নির্বাচিত কলাম
প্রসঙ্গ: গ্রেপ্তার ও রিমান্ড
আইন কী বলে?
আবদুর রহমান জিলানী
২২ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার
বাংলাদেশের জনগণ সার্বভৌম। তাকে আইন আদালত রাজার মর্যাদা দিয়েছে। আর অন্য সকল পদাধিকারী ব্যক্তি জনগণের রক্ষা-কবচ, প্রতিনিধি এবং কখনো বা সেবক। কিন্তু বাস্তবতায় রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র। এমনকি তার আত্মরক্ষার অধিকারও সীমিত। বাংলাদেশের আইন তার প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও সম্পদ রক্ষাকল্পে তার নিজের এবং তার প্রতি সহমর্মী অন্য যেকোনো নাগরিককে ক্ষমতা প্রদান করেছে
গ্রেপ্তার ও রিমান্ড এখন মানুষের কাছে একটি ভীতিকর স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। জবাবদিহিতার জায়গাটিতে যদি সেটির অনুপস্থিতি থাকে তখন মানবাধিকার খুব নাজুক অবস্থায় থাকে। তখন সংবিধান ও আইনের রক্ষক হিসেবে শপথকারী মাননীয় বিচারপতি মহোদয়গণ স্টিয়ারিং ধরতে বাধ্য হন। বেআইনি ও বেপরোয়া গ্রেপ্তার এবং রিমান্ড বিতর্কিত অবস্থায় পৌঁছালে মহামান্য হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট সময়ে সময়ে বহু নির্দেশনা প্রদান করেন। সর্বশেষ বিষয়টি মহামান্য হাইকোর্টের নজরে আনেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) রিট পিটিশন নং-৩৮০৬/১৯৯৮ মূলে।
তৎপর রিটের রেসপন্ডেন্টপক্ষ মহামান্য আপিল বিভাগে সিভিল আপিল নং- ৫৩/২০০৪ দায়ের করেন। আপিলটি ২০১৬ সালের ২২শে মার্চ শুনানি শুরু হয় এবং তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র নেতৃত্বে আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার মহোদয়গণ সমন্বিতভাবে ২০১৬ সালের ২৪শে মে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার জন্য ১০ দফা এবং অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারক এবং ট্রাইব্যুনালের জন্য পালনীয় ৯ দফা নির্দেশনা জারি করেন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- (১) বৈধভাবে আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তিকে আইনানুগ পন্থায় গ্রেপ্তার করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার বিষয়ক একটি স্মারক নোট প্রস্তুত করবেন। সেই স্মারক নোটে গ্রেপ্তারের কারণ, তারিখ ও সময় উল্লেখসহ গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর গ্রহণ করবেন; (২) বৈধভাবে আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তিকে আইনানুগ পন্থায় গ্রেপ্তার করার পর অবশ্যই গ্রেপ্তারকৃতের পরামর্শ অনুযায়ী তার নিকটতম আত্মীয়ের সঙ্গে, অথবা নিকট আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে তার কোনো বন্ধুকে এই গ্রেপ্তারের স্থান, সময় এবং বর্তমান অবস্থান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানাবেন। কিন্তু সেই সময় কোনোক্রমেই ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না; (৩) গ্রেপ্তারের কারণ, যে কর্মকর্তা আইনানুগভাবে গ্রেপ্তারটি করেছেন তার বিবরণ, যে ব্যক্তির দেয়া তথ্য/অভিযোগের উপর ভিত্তি করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার নাম-ঠিকানা এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির আত্মীয় বা বন্ধু, যাকে এই গ্রেপ্তারের বিষয়সমূহ অবহিত করা হয়েছে তার নাম-পরিচয় ইত্যাদি গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা, যার হেফাজতে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি রয়েছেন তার কর্তৃক জেনারেল ডায়েরি (জিডি) তে লিপিবদ্ধ করতে হবে; (৪) আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তার হেফাজতে বা ফৌ: কা: আইনের ধারা-১৬৭ (২) এর অধীনে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে আটক রাখার জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা নথিভুক্ত থাকা অপরিহার্য শর্ত; (৫) বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ধারা-৩ অনুযায়ী আটকাদেশ দেয়া হবে, এই অজুহাতে কোনো আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন না; (৬) আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তিকে আইনানুগভাবে গ্রেপ্তার করার সময় তার নিজ পরিচয় প্রকাশ করবেন। দাবি করা হলে, তিনি তার পরিচয়পত্র গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি এবং গ্রেপ্তারকালীন তথায় উপস্থিত অন্য ব্যক্তিবর্গকেও তা দেখাবেন; (৭) গ্রেপ্তারকালীন সময়ে আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা যদি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির গায়ে কোনো ধরনের আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পান, তাহলে তিনি এই ধরনের আঘাতের কারণ লিপিবদ্ধ করবেন এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। অতঃপর ব্যবস্থা গ্রহণকারী চিকিৎসকের কাছ থেকে একটি মেডিকেল সার্টিফিকেট গ্রহণ করবেন; (৮) কোনো ব্যক্তিকে যদি তার বাসভবন বা কর্মস্থল থেকে গ্রেপ্তার না করা হয়, তবে গ্রেপ্তারকারী আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে থানায় আনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে লিখিতভাবে ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়কে তা অবহিত করবেন; (৯) আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে তার চাহিদা ও পছন্দ মতো একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে অথবা তার নিকটতম আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেবেন; (১০) যখন কোনো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-৬১ অনুযায়ী নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়, তখন আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-১৬৭ (১) অনুসরণে তার ফরোয়ার্ডিং চিঠিতে উল্লেখ করবেন যে, কেন আসামিকে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেও তদন্ত শেষ করা যাবে না। কেন তিনি মনে করেন যে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ বা প্রতিষ্ঠিত। এতদসংক্রান্ত ব্যাখ্যা সংবলিত মামলার কেস ডায়েরি বিপি ফরম নং-৩৮ এর মাধ্যমে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট সমীপে উপস্থাপন করবেন এবং ব্যাখ্যা সংবলিত মামলার কেস ডায়েরি বিপি ফরম নং-৩৮ এর মাধ্যমে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট সমীপে উপস্থাপন করবেন।
ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারক এবং ট্রাইব্যুনালের নির্দেশিকা যাদের অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষমতা রয়েছে:
(ক) আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যদি ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৬৭ (২) অনুযায়ী মামলার কেস ডায়েরিতে সবিস্তার কিছু উল্লেখ না করেই রিমান্ডের জন্য আবেদনসহ কোনো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে উপস্থাপন করে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট অথবা আদালত, কিংবা ট্রাইব্যুনাল সেই ব্যক্তিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-১৬৯ অনুযায়ী মুচলেকা গ্রহণ করে মুক্তি দিয়ে দেবেন; (খ) কোনো আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা যদি গ্রেপ্তার হওয়া কোনো ব্যক্তিকে বিশেষ কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর চেষ্টা করেন, যিনি ইতিমধ্যেই হেফাজতে রয়েছেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারক বা ট্রাইব্যুনাল এই ধরনের কোনো প্রার্থনার অনুমতিই দেবেন না, যদি না অভিযুক্ত/গ্রেপ্তাকৃতকে তার সামনে হাজির করা হয়। অতঃপর এই ধরনের মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত ডায়েরিতে এবং গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য প্রার্থনা যদি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং ভিত্তিযুক্ত না হয়, তাহলে তিনি গ্রেপ্তার প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করবেন; (গ) উপরোক্ত শর্তপূরণ সাপেক্ষে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-১৬৭ (২) অনুসারে যদি হেফাজত আদেশ প্রদানের পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যেও মামলার তদন্ত সমাপ্ত করা না যায় এবং সেই মামলাটি যদি দায়রা জজ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচার্য হয়, তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-৩৪৪ অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারবেন। তবে তার মেয়াদ ১৫ দিনের বেশি হবে না; (ঘ) ফরওয়ার্ডিং লেটার এবং কেস ডায়েরি বিবরণে ম্যাজিস্ট্রেট যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে হেফাজতে আটক রাখার যথেষ্ট কারণ ও যুক্তি রয়েছে, তাহলে তিনি তার বিবেচনা মতে উক্ত ব্যক্তিকে আরও হেফাজতে আটক রাখার আদেশ দিবেন; (ঙ) ম্যাজিস্ট্রেট কোনো ব্যক্তিকে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে আটক রাখার আদেশ দেবেন না, যদি পুলিশ ফরওয়ার্ডিং লেটারে এমন কিছু প্রকাশ পায় যা থেকে মনে হয় যে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে প্রতিরোধমূলক আটক রাখার উদ্দেশ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে; (চ) ম্যাজিস্ট্রেট/ট্রাইব্যুনাল, যার সামনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হাজির করা হয়, তার দায়িত্ব হবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী কাউকে আটকাদেশ প্রদানের পূর্বে তার সকল শর্তসমূহ যথাযথভাবে পূরণ করা হয়েছে, সেই মর্মে সন্তুষ্ট হওয়া; (ছ) ম্যাজিস্ট্রেটের যদি বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য বা কোনো ব্যক্তিকে কারারুদ্ধ করার আইনগত ক্ষমতা আছে এমন কোনো কর্মকর্তা আইনের পরিপন্থি কাজ করেছেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট দণ্ডবিধি ধারা-২২০ অনুসরণে সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন; (জ) যখনই একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে যায়, তখন সেই রিমান্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করা তার দায়িত্ব। কিন্তু পুলিশ রিপোর্টে বা অন্য কোনোভাবে ম্যাজিস্ট্রেট যদি এই সংবাদ পান যে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট একটি মেডিকেল বোর্ড দ্বারা মৃতদেহ পরীক্ষার জন্য নির্দেশ দেবেন। যদি ভিকটিমকে দাফন করা হয়ে যায়, তাহলে তিনি মেডিকেল বোর্ড দ্বারা পরীক্ষার জন্য কবর থেকে মৃতদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দেবেন। অতঃপর মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্টে যদি প্রকাশ পায় যে, মৃত্যুটি নরঘাতক প্রকৃতির, তাহলে তিনি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১৫ ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের জন্য সেই অফিসার, যার হেফাজতে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ বা সেই অফিসারের কমান্ডিং অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেবেন; (ঝ) যদি কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এমন তথ্য আসে যে, পুলিশ হেফাজতে থাকা কোনো ব্যক্তি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ ধারা-২ বর্ণিত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা হেফাজতে মারা গেছেন, তাহলে ভিকটিমকে নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে পাঠাতে হবে নির্যাতনের ক্ষেত্রে, আঘাতের গুরুত্ব নির্ণয় এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে, তার কারণ নিরূপণ করার জন্য। মেডিকেল রিপোর্টে যদি প্রকাশ পায় যে, আটক ব্যক্তিকে নির্যাতন করা হয়েছে বা নির্যাতনের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ধারা ৪ ও ৫ এর অধীনে মামলা দায়েরের অপেক্ষা না করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ (১) (গ) ধারার অধীনে সুয়োমটো অপরাধের বিবেচনা করবেন এবং আইন অনুসারে এগিয়ে যাবেন।
উপরে উল্লিখিত নির্দেশনাসমূহ সাংবিধানিকভাবে বাধ্যকর। কিন্তু একটি বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। তাহলো ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারক এবং ট্রাইব্যুনাল তাদের অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষমতা যদি প্রয়োগ না করেন তাহলে কি হবে? মহামান্য আপিল বিভাগ ৬৪ ডিএলআর (এডি) ২১ এর রায়ের ১৮ দফায় ঘোষণা করেন যে, “যে মুহূর্তে হাইকোর্ট বিভাগ কোনো রায় বা আদেশ প্রদান করেন, তখনই বাংলাদেশ সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের আইন হিসেবে গণ্য হবে, যদি না তার কার্যকারিতা স্থগিত বা বাতিল করা না হয়।” এ ছাড়া মহামান্য আপিল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আবদুল মান্নান খান বনাম বাংলাদেশ [৬৪ ডিএলআর (এডি) ১৬৯] মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি অভিমত প্রদান করেন যে, “যে বিচার ব্যবস্থায় বিচারকগণ সর্বপ্রকার প্রলুব্ধতা, চাপ ও ভয়-ভীতি থাকা সত্ত্বেও সরকার ও অন্য সকল প্রেসার গ্রুপের অভিলাষ ও কর্মপন্থার ঊর্ধ্বে থাকিয়া নির্ভীক ভাবে শুধুমাত্র দেশের সংবিধান ও আইন অনুসারে বিচারিক কার্যক্রম নিশ্চিত করে তাকেই স্বাধীন বিচার বিভাগ বলা যায়।” তিনি উক্ত মামলায় রায়ের ৮৫০ নং দফায় উল্লেখ করেন যে, “কোনো আইন প্রণয়নে যত কারণই থাকুক না কেন, কোনো কারণে বা কোনো অজুহাতে, তাহা যত গুরুত্বপূর্ণই হউক না কেন কখনই জনগণের সার্বভৌমত্ব কাড়িয়া নেওয়া যায় না। জনগণের সার্বভৌমত্ব সকল কারণ, প্রয়োজন ও ওজরের উপরে অবস্থিত। জনগণের কারণে ও প্রয়োজনে সংবিধানও সংশোধন করা যায়।”
উপরোক্ত পর্যালোচনায় সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশের জনগণ সার্বভৌম। তাকে আইন আদালত রাজার মর্যাদা দিয়েছে। আর অন্য সকল পদাধিকারী ব্যক্তি জনগণের রক্ষা-কবচ, প্রতিনিধি এবং কখনো বা সেবক। কিন্তু বাস্তবতায় রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র। এমনকি তার আত্মরক্ষার অধিকারও সীমিত। বাংলাদেশের আইন তার প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও সম্পদ রক্ষাকল্পে তার নিজের এবং তার প্রতি সহমর্মী অন্য যেকোনো নাগরিককে ক্ষমতা প্রদান করেছে। যা ‘আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার’ বলে পরিচিত। দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১০০ ধারায় বলা হয়েছে যে, ৯৯ ধারার শর্ত সাপেক্ষে যেকোনো ব্যক্তি নিম্নলিখিত ক্ষেত্রসমূহে নিজের এবং অপরের দেহরক্ষায় আক্রমণকারীর ওপর প্রয়োজনীয় যেকোনো মাত্রার পাল্টা বলপ্রয়োগ করতে পারেন। তাতে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন না। যেমন, ক) সেই আক্রমণের ধরন যদি এমন হয় যে, তার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু/গুরুতর আহত হওয়ার আশঙ্কার সৃষ্টি হয়; খ) অপহরণ বা গুমের উদ্দেশ্যে আক্রমণ; গ) যখন কোনো ব্যক্তিকে ‘অবৈধভাবে আটক’ করার লক্ষ্যে বলপ্রয়োগ করা হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির মনে যুক্তিসঙ্গতভাবেই এমন আতঙ্কের সৃষ্টি করে যে, সেই ‘অবৈধ আটকাবস্থা’ হতে মুক্তি লাভের জন্য তিনি কোনো বৈধ ও সরকারি কর্তৃপক্ষের সাহায্য পাবেন না। তবে, দণ্ডবিধি’র ধারা-৯৯ এ বলা হয়েছে- (১) কোনো সরকারি কর্মচারী যখন ‘সরল বিশ্বাসে’ কোনো কার্য সম্পন্ন করেন, তখন সেই সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তি আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি দায়িত্ব পালনকারীকে সরকারি কর্মচারী বলে চিনতে, বুঝতে বা বিশ্বাস করতে না পারে, তাহলে অন্যান্য স্বাভাবিক নিয়মের মতোই সে তার আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। কিন্তু দণ্ডবিধি’র ৫২ ধারায় বলা হয়েছে, ১) যথাযথ সতর্কতা ও মনোযোগ ব্যতিরেকে সম্পাদিত কোনো কার্যকেই ‘সরল বিশ্বাসে’ সম্পন্নকৃত কার্য বলে গণ্য করা হবে না। এ ছাড়া, নজির আছে যে, ক) শুধুমাত্র সেই কাজকেই ‘সরল বিশ্বাসে’ সম্পন্নকৃত কার্য বলে গণ্য করা হবে, যে কার্যটি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। [জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট ১৮৯৭ এর ধারা: ৩ (২২); এআইআর ১৯৫৫ ক্যাল ৩৫৩], এবং খ) সাক্ষ্য আইনের ৩৮ ও ৮৪ ধারা প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অসৎ উদ্দেশ্যমূলকভাবে আইন বর্ণিত বিধানের লঙ্ঘন ঘটিয়ে কোনো কাজ করে, তবে তা ‘সরল বিশ্বাসে’ কৃত কাজ বলে গণ্য হয় না। [এ.আই.আর (১৯৬৯) ১২১]।
আইন তাহলে কী বলে? দেশের প্রচলিত আইনপ্রয়োগের পদ্ধতি ও উপায় সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পালন প্রতিটি আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য বাধ্যতামূলক। এই প্রতিপালনের ইচ্ছাকৃত ত্রুটি বা গাফিলতি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
লেখক: সাবেক এডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
পাঠকের মতামত
এইগুলো তো কিতাবে আছে ,বাস্তবে কি হয় ??বিচারপতিদের দেয়া এই নির্দেশনা ঠিক মতো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না সেটা দেখার দায়িত্ব তো বিচার বিভাগের ।তারা কি তা ঠিক মতো পালন করছে । বরংচ বিচারপতিদের বিভিন্ন রায় এবং বক্তব্য নিয়েই দেশে এখন ব্যাপক আলোচনা চলছে