নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
আপনার জন্য যা খেলা আমার জন্য তা মৃত্যু
কাজল ঘোষ
৮ জুলাই ২০২৩, শনিবার
একটি গল্পের উল্লেখ করে লেখাটির ইতি টানতে চাই। এক পুকুরপাড়ে বসে দুই কিশোর ঢিল ছুড়েছে। তারা টার্গেট করেছে পুকুরে থাকা কুনো ব্যাঙগুলোকে। কিশোরদের ঢিল যেই ব্যাঙয়ের গায়ে লাগছে তারা খুব মজা পাচ্ছে। কিন্তু ঢিলের আঘাতে ব্যাঙের অবস্থা তথৈবচ। কথা হচ্ছে, যা কিশোরদের জন্য খেলা বা মজার তা পুকুরে ডুবে ডুবে বেঁচে থাকা ব্যাঙগুলোর জন্য মৃত্যুর শামিল। দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্যের জন্য যেসব গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষ বাজারে ছুটে প্রত্যহ; বাজার নিয়ে ব্যবসায়ী আর মন্ত্রণালয়ের এই যে চোর পুলিশ খেলা তা তো সাধারণের জন্য মৃত্যুর শামিল
পত্রিকার একটি খবরে হাস্যরসের জন্ম হলেও এটি বোধহয় বাস্তবতা। কিশোরগঞ্জের একটি বিয়েতে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে এক কেজি কাঁচা মরিচ। গত কদিনের শিরোনাম এই কাঁচা মরিচ। অনেকেই ফেসবুকে পরামর্শ দিয়েছেন পণ্যটি বর্জনের।
যেভাবে কিছুদিন আগে পিয়াজের দাম হু হু করে বাড়িয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে গেছে ফড়িয়া কারবারিদের পকেটে। নীরব আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মজার বিষয়, দুটি ঘটনাতেই দাম নিয়ন্ত্রণ এবং বাজার সিন্ডিকেটকে বাগে আনতে পারেনি সরকার। উল্টো দাম কমাতে ভারত থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পিয়াজ এবং কাঁচামরিচের ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। বেনাপোল দিয়ে পিয়াজ ঢুকলো, কাঁচা মরিচ ঢুকলো আর বাজার ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কিন্তু অসৎ, অসাধু ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের পকেটের টাকা বাটপাড়ি করে চুষে নিচ্ছে। আর এসব দেখেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মূকাভিনয় করে যাচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব যেখানে বাজার মনিটরিংয়ে গাফিলতি হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা। দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা। তা না করে তিনি উল্টোটাই করলেন। তার অসহায় আত্মসমর্পণে ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত হয়েছে তারা অনেক শক্তিশালী, সরকার তাদের ভয় পায় এবং সিন্ডিকেট করে কখনো তেল, কখনো চিনি, কখনো চাল, কখনো পিয়াজ, কখনো কাঁচামরিচের দাম মনখুশি মতো বাড়িয়ে নিলে কিছুই করতে পারবে না সরকার বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে সংসদে এমপিরা তোপ দাগলেন। বাজার সিন্ডিকেটের অভিযোগ তুলে সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। অসহায় বাণিজ্যমন্ত্রী স্বীকার করলেন সমস্যাটা কোথায়? বললেন, বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সংকট তৈরি হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বললেন, সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। এটা ঠিক যে, বড় গ্রুপগুলো একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। তবে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার, আমরা জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম; সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিস তৈরি হবে। বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা স্পষ্ট, চাইলে সবই সম্ভব। সিন্ডিকেট কোনো অদৃশ্যমান বিষয় নয়। সরকারের সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে অবগত। কী অসহায় আত্মসমর্পণ। বড় আকারে প্রশ্ন থেকে যায় তাহলে সমাধান কি, যেকোনো পণ্যের দাম বাড়বে আর বাহির থেকে আমদানি করে এই দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীদের থাবা থেকে দেশের বাজার বাঁচাতে হবে। আর ৭ দিন বা ১০ দিনের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা লুট করে নিয়ে যাবে।

যেভাবে ঝাল কমলো কাঁচা মরিচের
ঈদ ছুটির ৫ দিন পর গত রোববার ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আসতে শুরু করে বাংলাদেশে। আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। ব্যবসায়ীরা লাগামাহীন সূচক ভুলে দৌড়াতে থাকে দরপতনের পেছনে। এক দিনেই চারটি স্থলবন্দর দিয়ে ১ লাখ ১৪ হাজার কেজি কাঁচা মরিচ আমদানি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের আমদানির অনুমতি সুবাতাস বইয়ে দিয়েছে অন্তত দামের ঝাল কমাতে পেরেছে। ঈদের আগে কাঁচামরিচের দাম বাড়তে থাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আমদানির অনুমতি দেয়। ঈদের আগে ও পরে কাঁচামরিচের উত্তাপ যেভাবে আলোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া গেলেও প্রশ্ন থেকে যায় এই আমদানি না করলে কি ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের কাছে গলাকাটা দামেই কাঁচা মরিচ বিক্রয় করতো। একই কায়দায় মন্ত্রণালয় পিয়াজের দামেও নিয়ন্ত্রণ আনে। তার মানে বাজার মনিটরিং বলে আমাদের এখানে কিছুই নেই। ব্যবসায়ীরা ফ্রি স্টাইলে চালাচ্ছে সবকিছু।
আমদানিই কি সামলাবে বাজার?
বৃষ্টি, ঈদ ও সুযোগ-সন্ধানী ব্যবসায়ীদের কারণে কাঁচামরিচের দাম বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গত সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েছি, মরিচ আসাও শুরু হয়েছে। আশা করছি যে, দাম কমে যাবে। মন্ত্রী বলেন, দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি কমানোর জন্য চেষ্টা করছে সরকার। যখনই প্রয়োজন হবে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন আমদানির। তাহলে কি প্রশ্ন থাকে না ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে নানাভাবে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করলে, দোষী ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনলে বাজার নিয়ে নয়ছয় যারা করেন তার কিছুটা হলেও কমবে। তর্কের খাতিরে হলেও ধরি, যে পণ্যেরই দাম বাড়বে তা আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে কিন্তু যদি সংশ্লিষ্ট দেশ সেই পণ্য রপ্তানির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন কী হবে? নিকট অতীতে দেখা গেছে, ভারত যে সকল পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দেয় সেই সব পণ্য আমাদের এখানে দাম বাড়তে থাকে তরতর করে। এখন যদি বেড়ে যাওয়া পণ্যের আমদানি করার ক্ষেত্রেও বৈরী হাওয়ার মুখোমুখি হয় তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে। এই আপৎকালীন মলম দেয়া তো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়? দরকার নিরবচ্ছিন্ন বাজার ব্যবস্থাপনা মনিটরিং করা। যে সকল ব্যবসায়ী এই জোচ্চুরির নেটওয়ার্ক তৈরি করে রেখেছে তা ভেঙ্গে দিতে আইনের প্রয়োগ জরুরি কঠোরভাবে।
লেখাটি যখন লিখছি তখনই খবর পেলাম ডলারের বিপরীতে টাকার মানে বড় রকমের পতনের। এক ডলারের দর ২ টাকা ৮৫ পয়সা বাড়িয়ে আন্তঃব্যাংকে ১০৮ টাকা ৮৫ পয়সা দরে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে আন্তঃব্যাংক দরেই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হবে। ৩রা জুলাই দেশের ইতিহাসে টাকার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন ঘটেছে। এতে একদিনে স্থানীয় মুদ্রার ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২ টাকা ৮৫ পয়সা অবমূল্যায়ন হলো। চলতি মাস থেকেই নতুন মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন ঘোষণা করা হয়েছে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে এক অঙ্কের সুদের যে হার ছিল তা পরিবর্তন করা হয়েছে। তাতে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে যারা ঋণ নিয়েছে তাদেরকে এখন থেকে বাড়তি হারে সুদ প্রধান করতে হবে। মূল্যস্ফীতি তো রয়েছেই। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ১লা জুলাই থেকে মূল বেতনের ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাবও পড়বে বাজারে। কারণ যে হারে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বেড়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের বেতন তো বাড়ছে না? যে সকল মধ্যবিত্ত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চকরিরত তাদেরকে তো বাজার পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে পুরানো বেতনেই। সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
একটি গল্পের উল্লেখ করে লেখাটির ইতি টানতে চাই। এক পুকুরপাড়ে বসে দুই কিশোর ঢিল ছুঁড়ছে। তারা টার্গেট করেছে পুকুরে থাকা কুনো ব্যাঙগুলোকে। কিশোরদের ঢিল যেই ব্যাঙয়ের গায়ে লাগছে তারা খুব মজা পাচ্ছে। কিন্তু ঢিলের আঘাতে ব্যাঙের অবস্থা তথৈবচ। কথা হচ্ছে, যা কিশোরদের জন্য খেলা বা মজার তা পুকুরে ডুবে ডুবে বেঁচে থাকা ব্যাঙগুলোর জন্য মৃত্যুর শামিল। দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্যের জন্য যেসব গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষ বাজারে ছুটে প্রত্যহ; বাজার নিয়ে ব্যবসায়ী আর মন্ত্রণালয়ের এই যে চোর পুলিশ খেলা তা তো সাধারণের জন্য মৃত্যুর শামিল।
পুনশ্চ: অল্পদিনের ব্যবধানেই কাঁচা মরিচের পর এবার অস্থির হয়ে উঠেছে পিঁয়াজের বাজার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে দেশি পিঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। আর ভারত থেকে আমদানি করা পিঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫ টাকা। পিঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে ডলারের দাম বেশি হওয়াকেও দায়ী করছেন আমদানিকারকরা। তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভারতে বৃষ্টির কারণে পিঁয়াজের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় আমদানিকৃত পিঁয়াজের দাম বাড়ায় দেশি পিঁয়াজের দামও বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারেও অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেছে। দেশি পিঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকায়। যা গত এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকায়। এছাড়া আমদানিকৃত প্রতি কেজি পিঁয়াজ বৃহষ্পতিবার ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও তা ৩৫-৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। খুব সহজেই প্রশ্ন জাগে, কাঁচামরিচের বাজার স্বাভাবিক হতে না হতেই ঝাল পৌঁছে গেল পিঁয়াজে। এবং দাম বৃদ্ধির যে অজুহাত ব্যবসায়ীরা দেখিয়েছেন তা প্রায় একইরকম। তাহলে কি ফের একদিকে দাম বৃদ্ধি আর অন্যদিকে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের লঅগাম না টেনে আমদানির নীতিই বলবৎ রেখে দাম কমাতে হবে? এ তো হাতুরে ডাক্তারের ফোঁড়া কাটার মতো সমাধান। টোটকায় রোগ ভালো হতেও পারে বা নাও হতে পারে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কাঁচা মরিচ বেশি করে কিনে রাখায় বাজারে দাম বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে পাল্টা বলেন, কোনটা অসহনীয় আছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী সাধারণ মানুষের কান্না শুনতে পান কিনা? সাধারণ মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। প্লিজ, একটাবার মন্ত্রীর প্রটোকল থেকে বেরিয়ে বাজরে যান, সত্যিকার চিত্র কি বুঝতে পারবেন?
পাঠকের মতামত
জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা তখনই থাকবে যখন জনগণের ভোটে সরকার গঠন হবে। শুধু ব্যর্থতা নয়, সরকারের অযোগ্যতা-অদক্ষতা, আইনের শাসনের অভাব আর লূটপাটও সমান দায়ী। জনগণের সরকার ছাড়া এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার কোন উপায় নেই। আসুন, সবাই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের নিকট দোয়া করি- ‘এবার যেন এদেশের জনগণ কোন দল দ্বারা প্রতারিত না হয়। জনগণের বিজয়ের মধ্য দিয়ে সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার সরকার তথা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আ-মি-ন।’
সরকারের ব্যর্থতার জন্য আজ জনসাধারণ কষ্ট পাচ্ছে। সুশাসনের অভাবেই আজ আমাদের দেশ দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে, সব দিকে।