিগত জীবনের গোপন তথ্য ফাঁস করে দেন। অনেকে ‘ভিউ’ বাড়ানোর জন্যও এমনটা করেন। একটা সিনেমাও হয়তো মুক্তি পায়নি। অথচ নায়ক, নায়িকার পরিচয় দিয়ে নানান কায়দায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে গরম রাখেন। এখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরই জয় জয়কার। তারকা নিজেই সংবাদ বাহক। ইচ্ছে করেই নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হন। আমাদের সংবাদ মাধ্যমের তরুণ প্রতিনিধিরা বুঝে না বুঝে নেতিবাচক সংবাদের প্রতিই দৌড়াতে থাকেন। তাছাড়া তথাকথিত অনলাইন পত্রিকা তো আছেই। তারা মনগড়া সংবাদ তৈরি করে। নেতিবাচক সংবাদ প্রচারেই তাদের মূল উদ্দেশ্য। যেমন পরীমনি আর রাজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কতো ধরনেরই না খবর প্রচার ও প্রকাশ হচ্ছে। ‘সন্তানের ব্যাপারে মুখ খুললেন রাজ ও পরীমনি’- এমন সংবাদ শিরোনামের মানে কী? সন্তান তো রাজ এবং পরীর। কাজেই এই নিষ্পাপ শিশুটিকে নিয়ে মুখ খোলার কি থাকতে পারে? শিরোনামটিই এমন যে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়... এই ভাবনা ছড়াতে সময় লাগবে না।
শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গেই বলছি- আমাদের শিল্পীদের অনেকেই ব্যক্তিগত জীবন আর সিনেমার জীবনকে এক করে ফেলেছেন। অথচ দুটো জীবন একেবারেই আলাদা। একজন জনপ্রিয় তারকা কেন এত ‘ফেলনা’ হবেন। তিনি কেন ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে প্রচার মাধ্যমে কাঁদবেন। ফলে হচ্ছে কী, তারকাদের কাজের চেয়ে ব্যক্তিগত জীবনের নেতিবাচক ঘটনাই প্রচার মাধ্যম লুফে নিচ্ছে। জনপ্রিয় কোনো চিত্রনায়িকা যদি সংবাদ সম্মেলন করে ব্যক্তিগত জীবনের কষ্ট উগলে দিয়ে কাঁদতেই থাকেন তাহলে সেটাই তো বড় খবর। এই যে তারকা কাঁদলেন, তার কান্নার প্রতিই সবার আগ্রহ বাড়বে। তার কাজের প্রতি কারও মনোযোগ থাকবে না। সেজন্যই কথায় বলে- সবার কাছে দৈন্যতা প্রকাশ করবে না। করলে প্রকাশ্যে সবাই তোমার জন্য আহ! উহ! করে সমাবেদনা জানাবে। কিন্তু আড়ালে আবডালে তোমারই বদনাম করবে। কল্পিত নেতিবাচক গল্প ছড়াবে।
আবারো পরীমনি আর রাজের কথায় আসি। এই যে তারা দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রে চোর-পুলিশ খেলায় লিপ্ত হয়েছেন, হয়তো তারা ভাবছেন ভক্তরা তাদের পাশে আছেন। সমবেদনা জানাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে এটাই আসল চিত্র নয়। আসল চিত্র হলো- ভক্তরা অনেক বিরক্ত। মর্মাহত... যে চিত্রটা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য সম্মানজনক নয়।
সার্বিক অর্থে চলচ্চিত্র যদি হয় একটি বৃহৎ পরিবার তাহলে নিশ্চয়ই সেই পরিবারের অভিভাবক আছেন? তাদের উদ্দেশ্যে বিনীত কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই- সত্যিকার অর্থে আমাদের লক্ষ্য কী? অর্থাৎ আমাদের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ কী? কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এফডিসির উন্নয়ন করা হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি বসানো হবে। সেজন্য কি প্রস্তুত আমরা? এই যে নায়ক-নায়িকার সিনেমার বাইরে তাদের পারিবারিক জীবনকে এত বেশি সস্তা করে তুলছেন এ নিয়ে চলচ্চিত্র পরিবারের অভিভাবকদের কী কোনো ভাবনা-চিন্তা নাই? কার কাছে এর জবাব খুঁজবো?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো