মত-মতান্তর
নির্বাচনের আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার ও সমঝোতা
ডাঃ ওয়াজেদ খান
(২ মাস আগে) ১১ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ২:২৯ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৯:২৮ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশে এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। বিরোধী দলের মতো বিদেশীরাও গ্যারান্টি চায় অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের। মনে হচ্ছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হলেই সমাধান হয়ে যাবে সকল সমস্যার। গণতন্ত্রের সুবাতাস ও দুগ্ধ নহর বইয়ে যাবে দেশজুড়ে। কায়েম হবে আইনের শাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার। প্রতিষ্ঠিত হবে মানবাধিকার। নিশ্চিত হবে বাক-ব্যক্তি ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা। আদতেই কি এমন কোন সম্ভাবনা আছে? আর নির্বাচনই কী গণতন্ত্রের শেষ কথা? নির্বাচন হলেই কী দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়? কায়েম হয় আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা? নিশ্চিত হয় বাক-ব্যক্তি ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা? নির্বাচন হলেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশ যার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। জাতীয় সংসদের এগারোটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দেখা মেলেনি দেশটিতে।
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনগুলো ছাড়া প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই নজির রয়েছে অনিয়মের। সম্প্রতি ভোটারবিহীন, জালিয়াতি ও কারচুপির নির্বাচনের পর সরকার গঠিত হয়েছে যথারীতি। এই সরকার নাগরিকদের সকল অধিকার হরণ করে একে একে ধ্বংস করেছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অসাম্যের বিস্তার ঘটিয়ে আইন ও বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে প্রশাসন । ফলে রাষ্ট্রের চেয়ে দল, দলের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ব্যক্তি বিশেষ। প্রতিহিংসা, ব্যক্তি পূজা ও ভক্তি মার্গের রাজনীতির ব্যাপকতা এখন দুর্দমনীয়। বাক, ব্যক্তি, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা চরমভাবে সংকুচিত। সীমাহীন দুর্নীতি ও অযোগ্য নেতৃত্বের হাতে বন্দি দেশবাসী । বিরোধী রাজনীতি ও মতের কোন তোয়াক্কা করছে না দেশের কথিত গণতান্ত্রিক সরকার। তারপরও পাঁচবছর পর ফিরে আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এবছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরগরম হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। নির্বাচনের সময়টায় বরাবরই অনিবার্য হয়ে উঠে রাজনৈতিক সংঘাত। জনমনে বেড়ে যায় অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। চলতি বছর এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো বহুগুণে। ক্ষমতাসীনরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও দলীয় ক্যাডারদেরকে ব্যবহার করে অব্যাহত রেখেছে মামলা-হামলা। জাতীয় সংসদের বিগত তিনটি নির্বাচনেই ঘটেছে কারচুপির ঘটনা। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট সম্পন্ন হয়ে যায় আগের রাতেই । ফলে দেশের নাগরিকরা বঞ্চিত হন ভোটাধিকার থেকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এবারো সরকারী ও বিরোধী দলের অবস্থান মুখোমুখি। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল সহ অন্যান্য দলগুলো ঘোষণা দিয়েছে নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না। অপরদিকে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের সিদ্ধান্তে অনড় ক্ষমতাসীনরা। এমতাবস্থায় রাজনীতির আকাশে ক্রমেই জমে উঠছে কালো মেঘ। দেশে গণতন্ত্র থাকলে কখনো এমনটি হবার কথা নয়। গণতন্ত্রহীনতার এই সুযোগটি বার বার লুফে নিচ্ছে বিদেশীরা। বিশেষ করে বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতরা মাঠে নেমেছেন এবারো। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছে কঠোর অবস্থান। জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে। সবকিছু মিলিয়ে দেশের রাজনীতিতে চলছে ভয়ানক ক্রান্তিকাল।
দেশের মানুষ বিগত ১১টি সংসদ নির্বাচন দেখেছেন। এর মাঝে তিনটি নির্বাচনতো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতেও কোন লাভ হয়নি। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও এখনো তা আত্মস্থ করতে পারেননি তারা। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে নেই গণতান্ত্রিক চর্চা। দলে নেতৃত্ব বিকাশের পথ রুদ্ধ। পরিবারতান্ত্রিকতার কারণে দলগুলো কার্যত পরিণত হয়েছে ব্যবসায়িক লিমিটেড কোম্পানীতে। মনোনয়ন ও কমিটি বাণিজ্যের কারণে এসব রাজনৈতিক দলে বিগত ১৫ বছরে নতুন কোন নেতাও বেরিয়ে আসেনি। এই যদি হয় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা তাহলে রাষ্ট্রে তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে কিভাবে। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা হলো। সেখানে বর্তমান বিরোধী দল বা বর্তমান সরকারী দল ক্ষমতায় এলো। তাতে কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলিক কোন পরিবর্তন আসবে? অবাধ মনোনয়ন বাণিজ্য শীর্ষ নেতাদের সহায় সম্পত্তি বাড়াবে। একদল ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, প্রাক্তন আমলা, বিতর্কিত ব্যক্তি দ্বারা আবারো শোভিত হবে জাতীয় সংসদ। সরকারি প্লট, ফ্ল্যাট, শুল্কমুক্ত গাড়ী, ব্যাংক ঋণ, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়তে নতুন উদ্যমে হামলে পড়বে তারা। নবনির্বাচিতরা ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গ মিলে মুন্ডুপাত করবে গণতন্ত্রের। এভাবেই গড়ে উঠবে নব্য আরেকটি ধনিক-বণিক শ্রেনী। রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন যেমন আগে হয়নি ভবিষ্যতে হবে নেই এম কোন সম্ভাবনা ।
রাষ্ট্রের অবহেলিত নাগরিকরা সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার মানবিক মর্যাদা ও বৈষম্যেও অবসান চান। অধিকার চান নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশের। গণতন্ত্র কি জিনিস তা তারা বুঝে না। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি বা স্যাংশন নিয়ে মাথাব্যথা নেই তাদের। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর একটি শ্লোগান ছিলো “ভোটের আগে ভাত চাই।” এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ একটি দাবি উঠেছে ‘নির্বাচনের আগে চাই রাজনৈতিক সংস্কার’। নির্বাচন একবছর বা দু’বছর পরে হোক অসুবিধা নেই। নির্বাচনের পূর্বে অবশ্যই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। ফিরিয়ে দিতে হবে গণভোটের অধিকার। এজন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে সংবিধানে। বর্তমান সংসদেই এর সুরাহা সম্ভব। যে সকল কারণে সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠে রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে সে সকল রাস্তা । নির্বাচনের পর প্রণয়ন করতে হবে নতুন সংবিধান। তার আগেই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে আনতে হবে সুনির্দিষ্ট আইনী কাঠামোর আওতায়। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বলবে অথচ নূন্যতম চর্চা থাকবে না দলে এমনটি চলতে পারে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত গণভোটে এই কাঠামোর পক্ষে রায় নিতে হবে জনগণের । আর এই ম্যান্ডেটই হবে জাতীয় সমঝোতার ভিত্তি। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে অঙ্গীকার করতে হবে জাতীয় সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। জাতীয় সমঝোতার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যরাই বাংলাদেশকে পরিণত করবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। দেশে দুর্নীতিমুক্ত যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রয়োজন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কার । নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও যে বিতর্কের সৃষ্টি হবে না বা প্রতিদ্বন্দ্বি দলগুলো অনায়াসে জয় পরাজয় মেনে নেবে এমন গ্যারান্টি কোথায়? জাতীয় জীবনে বিদ্যমান কতিপয় মৌলিক সমস্যা এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার যে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা তা দূর করে দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক ও পেশীশক্তির রাজনীতির অবসান ঘটানোর এখনই মোক্ষম সময়। অপ্রিয় হলেও সত্য রাজনৈতিক মতদ্বৈততা, ব্যক্তি ইগো ও দলীয় স্বার্থের কারণে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই আগ্রহী হবে না দেশে বিদ্যমান এসব সমস্যা সমাধানে । দীর্ঘ ৫২ বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন কোন নজির নেই। তৃতীয় কোন পক্ষকেই উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানে। ভবিষ্যত রাজনৈতিক সংঘাতের যেনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে নির্বাচনের পূর্বেই দেশের জনগণ তার নিশ্চয়তা চায়। স্থায়ী এবং টেকসই গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক সংস্কার ও সমঝোতার কোন বিকল্প নেই।
নিউইয়র্ক, থেকে
পাঠকের মতামত
আসুন আমরা সহযোগিতা করে সত্যিকারের গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি ও তত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছি।
100% true
লেখককে ধন্যবাদ জনগণের মনের কথা গুলো লিখার জন্য আর আমরা সাধারণ মানুষেরা অবশ্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন চাই নিরপেক্ষ নির্বাচন আমাদের অধিকার। আর অবশ্যই অবশ্যই সংবিধানে গণভোটের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
100% সত্যি বলচজে স্যার, আপনার প্রতি আল্লাহ সহায়ক হোক আপনার লেখাটি সবার মনে প্রেরণা দেক।সুববুদ্ধি জাগরণ গঠুক সবার বিভেগে
মন্তব্য করুন
মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন
মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]