নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
কেন বাড়ছে অজানা ভয় আর আতঙ্ক?
রেজানুর রহমান
২১ জুলাই ২০২৩, শুক্রবারআমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ রাজনৈতিক আন্দোলনেরই ফসল। রাজনীতিই এই দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিরূপণ করে। এ জন্য দেশের রাজনীতিবিদদের প্রতি দেশের মানুষের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। যেকোনো দুর্যোগ, দুর্বিপাকে এলাকার একজন রাজনীতিবিদ সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেই পরিস্থিতি মোকাবিলার অদম্য সাহস ও শক্তির সঞ্চার হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই আশা ভরসার আশ্রয়স্থল। বর্তমান সময়ে কী সেই আস্থা ও ভরসার জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে? পরিবারে সংকট থাকে। বিরোধও সৃষ্টি হয়। বিরোধ মেটাতে প্রতিবেশীর সহযোগিতারও প্রয়োজন হয়
রিকশা ছুটছে। হঠাৎ দীর্ঘ যানজটে আটকে গেল। পরিস্থিতি দেখে মনে হলো সহসা এই যানজট ছোটার সম্ভাবনা কম। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আকাশের মুখ ভার। বৃষ্টি নামতে পারে। রিকশাচালক তার ঘাড়ে ঝুলানো গামছা দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকালেন। কিছু বলতে চান। বোধকরি সাহস পাচ্ছেন না। তাকে জিজ্ঞেস করলাম- চাচা কিছু বলবেন? রিকশাচালক একটু যেন চমকালেন। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ বাবা আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
প্রশ্ন?
হ্যাঁ।
বলেন।
রিকশাচালক তার গামছা দিয়ে আবার মুখ মুছলেন। মনে হলো আমাকে প্রশ্ন করবেন কি করবেন না- এই নিয়ে একটু দ্বিধায় আছেন। অভয় দিলাম।
চাচা কি যেন বলবেন, বলেন।
রিকশাচালক সাহস করে প্রশ্নটা করলেন- স্যার, দ্যাশটাতো আমাদের নাকি?
আমার যেন একটু খটকা লাগলো। আগে পিছে কোনো কথা নাই হঠাৎ দেশ নিয়ে প্রশ্ন কেন? তাও আবার কঠিন প্রশ্ন। দেশটা কি আমাদের?
রিকশাচালক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার উত্তরের অপেক্ষা করছেন। মৃদু হেসে বললাম- হ্যাঁ দেশটা তো আমাদেরই...।
তাহলে বিদেশিরা এত খবরদারি করে ক্যান? তাদের ভাবসাব, আচার আচরণ দেইখ্যা তো মনে হয় দ্যাশটা আমাদের না। এক একজনের এক এক ছবক। মনের ভেতর একটা ভয় ঢুইক্যা গ্যাছে স্যার। আবার কি কোনো গ্যাঞ্জাম শুরু হইবো? জ্বালাও পোড়াওয়ের গ্যাঞ্জাম? এই তো সেইদিন সরকার, বিরোধী দল পাশাপাশি কর্মসূচি দিলো। ঢাকা শহর অচল হইয়া গেল। রিকশা চালাইতে পারি নাই। আমরা স্যার, দিনে আনি দিনে খাওয়া মানুষ। একদিন আয়- রোজগার বন্ধ থাকলে চুলা জ্বলে না। পরিবেশ, পরিস্থিতি দেইখ্যা তো মনে হইতেছে আমাদের কপালে দুঃখ আছে। আমাদের দ্যাশের সমস্যা কি আমরাই মিটাইতে পারি না? বিদেশিগো দরকার কি?
প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন বয়স্ক রিকশাচালক। মনে হলো একটু হাঁফাচ্ছেন। উত্তর খোঁজার অপেক্ষায় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী উত্তর দিবো তাকে?
রিকশাচালকের কথা শুনে আমি যারপর নাই বিস্মিত, অবাক হলাম। মনে হলো এই লোক সেই অর্থে অর্থাৎ রিকশাওয়ালা অর্থে অশিক্ষিত নন। বেশ শিক্ষিত। রাজনীতি বোঝেন। জিজ্ঞেস করলাম- চাচা আপনার বাড়ি কোথায়? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে লেখাপড়া জানেন। রিকশা চালান কেন? উত্তরে রিকশাওয়ালা বললেন, আমার বাড়ি বাবা কুড়িগ্রামের একটি চর এলাকায়। চরের নাম চরযাত্রাপুর। লেখাপড়ায় বেশি দূর আগাইতে পারি নাই। ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়ছি। ঢাকায় আসছি ৩০ বছর আগে। মতিঝিলে একটি বেসরকারি অফিসে দারোয়ানের চাকরি করতাম। করোনার কারণে অফিসটা বন্ধ হয়ে যায়। চাকরি হারাই। আমার ফ্যামিলি আগে ঢাকায় ছিল। চাকরি হারানোর পর ফ্যামিলিকে গ্রামে পাঠাইয়া দিছি। এখন আমি রিকশা চালাই। প্রতিদিন আমার রিকশায় নানান কিসিমের মানুষ উঠে। নানান কথা বলে। রাজনীতিরও আলাপ করে অনেকে। আমি শুধু শুনি। বিভিন্ন জনের রাজনীতির আলাপ শুনে আমার বুকের ভেতর ভয় ঢুইক্যা গেছে। জ্বালাও পোড়াও, হরতালের ভয়। তাইলে তো দ্যাশটা আবার পেছনের দিকে যাবে। সেইটা কি স্যার ভালো হবে?
যানজট ছুটে গেছে। মনে হলো রাস্তায় অপেক্ষমাণ গাড়িগুলো কে কার আগে যাবে তার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। অযথা হর্ন বাজাচ্ছে অধিকাংশ গাড়ির ড্রাইভার। রিকশাচালক রিকশার প্যাডেল চালাতে শুরু করলো। রাস্তার কোলাহল, গাড়ির হর্নের যন্ত্রণায় আমাদের মধ্যে আর কোনো কথা হলো না।
অফিসে এসে নিজের রুমে বসে রিকশাওয়ালার কথাই ভাবছি। বেশ কিছুদিন ধরে রিকশাওয়ালা যে কথাগুলো বলেছেন আমিও সে কথাগুলোই ভাবছি। সরল মনে সরল অঙ্ক। দেশ আমাদের। অথচ আমাদের জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হবে তার নির্দেশনা দিচ্ছে অন্যদেশের মানুষ। এমন না যে, আমরা জাতীয় নির্বাচন কীভাবে করতে হয় তা জানি না। আমাদের একটি নির্বাচন কমিশন আছে। এই কমিশনের অধীনেই অতীতে জাতীয় পর্যায়ের সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মানে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। জাতীয় নির্বাচন কতোটা নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে তা পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা প্রতিবেশীদের আমন্ত্রণ জানাতে পারি। অতীতেও তাই হয়েছে। কিন্তু এবার যেন পরিস্থিতি ভিন্ন। সরকার বলছে- সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিরোধী দল বলছে, আমাদের এক দফা। সরকারের পতন। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। ফলে কার্যত দেশের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। দুই দলেরই এক দফা। তালগাছ আমার। কেহ কারও নাহি ছাড়ে সমানে সমান। কার কতো শক্তি তা প্রদর্শনের জন্য দুই দলই একইদিনে বিভিন্ন নামে সমাবেশ ডাকছে। একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। দুই দলই দাবি করছে দেশের ১৬ কোটি মানুষ তাদের সঙ্গে আছে। বাস্তবতা হলো দেশের সাধারণ মানুষ বড্ড অসহায় হয়ে উঠেছে। একে তো বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। তার ওপর রাজনীতির মাঠের উত্তাপ ঘিরে অজানা আতঙ্কে দেশের সাধারণ মানুষ অনেকটাই দিশাহারা। তার ওপর জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের খবরদারি। কেউ কেউ নানান ফর্মুলা দিচ্ছেন। ফলে জাতীয় নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই এক ধরনের অজানা আতঙ্ক, ভয়-ভীতি সাধারণ মানুষকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে তুলছে। দেশ আমাদের, আমাদের জাতীয় নির্বাচন। এক্ষেত্রে প্রতিবেশীরা বড় জোর পরামর্শকের ভূমিকা নিতে পারেন। কিন্তু তারা যদি নির্দেশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তাহলে কি তা আনন্দের? নাকি শঙ্কা ও উদ্বেগের?
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ রাজনৈতিক আন্দোলনেরই ফসল। রাজনীতিই এই দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিরূপণ করে। এ জন্য দেশের রাজনীতিবিদদের প্রতি দেশের মানুষের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। যেকোনো দুর্যোগ, দুর্বিপাকে এলাকার একজন রাজনীতিবিদ সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেই পরিস্থিতি মোকাবিলার অদম্য সাহস ও শক্তির সঞ্চার হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই আশা ভরসার আশ্রয়স্থল। বর্তমান সময়ে কী সেই আস্থা ও ভরসার জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে? পরিবারে সংকট থাকে। বিরোধও সৃষ্টি হয়। বিরোধ মেটাতে প্রতিবেশীর সহযোগিতারও প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমরা যদি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠি তাহলে প্রতিবেশীও সুযোগ সন্ধানী হয়ে উঠতে চেষ্টা করে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কি খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।