ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

দফা এক রফা কি?

শুভ কিবরিয়া
১৫ জুলাই ২০২৩, শনিবারmzamin

রাজনীতি একটা খেলা। এই খেলার আছে ভেতর ও বাহির। আছে অন্তরাল ও প্রকাশ্য চেহারা। আছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দেনদরবার। আছে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের দরকষাকষির ক্ষমতার নানামুখী পরিবর্তন। ঢাকায় বিএনপি’র সমাবেশে পুলিশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একদল যুবক কর্মী স্লোগান দিয়েছে, ‘পুলিশ তুমি পোশাক ছাড়ো, মুজিব কোর্ট গায়ে পরো’। আবার আওয়ামী লীগের সমাবেশে আমেরিকার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে জুতসই স্লোগান উঠেছে। এসব রাজনৈতিক রেটোরিকের মধ্য দিয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দলের মনের কথাগুলো পড়তে পারা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে একদল ক্ষমতায় থাকতে শেষ চেষ্টা করে যাবে। আরেক দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ প্রাণপাত চেষ্টা ছাড়বে না। বড় রাজনৈতিক দল দুটোর এই বেপরোয়া মনোভাবের সুযোগ নিচ্ছে আমেরিকা, ভারত, চীন, রাশিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার বাংলাদেশ সফর শেষ। এই সফরের মধ্যেই বিএনপি’র এক দফা ঘোষিত হয়েছে। আওয়ামী লীগও উজরা জেয়াকে সাক্ষ্য রেখেই বিএনপি’র বিপরীতে এক দফা দিয়েছে। বিএনপি’র ১ দফা হচ্ছে, তারা চায় সরকারের পদত্যাগ। ‘এই সরকারের অধীনে নির্বাচন না’। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলেছে, ‘শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন’। দুই বড় দলের দাবি পরস্পর বিরোধী। দুই দলের দাবিই যদি বহাল থাকে তাহলে নির্বাচন নিয়ে চলা সংকটের সমাধান হবে কীভাবে। দুই দলের দুই দাবি টিকে গেলে জাতির সামনে প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে রফা’টা কি? রফা কি বুঝতে হলে উজরা জেয়ার সফরের সময় দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা ও সব পক্ষের কথাগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে খেয়াল করতে হবে। দুই দলের বক্তব্যগুলোকেও মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।

২. কি বললেন, বাংলাদেশ সফররত মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া? উজরা জেয়ার পাবলিক করা বক্তব্য হচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক মতবিরোধ নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রত্যাশা জানিয়েছেন তারা। এটা কোনো নতুন কথা নয়, যদিও। তবে, জেয়ার পরের কথাটার মধ্যে ইঙ্গিত আছে? তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিনের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র তার ভূমিকা রাখতে চায়। আমেরিকার এই রাজনৈতিক খায়েশ মেটাতে সরকারপ্রধান তাকে কি আশ্বাস দিয়েছেন? উজরা জেয়ার বরাতে আমরা জানছি, সরকারের তাতে মোটেও দৃশ্যত আপত্তি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সরকারের একাধিক মন্ত্রী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন উজরা জেয়ার কাছে। এই মোড়লগিরির পরেও উজরা জেয়া কিছুটা ডিপ্লোম্যাট আচরণ করে বলেছেন, নির্বাচনের আগে বড় দুই দলের মধ্যে তারাও সংলাপ চান। তবে এই প্রক্রিয়ায় তারা সরাসরি যুক্ত নন। উজরা জেয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনান্ড লু অবশ্য এবার পুরো প্রফেশনাল আচরণ করেছেন। প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেননি। একই আচরণ করেছেন বাংলাদেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও।
তবে সরকারি দলের বিভিন্ন সূত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব কমেছে।’ আমেরিকা বাংলাদেশে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ চেয়েছে। সরকারও একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে চেয়েছে।

৩. এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে বিএনপি’র রাজনৈতিক ক্রিয়া- কলাপেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তারা একটা সফল সমাবেশ করার পর পরই উজরা জেয়ার বাংলাদেশে অবস্থানকালীন সময়েই ৩১ দফার একটা রূপরেখা ঘোষণা করেছে। বহুদফার এই রূপরেখা ঘোষণার আগে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলার চেষ্টা করেছেন, রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে নাই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। তাই এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। তাদের দেয়া রূপরেখার চেহারা অনেকটা নির্বাচনী ইশতেহারের আদল পেয়েছে। যদিও তারা বলছেন এই রূপরেখা রাষ্ট্র মেরামতেরই হাতিয়ার। তাদের রূপরেখায় আছে, মন্ত্রিসভায় ক্ষমতার ভারসাম্য আসবে, সংসদে উচ্চকক্ষ হবে। ফিরিয়ে আনা হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। গঠিত হবে রিকনসিলেশন কমিশন। ফিরবে পাচার হওয়া অর্থ। বন্ধ হবে বিচারবহির্ভূত হত্যা। সন্ত্রাসের কাজে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী মজুরি দেয়া হবে, থাকবে বেকার ভাতা। শিক্ষা স্বাস্থ্যে জিডিপি’র ১০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হবে।

৪. এবার আমরা কতগুলো বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে পারি।
এক. এটা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের রাজনীতির খেলার মাঠে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জগতের প্রভাব বেড়েছে। এবং সুস্পষ্টভাবেই প্রকাশ্যে এসেছে তারা। অতীতের মতো বাংলাদেশের প্রতিবেশী বড় দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের আমলাদের হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে পেছন থেকে গোপনে কলকাঠি নাড়ার মিশন থেকে এবার সরেছে আমেরিকা।
দুই. আমেরিকান ভিসানীতি একটা টোকেন গেম। তাতে ফল ফলেছে। বিএনপি প্রকাশ্যে বাধা ছাড়া ঢাকায় বড় জনসভা করতে পেরেছে। বোঝা যাচ্ছে চাপে হোক, কৌশলে হোক, সরকার রণনীতি বদলেছে।
তিন.  বিএনপি’র বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পরিবর্তন এসেছে। তারা একদফার সঙ্গে সঙ্গে ৩১ দফার রাষ্ট্রমেরামতির যে রূপরেখা দিয়েছে সেটা বিশেষ রাজনৈতিক বার্তা বহন করে।
চার. আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজেও পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। ইরান, চীন, রাশিয়ার প্রকাশ্য সমর্থন থাকার পরও এখন আমেরিকার সঙ্গে তাদের যে সংকট কাটছে সেই বার্তা তারা দিতে চাইছে দল ও দেশকে। এটা খুব ইঙ্গিতবাহি ঘটনা।
পাঁচ. প্রশাসন ও পুলিশ চলমান রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে দায়িত্বপালনে যে ভূমিকা দেখাচ্ছে তাতেও একটা পরিবর্তনের আভাস আছে।

৫. রাজনীতি একটা খেলা। এই খেলার আছে ভেতর ও বাহির। আছে অন্তরাল ও প্রকাশ্য চেহারা। আছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দেনদরবার। আছে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের দরকষাকষির ক্ষমতার নানামুখী পরিবর্তন। ঢাকায় বিএনপি’র সমাবেশে পুলিশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একদল যুবক কর্মী স্লোগান দিয়েছে, ‘পুলিশ তুমি পোশাক ছাড়ো, মুজিব কোর্ট গায়ে পরো’। আবার আওয়ামী লীগের সমাবেশে আমেরিকার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে জুতসই স্লোগান উঠেছে। এসব রাজনৈতিক রেটোরিকের মধ্য দিয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দলের মনের কথাগুলো পড়তে পারা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে একদল ক্ষমতায় থাকতে শেষ চেষ্টা করে যাবে। আরেকদল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ প্রাণপাত চেষ্টা ছাড়বে না। বড় রাজনৈতিক দল দুটোর এই বেপরোয়া মনোভাবের সুযোগ নিচ্ছে আমেরিকা, ভারত, চীন, রাশিয়া। মাঠে সবাই যার যার মতো করে খেলছে। সে কারণেই এবার আমেরিকার এই প্রকাশ্য অবস্থান। নানারকম দেনদরবারের মধ্যে উত্তেজিত কিছু কণ্ঠস্বরও নতুন নতুন ইঙ্গিত দিচ্ছে। যেমন সরকারের মন্ত্রী ও র‌্যাডিক্যাল অংশের মুখপাত্র হাছান মাহমুদ এমপি বিএনপি’র দাবির মধ্যে ‘হামিদ কারজাই মার্কা সরকারের’ উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন। সেটাও ইঙ্গিতবাহি। বহুমাত্রিক, বৈচিত্র্যে ভরা, বহুপক্ষীয় স্বার্থকে সামনে রেখে প্রকাশ্যে এসেছে দুই দলের ১ দফা। এই দফার আড়ালে চলছে বহুরকমফেরের রফা। সেই রফা বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে, সরকারের  যুদ্ধংদেহি রণনীতিতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এটা তার নতুন রণকৌশলও হতে পারে। একটা ভালো নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আন্তর্জাতিক পক্ষকে সমঝে চলে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যেতে পারলে আওয়ামী কৌশলের কাছে অন্যদের জেতা কঠিন হবে। সরকার সেই চেষ্টায় শেষ অবধি অনড় থাকার চেষ্টা করবে, বাকি সবকিছু ছাড় দিয়ে হলেও। জনসমর্থন আর রাস্তায় বিএনপি যদি তার জোর বজায় রেখে সরকারের ফাঁদে পা না দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, তবে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনার দেখা এবার তারা পেলেও পেতে পারে।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক/ পিতা ও কন্যার পরিণতি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status