ঢাকা, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, বুধবার, ১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

সংস্কৃত ভাষার বাড়তি বর্ণগুলি বিভ্রাট বাধায়

গাজী মিজানুর রহমান

(১ বছর আগে) ১৫ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ১১:৪৩ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:১০ পূর্বাহ্ন

mzamin

পৃথিবীতে যত বিস্ময় আছে, ভাষা তাদের অন্যতম।  এটা নিশ্চিত যে, ভাষা মানুষের সাথে সাথে আসেনি। আরও নিশ্চিত যে, কেবল মানুষেরই ভাষা আছে, অন্য প্রাণির নেই– কথাটা সত্য নয় । একটা গাভী আর তার বাছুরকে যখন দুধ দোয়াবার আগে আলাদা করে রাখা হয়, তখন তাদের মধ্যেও কথা হয় মুখের ভাষা দিয়ে। যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা দেখেছেন, ক্ষুধার্ত বাছুর অন্য ঘর থেকে হাম্বা করলে মা গাভীও হাম্বা করে। হাম্বা ডাকের ভেতরে কী বলে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। একটা কাক মরে গেলে সব কাকেরা দল বেঁধে এসে ‘কা-কা’ ধ্বনি করে কী বলে, তা কি বুঝতে কষ্ট হয়? অনেক সময় মানুষ বলে, সব কথা কি মুখে বলতে আছে? অর্থাৎ মুখের ভাষা ছাড়াও কথা আদান-প্রদান হয়ে থাকে। তাই আমাদের হাতে মাছের কাঁটা দেখে বিড়াল ‘মিঁও মিঁও’ করে লেজ ঘষে কী বলে, তা বুঝতে পারি আমরা ।

এই অন্তহীন ভাষা-রহস্য ভেদ করা দুরূহ কাজ। বাংলা ভাষার কথাই ধরুন। খোদ প্রমিত বাংলা যে অঞ্চলে বলাবলি হয়, তার পাশেই দেখবেন কেউ কেউ স-কে ‘ছ’ দিয়ে উচ্চারণ করে, আবার কোনো কোনো এলাকায় স-কে ‘শ’ ধ্বনি দিয়ে উচ্চারণ করা হয়। সিলেট থেকে পশ্চিম বাংলার খড়গপুর পর্যন্ত এবং টেকনাফ থেকে পশ্চিম বাংলার জলপাইগুড়ি পর্যন্ত আঞ্চলিক বাংলা ভাষার নাড়ি-নক্ষত্র খুঁজতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের কোটি জীবনের দরকার হবে ।

বাংলা ভাষার উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে। সংস্কৃত ভাষার আদি, মধ্য, শেষ বিভিন্ন বর্ণ ও ধ্বনি হেরফের হয়ে প্রাকৃত এবং প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার  আবির্ভাব হয়েছে। এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কাজ করেছে যুগের পর যুগের কথ্য ভাষা। ক্লিনিক বা হাসপাতালে শল্যবিদ্গণ অনেকসময় অস্ত্রোপচার করার সময় ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু ফেলে দেন। ঠিক সেভাবে সংস্কৃত ভাষার অনুস্বার, বিসর্গ, য-ফলা, র-ফলা, ইত্যাদি ফেলে দিয়ে প্রথমে একটা কথ্যনির্ভর ভাষা এবং সে থেকে আস্তে আস্তে  বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। শল্যবিদ অপারেশনের সময়  অন্যের শরীরের অঙ্গ ব্যবহার করেন। এগুলিকে আমরা বিদেশী শব্দের সাথে তুলনা করতে পারি। অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়ার আদলে এসব বিদেশী শব্দ বাংলা ভাষায় সামিল হয়েছে ।

ভালো ক্লিনিক, ভালো ডাক্তার সেলাই দিলে বুঝা যায় না যে, এখানটায় একসময় কেটে-চিরে গিয়েছিল। ক্লিনিক আর ডাক্তারের হাতের কারিশমার মতো দেশের নানা অঞ্চলে নানা কথ্যভাষার শরীর ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বলেন আসিয়া , কেউ বলেন আইস্যা, কেউ বলেন আইসা। শব্দটা একই। এভাবে আমার, আঁর, আমরার, মোর শব্দগুলো বিবর্তন ঘটে। এই বিবর্তনে শিক্ষিত-অশিক্ষিত শ্রেণির মানুষের ভূমিকায় আলাদা আলাদা  কিছু নেই । এক এলাকার  লোক পরস্পর কথা বললে অন্য এলাকার লোক তার অর্ধেক  বুঝতে পারবেন। বড় ভাষাতাত্ত্বিক হলেও একই কাণ্ড হবে । দুই ইংরেজ, দুই আমেরিকান, দুই ইন্ডিয়ান, দুই ওয়েস্ট এশিয়ান ইংরেজিতে কথা বললে, তাদের উচ্চারণের টান-টোন আলাদা আলাদা হবে। শব্দের এবং বাক্যের গঠনও আলাদা আলাদা হতে পারে । তবে আঞ্চলিকতা নির্বিশেষে বাংলার আদি মাতা যে সংস্কৃত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সংস্কৃত ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রের। রক্তের দিক দিয়ে অনার্য হলেও বাঙালি ভাষার দিক দিয়ে আর্য। তাই সংস্কৃত আর বাংলার যোগসূত্র নিবিড়। তবু পণ্ডিতি, পুথিগত, আনুষ্ঠানিকতা-নির্ভর সংস্কৃত ভাষায় র-ফলা, য-ফলা, যুক্তবর্ণ, বিসর্গ, ঐ-কার ইত্যাদি থাকায় ভাষার বাক্য সমূহের অর্থ উদ্ধার করা বাঙালির জন্য কঠিন। সহজ উপায় হচ্ছে, শব্দ থেকে এইসব ফলা এবং সংস্কৃত-ঘেষা বর্ণ ফেলে দিলে শব্দটা  যদি বাংলা শব্দের কাছাকাছি আসে, তাহলে সেখান থেকে অর্থ হাতে পাওয়ার চেষ্টা করা।

আগের দিনে স্কুল পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বাংলা বিষয়ের পরীক্ষায় ‘বর্ষা’ রচনা লিখতে হতো।  এই রচনায় কবি কালিদাসের  একটা  পঙক্তিকে সাড়ম্বরে স্থান দিতে হতো, কারণ  বর্ষাকাল রচনা থাকবে, আর ‘আষাড়স্য  প্রথম দিবস' থাকবে না তা হয় না। মহাকবি কালিদাস তার মেঘদূত কাব্যে নির্বাসিত যক্ষের ভালোবাসার কথা লিখতে গিয়ে আষাঢ়ের মেঘের কথা লিখেছেন– “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণত গজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।''
এ লাইন দুটিতে  য-ফলা, র-ফলা, অনুস্বার, রেফ এর প্রাধান্য দৃশ্যমান। কিন্তু আষাঢ়, প্রথম, দিবস, মেঘ, ক্রীড়া, গজ, দর্শন– শব্দগুলি আমাদের জানা । তা থেকে অর্থ আন্দাজ করা যায় যে, বলা হচ্ছে–আষাঢ়ের প্রথম দিবসে পাহাড়ের সানুদেশে লেপ্টে থাকা মেঘমালাকে দেখতে যেন ক্রীড়ারত এক প্রমত্ত হাতির মতো।  

মধ্যযুগের কবি জয়দেব ছিলেন লক্ষণ সেনের সভার একজন রত্ন বা সভাসদ। তার 'গীতগোবিন্দ' একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ । বখতিয়ার খিলজী লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা দখল করেন। লক্ষণ সেন শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কিন্তু তিনি বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। তার দরবারে সব কাজ সংস্কৃত ভাষাতেই হতো। কবি জয়দেবও সে সময়ে সংস্কৃত ভাষায় কাব্য চর্চা করেছেন। তার একটি পঙক্তি হচ্ছে–মেঘৈর্মেদুরম্বরং বনভূবশ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ । এখানে মেঘৈ এর ঐ-কার, মের্দুর এর রেফ ফেলে দিয়ে, রম্বরং থেকে ‘অম্বর’ শব্দ বের করে, বনভূম থেকে ‘বন’  বের করে, শ্যামাস্তমাল থেকে ‘শ্যাম’ এবং ‘তমাল’ দুই শব্দ বের করে, তারপর দ্রুমৈঃ এর ঐ-কার আর বিসর্গ ফেলে দিয়ে 'দ্রুম' ( অর্থ গাছ ) পাওয়া গেলে  অর্থ পরিষ্কার হবে। তখন বুঝা যাবে–মেঘমেদুর আকাশ আর বনের শ্যামল বৃক্ষরাজি মিলে বর্ষার এক অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। পাণ্ডব বর্জিত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামের সাধারণ মানুষের এই বাহুল্য ফলাযোগ ধাতে সইতো না। তাই তারা সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত সহজ-সরল প্রাকৃত  ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম দিয়েছে।

( গাজী মিজানুর রহমান , সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট ও লেখক )

 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status