নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
সেবার মূলমন্ত্র মানসিকতা
মহিউদ্দিন আহমেদ
১৩ আগস্ট ২০২৩, রবিবার
পরিশেষে, মানুষের সেবা করার ক্ষেত্রে ইহসান অবলম্বন করা শ্রেয়, ইহসান অর্থ ভালোভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করা, উত্তম রূপে কাজ আদায় করা এবং সদয় আচরণ করা। ইসলামে আদল বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ প্রাপ্য টুকুন আদায় করার আদেশ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ইহসান অবলম্বনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কতোটা দায়িত্ব ও সহানুভূতি নিয়ে কাজ করলে উত্তমভাবে কাজ সম্পন্ন হবে, তা প্রত্যেক সেবাদাতা জানেন। উত্তম সেবা সাধারণত মূল্যসাপেক্ষ, কিন্তু সেবার মূল্য আল্লাহর কাছে আশা করলে আল্লাহ যা দিবেন তা হবে অনন্য সাধারণ ও অতুলনীয়। নৈতিকতা, গ্রাহক সেবা, মানব সেবা সবকিছু ইহসানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যভাবে বলা যায়, ভোক্তা হিসেবে আমি যেমনটা প্রত্যাশা করি, তেমনটাই অন্যের জন্য নিশ্চিত করা, এটাই উত্তম সেবা।
সেবা মানে কাউকে সাহায্য করা বা কাজ করা। সেবা মোটা দাগে তিন ধরনের- ব্যবসায়িক সেবা, সমাজ সেবা এবং ব্যক্তিগত সেবা। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রেস্তরাঁ, ব্যাংক, বীমা, টেলিযোগাযোগ সর্বত্রই সেবা অবিচ্ছেদ্য অংশ। উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ এখন ঘরে বসেই খাবার অর্ডার করতে পারছে, গাড়ি ভাড়া করতে পারছে, টিকিট কাটতে পারছে, পণ্য বিক্রি করতে পারছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করছে- এগুলো বাণিজ্যিক সেবা, যেখানে অর্থ-যোগ থাকে। বয়স্ক ভাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, কাবিখা/কাবিটা/টি আর, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, সেলাই মেশিন বিতরণ, সরকারি শিশু পরিবারে এতিম শিশু পরিপালন ও পুনর্বাসন, করোনা পরবর্তী প্রণোদনা ইত্যাদি সরকারি উদ্যোগে সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত।
কিছু সেবা নেয়ার জন্য মানুষকে সরকারি দপ্তরে যেতেই হয় যেমন- পাসপোর্ট, এনআইডি, পেনশন, চাকরি, রাজউক অনুমোদন, লাইসেন্স সংগ্রহ, সম্পত্তি নিবন্ধন ইত্যাদি। ভালো ও তিক্ত যেকোনো প্রকার অভিজ্ঞতায় এইসব প্রতিষ্ঠানের বিকল্প কোনো বেসরকারি উদ্যোগ সম্ভব নয়। তবে টেলিটকের পরিবর্তে অন্যান্য অপারেটরের টেলি সংযোগ নেয়া যেতে পারে, বুকের ব্যথা নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের গেটে অপেক্ষা করতে না চাইলে সামর্থ্য অনুযায়ী কোনো বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া যেতে পারে। আবার ভোলায় কৃষি মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ‘শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে’ মন্তব্যের পর কেউ যদি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন, তবে অভিভাবক চাইলে সন্তানকে বেসরকারি বা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা কলেজে ভর্তি করাতে পারেন। তবে সাম্প্রতিক কালে ঢাকার প্রাণ কেন্দ্রের নামকরা এক হাসপাতালে নবজাতক শিশুসহ ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী মাহবুবা রহমান আঁখির অকাল নির্মম মৃত্যু বেসরকারি খাতের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আবারো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নিকট অতীতেও বাংলাদেশে করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতালকে অনুমোদন ও তারপর করোনা শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া জালিয়াতিসহ চিকিৎসার নামে চরম দুর্নীতির চিত্র সরকারি তদন্তে উঠে আসে। সরকারি এবং বেসরকারি যেকোনো ক্ষেত্রেই উন্নত উপকরণ, উন্নত অবকাঠামো এবং অর্থের যথেষ্ট প্রবাহ থাকলেও সেবার গুণগত মান উন্নয়নে সেবাপ্রদানকারীর সেবামূলক মানসিকতা এবং দায়িত্বশীলতা একান্তভাবে জরুরি বলে মনে করেন সেবা খাতের বিশ্লেষকরা। সরকারি সেবাপ্রদানকারী সংস্থাগুলো দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য সর্বসাধারণের জন্য সিটিজেন চার্টার্র প্রণয়ন করেছেন এবং প্রত্যেক দপ্তরে দৃশ্যমান রেখেছেন। ভোক্তাদের অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংস্থা নিয়মিত বাজার তদারকি করছেন এবং ভোক্তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তি করছেন। এত উদ্যোগের পরও সেবার মান কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নীত হয়নি এমনটাই ভোক্তাদের অভিমত, এবং বিশ্লেষকরা এর জন্য সেবা দেয়ার মানসিকতার উন্নয়নকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। সেবা যেমন, অদৃশ্য সেবার সর্বোচ্চ পরিধিও অলিখিত। স্থান, কাল, পাত্র এবং অঘোষিতভাবে সেবাদাতার মানসিকতার ওপরও সেবার মান ও পরিধি নির্ভর করে।

সাম্প্রতিককালে ঢাকা-১০ উপনির্বাচনে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সুবাদে দেখা যায় প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে পুলিশের সামনেই দুর্বৃত্তদের হেনস্তার শিকার হন এবং একপর্যায়ে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা উনাকে নিরাপত্তা দিয়ে কেন্দ্রের বাইরে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে কেন্দ্রের বাইরে হিরো আলমকে বেধড়কভাবে পেটানো হয়, মিডিয়াকর্মীরা উক্ত পুলিশ কর্মকর্তার কাছে এই ব্যাপারে জানতে চাইলে উনি বলেন, পুলিশের দায়িত্ব কেন্দ্রের বাইরে ছিল না। নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও হিরো আলমকে কেন্দ্রের বাইরে পাঠিয়ে দেয়াটা যৌক্তিক হয় নাই, অনেকেই এমনটা মন্তব্য করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে।
অপরদিকে উচ্চ মানসিকতার সেবার পরিচয় দিয়েছেন পুলিশ বাহিনীরই সদস্য কনস্টেবল আব্দুর রহমান এবং কনস্টেবল পরাণ সরকার, যাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই দেখেছেন মাথায় পোড়া কাপড়ের বস্তা এবং মুখে বাঁশি- এই রকম একটি ছবিতে। পুলিশ সদস্য পরাণ জানান, ঢাকার নিউ মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনায় উক্ত পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব ছিল উৎসুক জনতাকে সরানো এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। তবে আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যবসায়ীদের আর্তনাদ দেখে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতিক্রমে অস্ত্র জমা রেখে আটকে পড়া দোকানি এবং কাপড় উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এভাবেই সেবাকে যারা পরম ধর্ম হিসেবে নিয়েছেন তাদের একজন ডা. কামরুল ইসলাম, যিনি সঞ্চিত অর্থ দিয়ে গাড়ি না কিনে ডায়ালাইসিস মেশিন কিনেছিলেন, গড়ে তুলেছেন কিডনি বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং বিনা পারিশ্রমিকে হাজারেরও বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন এবং সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই রেখেছেন কিডনি প্রতিস্থাপনের চিকিৎসা খরচ। স্বাস্থ্য খাতে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পদক-২০২২ এ ভূষিত করেন।
ক্ষুদ্রঋণের দ্রুততম প্রসার ঘটিয়ে Best Growing Micro-Finance Bank হিসেবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গ্লোবাল ইকোনমিক অ্যাওয়ার্ড-২০২২ অর্জন করেছে বাংলাদেশের ৪র্থ প্রজন্মের ব্যাংক এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। প্রান্তিক মানুষদের উদ্যেক্তা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০২১ সালে এই ব্যাংকটি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করেন, যার আওতায় বিনা জামানতে ৫ থেকে ৯ শতাংশ সুদে গত দুই বছরে প্রায় ৬৪ হাজার গ্রাহককে ২৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং এর ফলে প্রায় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মাইক্রোফাইন্যান্স বা ক্ষুদ্রঋণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এক ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক আর্থিক সেবা, কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংক ছোট ছোট ঋণের পেছনে সময় না দিয়ে কোনো এনজিওকে সরাসরি বড় অঙ্কের ঋণ দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেই ক্ষেত্রে এনজিওগুলো ২৫-৩০% সুদে মাঠ পর্যায়ে ঋণ সরবরাহ করে, ফলে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারে না গ্রামের কৃষক বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা, এনআরবিসি ব্যাংক মাত্র ১০ বছরের পুরনো একটি ব্যাংক হয়েও এই আর্থিক সেবাটির উপর জোর দিয়েছে।
গহীন খাগড়াছড়িতে ব্যতিক্রমী সেবা দিচ্ছেন ‘সমৃদ্ধ দীঘিনালা’ কারিগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, দীঘিনালা, মুহাম্মদ আরাফাতুল আলম। শিশুরা উনার হাতে একটি নতুন ফুটবল বা বই উপহার পাবে বলে ছড়া মুখস্ত করে উনাকে শুনাচ্ছেন, উনি শুনছেন, সাহিত্য মেলা করছেন, পাঠাগারে বই দিচ্ছেন, রোবোটিক্সে হাতেখড়ি দিচ্ছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে সুরে সুরে পড়ছেন, ‘হাটে যাবো হাটে যাবো ঘাটে নেই নাও, নি-ঘাটা নায়ের মাঝি আমায় নিয়ে যাও।’ এই শিশুগুলোর একজন সপ্তর্ষি বড়ুয়া নিশির ‘এইম ইন লাইফ’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া।
সেবা খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম দুইটি খাত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য, কিন্তু সরকারি চাকরিতে গ্রেডিং ব্যবস্থায় ‘ভারসাম্যহীন মর্যাদা’ অস্বস্তিতে রেখেছে অনেকদিন ধরেই, যা মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসে পড়ে। শিক্ষকদের অসহায়ত্ব আরও ফুটে ওঠে যখন, বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে ছাত্ররা পড়া না পারলে শিক্ষা কর্মকর্তা শিক্ষককে ছাত্রদের সামনেই ধমকান, কলেজে পরীক্ষা হলে দায়িত্ব পালনের সময় শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষককে ছাত্রদের সামনেই জবাবদিহি করতে হয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে ‘আপা’ বলার কারণে অপমানিত হতে হয়। এই শিক্ষার্থীরা কেউ তাদের বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম পছন্দ শিক্ষকতা দিবে না বলে সহজে অনুমান করা যায়। সেবা খাতগুলোকে অবহেলা করলে সেবার মান ক্রমে অবনতি হতে বাধ্য। সম্প্রতি বিসিএসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩৫তম থেকে ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে ১৯৮০ জনের মধ্যে ৩৮৭ জনই প্রকৌশল ও চিকিৎসক। প্রকৃচির (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যসচিব এবং বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরীর মতে, ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের কারণে মেধাবী চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্রসহ সাধারণ ক্যাডারের দিকে ঝুঁকছেন।’ আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ১০ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। যাদের বাস্তবায়ন করার কথা, তারাই চান না এই বৈষম্য দূর হোক। এভাবে বৈষম্য চলতে থাকলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র চিকিৎসক ও প্রকৌশলীশূন্য হয়ে যাবে। ‘তবে মেধাবীদের সরকারি চাকরিতে যোগদানও ইতিবাচক এবং সরকারের উদ্ভাবনী সেবা প্রদানের উদ্যোগ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আশা করা যায়।’
পরিশেষে, মানুষের সেবা করার ক্ষেত্রে ইহসান অবলম্বন করা শ্রেয়, ইহসান অর্থ ভালোভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করা, উত্তম রূপে কাজ আদায় করা এবং সদয় আচরণ করা। ইসলামে আদল বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ প্রাপ্য টুকুন আদায় করার আদেশ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ইহসান অবলম্বনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কতোটা দায়িত্ব ও সহানুভূতি নিয়ে কাজ করলে উত্তমভাবে কাজ সম্পন্ন হবে, তা প্রত্যেক সেবাদাতা জানেন। উত্তম সেবা সাধারণত মূল্যসাপেক্ষ, কিন্তু সেবার মূল্য আল্লাহর কাছে আশা করলে আল্লাহ যা দিবেন তা হবে অনন্য সাধারণ ও অতুলনীয়। নৈতিকতা, গ্রাহক সেবা, মানব সেবা সবকিছু ইহসানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যভাবে বলা যায়, ভোক্তা হিসেবে আমি যেমনটা প্রত্যাশা করি, তেমনটাই অন্যের জন্য নিশ্চিত করা, এটাই উত্তম সেবা।
পাঠকের মতামত
السلام عليكم ورحمة الله وبركاته . সেবা গ্রহীতাদেরও করণীয় আছে। শুধু একপাক্ষিক সেবা পাওয়ার আশা করা "সমাজ ব্যবস্থা ধ্বসে পড়ার" কথাই বলছে।