নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
ডেঙ্গু নিয়ে রাক্ষস ও খোক্কসের সহজ সরল কথাবার্তা
রেজানুর রহমান
১২ আগস্ট ২০২৩, শনিবার
রাক্ষস: বুকে সাহস রাখ। বাংলাদেশের যা পরিস্থিতি তাতে চিন্তার কারণ নাই। এই দেশের মানুষ মুখে যা বলে বাস্তবে সবাই তা করে না। টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় প্রতিদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা বলে, পরামর্শ দেয়; কিন্তু কেউ পরামর্শ শোনে না। আমাদের এই বাড়ির মালিকের কথাই ধর। গতকালই একটি টেলিভিশনের টকশোতে বলেছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হলে ব্যক্তিপর্যায়েও আমাদের কিছু দায় ও দায়িত্ব আছে। সরকার সবকিছু করে দেবে না। আমাদেরকেও দায়িত্ববান হতে হবে। টবে পানি জমিয়ে রাখবেন না। ডাবের খোসায় যাতে পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে সচেতন থাকবেন।
বাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি জমতে দেবেন না। অথচ তার বাড়ির জানালার কার্নিশে টবের পানিতে আমরা দিব্বি সুখে আছি।বিজ্ঞাপন
এডিস, একটা ছোট মশার কাছে মানুষ কতো অসহায়। মানুষের তুলনায় এডিস মশা কতোই না ছোট। মানুষ তার হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে পিষে এডিস মশাকে মারতে পারে। অথচ এই অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর জন্য মানুষের কতো ভয়। এডিস মশার বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধে নেমেছে মানুষ। প্রতিদিন এডিস এবং ডেঙ্গু খবরের শিরোনাম হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু-সংবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার ও প্রকাশ করা হচ্ছে। ৮ই আগস্টের খবর, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা এ যাবৎকালের রেকর্ড ভেঙেছে। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালেই মারা গেছেন ২৫৮ জন। অর্থাৎ ডেঙ্গু জ্বরে ঢাকায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ঢাকাকে আমরা আদর করে বলি তিলোত্তমা। দেশের মানুষের কাছে রাজধানী ঢাকা মানেই স্বর্গ। জীবনে কিছু একটা হতে চাইলে ঢাকায় আসতেই হবে। ঢাকা শহর ছাড়া অন্য কোনো গতি নাই। প্রতিদিন ঢাকার বিভিন্ন রেলস্টেশন, লঞ্চ ঘাট, বাস টার্মিনালে দাঁড়ালেই ঢাকায় আসা মানুষের স্রোত চোখে পড়ে। বেকাররা আসেন ঢাকায়। চাকরি না পেলেও রিকশা তো চালানো যাবে। ঢাকার রাস্তায় হাত পাতলেই নাকি টাকা। আর তাই অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে। ভিক্ষা অনেকের পেশা। ঢাকা শহরে ভিক্ষুকদের নাকি সংগঠনও আছে। ১০ টাকার নিচে ভিক্ষা দেয়া যাবে না এমন দাবিও নাকি আছে ভিক্ষুক সংগঠনের।
ঢাকা স্বপ্নের নগরী। ঢাকায় টাকা উড়ে। সে কারণেই বোধকরি গান লেখা হয়েছে- ঢাকা শহর আইস্যা আমার আশা পুরাইছে... অথচ বাস্তবে ঢাকার জীবনযাত্রা দিনে দিনে কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। সামান্য এডিস মশার কাছে অসহায় ঢাকার মানুষ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন শুধুমাত্র মশক নিধনের নিমিত্তে বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। ঘটা করে ওষুধ ছিটায়। কিন্তু মশা মরে না; বরং ওষুধ ছিটানোর পর মশা যেন আরও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। কী, মানুষের এতবড় সাহস মশাকে মারতে চায়...!
বর্ষাকালে ডেঙ্গুর দৌরাত্ম্য বাড়বে একথা বহু আগে থেকেই বলা হয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার কী করণীয় সেটাও মিডিয়ায় প্রচার-প্রকাশ হচ্ছে প্রতিদিন। এডিস মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে মানুষ। অথচ এডিস মশা যেন নির্বিকার। মানুষকে মোটেই পাত্তা দিচ্ছে না।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় কী? সহজ উত্তর, নিজেকে নিজেদেরকে পরিষ্কার রাখা। আগে ভাবা হতো এডিস মশা ময়লা পানিতে বংশ বিস্তার করে। এখন সেই ভাবনার পরিবর্তন এসেছে। জমিয়ে রাখা স্বচ্ছ পানিতেও এডিস মশা তার বংশ বিস্তার করতে পারে। আগে ভাবা হতো এডিস মশা দিনে কামড়ায় না। দিনে নাকি ঘুমায়। এখন সে ধারণাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এডিস মশা দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টাই মানুষকে কামড়ায়। রক্ত খায়। প্রতিরোধের সহজ উপায় নিজেদের চারপাশটা পরিষ্কার রাখা। কোনো কারণ ছাড়া পানি যেন দীর্ঘদিন কোনো পাত্রে জমে না থাকে তা নিশ্চিত করা। গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, বাড়ির ছাদে যেন পানি জমে না থাকে তা নিশ্চিত করা। বসতবাড়ির আশপাশে ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার রাখা। মোটকথা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের উত্তম পদক্ষেপ। এজন্য অর্থের কোনো প্রয়োজন নাই। শুধু প্রয়োজন সতর্কতা। কিন্তু আমরা কি আদৌ সচেতন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী কী করা দরকার আমরা কম-বেশি সকলেই জানি। কিন্তু মানি কতোজন? নগরের মশা নিধনের মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। নগরের বিভিন্ন এলাকার পরিত্যক্ত ডোবা, নালা, খাল-বিলে মশার প্রজনন বেশি হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে এইসব জায়গায় মশা নিধন সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশনেরই মূল দায়িত্ব। কিন্তু নিজের বাড়ির ছাদ, বারান্দার টব, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ারে যাতে মশার প্রজনন বাড়তে না পারে তা নিশ্চিত করা বাড়ির মালিক, ভাড়াটেদেরও দায়িত্ব। কিন্তু আমরা অনেকেই এই দায়িত্ব পালনে আগ্রহ দেখাই না। ভাবটা এমন মশা মারা কি আমার কাজ? এই কাজ তো সিটি করপোরেশনের। ট্যাক্স দেই। কাজেই সিটি করপোরেশনের নিকট থেকে মশা নিধন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়ার অধিকার আমার আছে। হ্যাঁ, এই কথার মধ্যে যুক্তি আছে। নগরের মশা নিধন করা সিটি করপোরেশনের অন্যতম দায়িত্ব। এজন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিটি করপোরেশন। তবুও কেন ঢাকা শহর মশকমুক্ত হচ্ছে না সেটাই প্রশ্ন। পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্নও থেকে যায় সেটা হলো সিটি করপোরেশন কি নগরের প্রতিটি বাড়ির ছাদ, পরিত্যক্ত টায়ার, বারান্দার টব, ডাবের খোসায় জমে থাকা পানিও সরানোর কাজ করবে? এটা কি আদৌ সম্ভব?
কয়েকদিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে নগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ থানার চিত্র দেখলাম। থানা ভবনের পেছনে পরিত্যক্ত গাড়ি, ট্রাকের ভাগাড় তৈরি হয়েছে। এই সব পরিত্যক্ত বাহনের বিভিন্ন অংশে জমে থাকা পানিতে মশারা যেন উৎসব করছে। থানার মূল ফটকে মাস্ক পরে ডিউটি করছেন একজন সেপাই। পকেট থেকে একটি শিশি বের করে বললেন, মশার রাজত্বে বাস করি। মাঝে মাঝে শরীরে এই লোশন মাখি। তবুও মশারা ভয় পায় না। ডেঙ্গু মশা বেশ চালাক...
বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহও বললেন, এডিস মশা তার চরিত্র বদল করে ফেলেছে। আগে ভাবা হতো ময়লা পানিতে এডিস মশার প্রজনন বাড়ে। এখন দেখছি স্বচ্ছ পানিতেও এডিস মশার প্রজনন বাড়ছে। কাজেই বাসার ছাদে, বারান্দার টবে, ডাবের খোসায় পরিত্যক্ত টায়ারে যাতে পানি জমে না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বরের প্রকোপ বেশি হলেই ডেঙ্গু টেস্ট করতে হবে। তরল খাবার ও তাজা ফলের জুস খাবেন। বিশ্রামে থাকবেন।
আমরা বোধকরি দিনে দিনে সুযোগ-সন্ধানী জাতিতে পরিণত হচ্ছি। শরীরে জ্বর দেখা দিলেই ডেঙ্গু টেস্ট করিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই টেস্টের ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বৈষম্য। ডেঙ্গু টেস্টের ফিসের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ডাবসহ তাজা ফলের জুস ডেঙ্গু রোগীর প্রধান খাদ্য। সংকটাপন্ন রোগীর জন্য স্যালাইনের প্রয়োজন হয়। সুযোগ-সন্ধানীরা সুযোগ বুঝে ডাবের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাজা ফলের দাম বেড়েছে। স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ মূল্যে। অনেক জায়গায় স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না।
করোনার সময় চিকিৎসার নানা ক্ষেত্রে দেশব্যাপী একটি অসাধু চক্র সচতুরভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অর্থের পাহাড় গড়েছে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও ওই একই চক্র সক্রিয়। দেশে বিশেষ কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেই সুযোগ-সন্ধানীরা মহাউৎসাহে সাধারণ মানুষকে ঠকানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। মানুষের এসব কর্মকাণ্ড দেখে মশারাও বেশ বিরক্ত। আসুন দুই এডিস মশার কথপোকথন শুনি।
ধরা যাক, একজনের নাম রাক্ষস, অন্যজনের নাম খোক্কস। সবেমাত্র সিটি করপোরেশনের একজন কর্মী মশা মারার ওষুধ ছিটিয়ে চলে গেছে। ওষুধ ছিটানোর মেশিনের ভয়ঙ্কর শব্দ শুনে ছাদের কার্নিশে রাখা টবে মরার মতো পড়েছিল রাক্ষস আর খোক্কস। মেশিনের শব্দ কমে যাবার পর তারা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়।
রাক্ষস: মেশিনটা যেভাবে শব্দ করলো তাতে তো আমি বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
খোক্কস: আমিও। বাপরে বাপ, কী ভয়ঙ্কর শব্দ! তবে ভাগ্য ভালো ওষুধটা আসল নয়, ভেজাল ওষুধ। আসল ওষুধ ছিটালে তো এতক্ষণে আমাদের দফা রফা হয়ে যেতো।
রাক্ষস: তুই ঠিকই বলেছিস। মেশিন যেভাবে আওয়াজ করলো ওষুধ সেভাবে আওয়াজ করলো না। ভেজাল জিনিসের কোনো শক্তি নাই।
খোক্কস: তবুও হ্যারা ভেজাল ওষুধ ছিটাইলো ক্যান? এই জন্য তাদের শাস্তি হবে না?
রাক্ষস: না। শাস্তি হবে না। এই দেশে ভেজালকারীদের সহজে শাস্তি হয় না।
খোক্কস: বলো কি? এইটাতো ঠিক না। অন্যায়ের শাস্তি না হইলে অন্যায় তো বাড়তেই থাকবে।
রাক্ষস: (ধমক দিয়ে) চুপ কর। অন্যায় আছে বইল্যাই তো আমরা বাইচ্যা আছি। এই দেশে মহাসুখে আছি। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব জায়গায় আমাদের খবর। যদিও আমাদের আসল নামটা কেউ বলে না। সবাই বলে ডেঙ্গু। আরে ভাই ডেঙ্গু তো অসুখের নাম। আমরা এডিস মশা তার বাহক। কৃতিত্ব আমাদের। অথচ প্রচার মাধ্যমে আমাদের নাম বলে না।
খোক্কস: ভাই তোমার কি মনে হয়, আমরা শেষপর্যন্ত বাঁচবো তো?
রাক্ষস: বুকে সাহস রাখ। বাংলাদেশের যা পরিস্থিতি তাতে চিন্তার কারণ নাই। এই দেশের মানুষ মুখে যা বলে বাস্তবে সবাই তা করে না। টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় প্রতিদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা বলে, পরামর্শ দেয়; কিন্তু কেউ পরামর্শ শোনে না। আমাদের এই বাড়ির মালিকের কথাই ধর। গতকালই একটি টেলিভিশনের টকশোতে বলেছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হলে ব্যক্তিপর্যায়েও আমাদের কিছু দায় ও দায়িত্ব আছে। সরকার সবকিছু করে দেবে না। আমাদেরকেও দায়িত্ববান হতে হবে। টবে পানি জমিয়ে রাখবেন না। ডাবের খোসায় যাতে পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে সচেতন থাকবেন। বাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি জমতে দেবেন না। অথচ তার বাড়ির জানালার কার্নিশে টবের পানিতে আমরা দিব্বি সুখে আছি। হা: হা: হা:.... আজ আমাদের একটাই কাজ হবে রক্ত খাওয়া। মানুষের রক্ত....
মশারূপী রাক্ষস-খোক্কসের কথপোকথন আরও বাড়ানো যায়। তবে আগ্রহ পাচ্ছি না। বলে কী লাভ? কেউ কি কথা শোনে? ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনা চলবে। মানুষের মৃত্যু কোনো ব্যাপার না। কারণ এই দেশে সবকিছুর দাম আছে, মানুষেরই দাম নাই। এটাই সত্যি!
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।