ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

আন্তর্জাতিক

শ্রীলঙ্কায় যুদ্ধাপরাধের বিচার: নেপালে বিকল্প প্রস্তাব, ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যা

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৭ জুলাই ২০২৩, সোমবারmzamin

এক্ষেত্রে সাউথ আফ্রিকান মডেলই একমাত্র অবলম্বন নয়। নেপালও একটি বিকল্প প্রস্তাব করেছে। নেপালও গৃহযুদ্ধের পরিণতি বয়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে মাওবাদীদের বিদ্রোহ শেষ হয় ২০০৬ সালে। সেখানে শান্তিচুক্তি হয়েছে। তাতে লড়াই বন্ধে পুনরুজ্জীবন ও ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে টিআরসিতে কমপক্ষে ৬০ হাজার অভিযোগ জমা দেয়া হয়েছে। এর ফলে খুব কমই বিচার করা হয়েছে। নেপালের পার্লামেন্টে এখন একটি নতুন বিল আছে। এই বিলটি পাস হলে টিআরসিকে একটি বিশেষ আদালতে পরিণত করে তাকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়

এক বছর আগের কথা। শ্রীলঙ্কাকে গ্রাস করে অর্থনৈতিক সংকট। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। আর গণবিক্ষোভ। আশা জেগেছিল দেশটি সুবর্ণ এক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের সরকার এত বেশি অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়েছিল যে, তা দ্রুতই ভেঙে পড়ে। পুরো দেশকে এর বিরুদ্ধে ক্রোধে একত্রিত করেছিল সেই ঘটনা। এর ফলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষ এক হয়ে রাস্তায় নেমেছিল। স্বাধীনতার পর শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে এমনটি এর আগে আর কখনো দেখা যায়নি। দেশটির তামিল, হিন্দু, সংখ্যালঘু এবং সিংহলি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের এক কাতারে নিয়ে এসেছিল বলে আশা জেগে ওঠে। কিন্তু তা স্বল্পস্থায়ী প্রমাণিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার বন্ধন রচনার সর্বশেষ ভঙ্গুর অবস্থা এতে চিত্রিত হয়েছে। বর্তমানে দেশটি পরিচালনা করছেন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। কিন্তু সংকট থেকে উত্তরণে দেশটিতে পুনরেকত্রীকরণ বা পুনরুজ্জীবিতকরণের প্রয়োজন। তার জন্য দেশটিতে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের অন্যতম তামিলদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের সময়কার গণহত্যার বিচার। মে মাসে রণিল বিক্রমাসিংহের সরকার দক্ষিণ সুদানের স্টাইলে এই বিচারের জন্য একটি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ (টিআরসি) গঠনের উদ্যোগ নেয়। এর উদ্দেশ্য শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করা। এই গৃহযুদ্ধ এখন থেকে ৪০ বছর আগে শুরু হয়েছিল। তার ইতি ঘটেছে ২০০৯ সালের মে মাসে। তখন সেনাবাহিনী হাজার হাজার তামিল বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ আছে। এর মধ্যদিয়ে তারা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। এশিয়ার অন্য দেশগুলো তাদের নিজেদের অতীতের অন্ধকার সময়ের ইতিহাসের মুখোমুখি যেভাবে দাঁড়িয়েছে, তা বলে দেয় শ্রীলঙ্কার অতীতও সেদিকেই যেতে পারে। 

রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, ওই কমিশন (টিআরসি) প্রতিষ্ঠা করার আগে আগস্টে তা পার্লামেন্টে অনুমোদন হবে। তবে কীভাবে এই কমিশন গঠন করা হবে, কেমন হবে তার কাজ, তার কিছুই এখনো জনগণ জানে না। এর মধ্যে আছে এই কমিশনের সদস্য হবেন কারা এবং শর্ত হবে কী। এমন একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে বিক্রমাসিংহের সরকার। এই খসড়া প্রস্তাব তামিলদের যেসব নেতা দেখেছেন, তারা বলেছেন- যারা গৃহযুদ্ধের সময় অপরাধ করেছে তাদেরকে জবাবদিহিতায় আনার কোনো পরিকল্পনা এতে নেই। এটা বোঝা যায়। ‘সাউথ আফ্রিকান মডেলে’ সত্য ও পুনরুজ্জীবন বিষয়টিতে অপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় বহু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আছে। তারা এখনো দায়িত্ব পালন করছেন। বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে ওই গৃহযুদ্ধের সময় ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। গৃহযুদ্ধের সময় অকাতরে তামিল বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী- এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে জোরালো অভিযোগ আছে। বলা হয়েছে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে গোটাবাইয়া রাজাপাকসে বেসামরিক তামিল লোকজনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ জন্য তিনিসহ যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে তা তদন্তের দাবি করেছে আন্তর্জাতিক দুনিয়া। এ বছর জুনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, শ্রীলঙ্কায় যুদ্ধাপরাধের একটি ছবি নিয়ে জাতিসংঘে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। ওই ছবিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে সেখানে বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী এবং কীভাবে তারা অন্যান্য যুদ্ধাপরাধ করেছে। এ বিষয়ক যে ছবি প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেন বৃটিশ সাংবাদিক ও পরিচালক ক্যালাম ম্যাক্রে তার নাম ‘নো ফায়ার জোন: দ্য কিলিং ফিল্ডস অব শ্রীলঙ্কা’। 

এর আগে ২০১৫ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, শ্রীলঙ্কায় যুদ্ধাপরাধ হয়েছে, এ মর্মে তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর তদন্ত দাবি করেছে জাতিসংঘ। এ ছাড়া হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকারও একই দাবি করে। 

দেশটিতে যে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ হয়েছে, এর যে বেদনাদায়ক ক্ষত, তা শ্রীলঙ্কার সমাজ জীবনকে বিভক্ত করেছে। তা সহজেই মুছে যাবে না। গত মাসে এ বিষয়টি রিপোর্ট করেছে স্থানীয় একটি এনজিও। তাতে জোর দেয়া হয়েছে বনে-জঙ্গলে এবং ধানক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক গণকবরের বিষয়ে। এর মধ্যে খুব ক্ষুদ্র একটি অংশে প্রায় ২০টি গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে। তার ভেতর থেকে কয়েকশত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এই রিপোর্টে অনেক বেশি ব্যর্থতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। যেভাবে সেখানে মৃতদেহ সমাহিত করা হয়েছে এবং অপরাধের ভয়াবহতা তদন্ত করা হয়েছে তা থেকেই সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। 

বিখ্যাত ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন লিখেছে, গত মাসে একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, যুদ্ধের তিক্ত বিষয়গুলোকে তিনি সত্যের আলোতে আনবেন। তার প্রচেষ্টা সফল হবে। এর আগের উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হলেও তিনি সফল হবেন। তিনি বলেন, কেউই বলতে পারবে না আমরা ধামাচাপা দিচ্ছি। কারণ, আমাদের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। এরই মধ্যে তার অনেক সমালোচক বলছেন, তারা তার টিআরসিতে যুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানাবেন। কারণ, তারা এটাকে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবিকে উপেক্ষা করে শুধু আর একটি পদেক্ষপ হিসেবে দেখছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবি করা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ডেপুটি হাইকমিশনার নাদা আল নাশিফ গত মাসে এ বিষয়টি জেনেভার অধিবেশনে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, জবাবদিহিতার জন্য অতীত মোকাবিলার ক্ষেত্রে এতে মৌলিক ফারাক থেকে যাচ্ছে। 

এক্ষেত্রে সাউথ আফ্রিকান মডেলই একমাত্র অবলম্বন নয়। নেপালও একটি বিকল্প প্রস্তাব করেছে। নেপালও গৃহযুদ্ধের পরিণতি বয়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে মাওবাদীদের বিদ্রোহ শেষ হয় ২০০৬ সালে। সেখানে শান্তিচুক্তি হয়েছে। তাতে লড়াই বন্ধে পুনরুজ্জীবন ও ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে টিআরসিতে কমপক্ষে ৬০ হাজার অভিযোগ জমা দেয়া হয়েছে। এর ফলে খুব কমই বিচার করা হয়েছে। নেপালের পার্লামেন্টে এখন একটি নতুন বিল আছে। এই বিলটি পাস হলে টিআরসিকে একটি বিশেষ আদালতে পরিণত করে তাকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়। 

ইন্দোনেশিয়ায় আরেক অবস্থা। জাতীয় পর্যায়ে সৃষ্ট ক্ষত নিয়ে প্রায় ৬০ বছর ধরে আলোচকদের কণ্ঠকে চেপে ধরে রাখা হয়েছে। এই ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল সুহার্তোর ৩২ বছরের স্বৈরাচারতন্ত্রে। এ সময়ে হাজার হাজার মানুষকে কমিউনিস্ট সন্দেহে গণহত্যা করা হয়। মাত্র ২০১৬ সালে ওই সহিংসতা নিয়ে জনগণের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। সুহার্তোর যুগে যারা ভিকটিম হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো। এর মধ্যে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৬ সালের গণহত্যা রয়েছে। 
ভিকটিম ও তার পরিবারের জন্য যে প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে তার ফল পাওয়া যাবে অনেক বিলম্বে। ততদিনে অনেক অপরাধী মারা যাবে অথবা ন্যায়বিচারের বাইরে থাকবে। শ্রীলঙ্কার সরকার এমনই একটি ফল দৃশ্যত প্রত্যাশা করছে। তাদেরকে উচ্চ আশা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। মিস আল নাশিফ বলেন, যতদিন দায়মুক্তি বজায় থাকবে, ততদিন শ্রীলঙ্কা প্রকৃত অর্থে পুনরুজ্জীবিত হবে না। টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক/ পিতা ও কন্যার পরিণতি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status