নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
রাজনীতি কি তাহলে ব্যবসা?
রেজানুর রহমান
৭ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার
শ্রদ্ধেয় নাট্যজন মামুনুর রশীদ রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছেন। এই নিয়ে এখনো আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আমরা মানি বা না মানি দেশে রুচির দুর্ভিক্ষই এখন মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগযোগমাধ্যম নীতিহীন, পথভ্রষ্ট মেধাহীন মানুষকে নেতা বানাচ্ছে। হিরো আলম শোষিত, নির্যাতিত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ঢাকা-১৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। নির্বাচনী হলফনামায় বার্ষিক আয়ের ঘরে যে অর্থের কথা লিখেছেন তার সঙ্গে বগুড়ায় প্রাসাদসম বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থের কোনো সঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল
হঠাৎ হয়তো একটি খবর প্রকাশ হলো, অথবা কোনো একটি বিষয় নিয়ে কানাঘুষা, ফিসফাঁস শুরু হয়ে গেল। ধরে নিতেই পারি এর কিছু না কিছু সত্যতা আছে। আবার ব্যতিক্রমও যে কিছু ঘটে না তা কিন্তু নয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যও অনেকে আপত্তিকর খবর, তথ্য বাতাসে উড়িয়ে দেয়।

যে জন্য আজকের এই লেখা সেটাই এবার বলি। প্রসঙ্গ টানার আগে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে চাই। প্রশ্নটা জটিল। রাজনীতি কি তাহলে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে? নিজেকে যখন এই প্রশ্ন করছি তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসছে। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা তো রাজনৈতিক আন্দোলনেরই ফসল। তাহলে রাজনীতি ব্যবসা হয় কী করে? কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের দুই কেন্দ্রীয় নেতার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শুনে, প্রচার মাধ্যমে তাদের বক্তব্য দেখে, পড়ে যারপর নাই অবাক, বিস্মিত, হয়েছি। আবারো বলি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা রাজনৈতিক আন্দোলনেরই ফসল। অথচ সেই রাজনীতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন কিছু নেতা। সারা দেশে এখন একটাই মুখরোচক আলোচনা, তাহলো রাজনৈতিক দল বানালে কোটি কোটি টাকা আয় করা যায়। তার মানে রাজনীতি এখন কারও কারও কাছে ব্যবসায় পরিণত হয়ে গেছে? এমন না যে বাইরে থেকে কেউ অভিযোগ করছে। দলের আহ্বায়ক, সদস্য সচিব স্বয়ং পরস্পরের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন। দলের নাম গণঅধিকার পরিষদ। দলের সদস্য সচিব নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়ার অভিযোগ, নুর দলের আর্থিক ব্যাপারে মোটেই স্বচ্ছ নন। দলের ফান্ডে প্রবাস থেকে টাকা আসে। এ ব্যাপারে আহ্বায়ক কিছুই জানেন না। এর চেয়েও নুরের ব্যাপারে ড. কিবরিয়ার বড় অভিযোগ হলো ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আঁতাত। ইসরাইল বাদে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সম্পর্ক বিদ্যমান। অথচ সেই ইসরাইলের সঙ্গেই নুরের যোগাযোগ আছে। বিদেশে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার একজন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক শেষে একটি কালো ব্যাগ নিয়ে নিজের গাড়িতে উঠেছেন নুর। ওই কালো ব্যাগে কি ছিল রেজা কিবরিয়া প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে নুর স্বয়ং রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক বিষয়ে অভিযোগ তুলেছেন। নুরের অভিযোগ রেজা কিবরিয়া নিজের দলের চেয়ে অন্য একটি দলের সভা-সমাবেশে উপস্থিত থাকতে বেশি পছন্দ করেন। কারণ তিনি ওই দলটি থেকে নিয়মিত অর্থ পান। নুর এবং রেজা কিবরিয়ার পরস্পরবিরোধী অভিযোগ এটাই প্রমাণ করে যে, কিছু কিছু রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র অর্থবিত্ত ও ক্ষমতায় যাবার ঘুঁটি হিসেবে রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে দেশের জনগণ হলো গিনিপিগ। জনগণের স্বার্থের কথা বলে, জনগণকেই জিম্মি করে, জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে এই দেশে ক্ষমতায় যাওয়া খুবই সহজ। হায়রে দেশ, হায়রে জনগণ!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই প্রথম রেজা কিবরিয়া ও নুরের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছে। ওই যে বললাম এখন কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার জন্য সময়কে বিবেচনায় আনার কোনো প্রয়োজন নাই। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, দিন রাত ২৪ ঘণ্টা আপনি সংবাদ সম্মেলন করতে পারবেন। রেজা কিবরিয়া বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাবেন। বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় সংবাদ সম্মেলন করে নুরের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ তুললেন।
রেজা কিবরিয়ার বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়েছেন নুর। তিনি বলেছেন, দলের আর্থিক বিষয় দেখাশোনার জন্য একটি কমিটি আছে। আমি ওই কমিটির একজন সদস্য মাত্র। কাজেই আমার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ভিত্তিহীন। ইসরাইলি গোয়েন্দার সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে নানা সময়ে নানা কথা বলেছেন তিনি।
আমি ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করিনি। নুরের এমন বক্তব্য সম্বলিত ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আবার একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে নুর বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বলছেন, হ্যাঁ আমি ইসরাইলি গোয়েন্দার সঙ্গে বৈঠক করেছি। এজন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হবে কেন?
কথায় আছে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। আবার এটাও সত্য রাগলেই মানুষের মুখ থেকে চরম সত্য বেরিয়ে আসে। রেজা কিবরিয়া ও নুর দু’জনের বক্তব্যই আমার কাছে উদ্বেগজনক মনে হয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল মানেই জনগণের আশ্রয়স্থল, আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু গণঅধিকার পরিষদে জনগণের জায়গাটা কোথায়? নুরের সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক জীবন অনেকটা স্যালুট করার মতো। বড় কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন না পেয়েও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ ডাকসু’র ভিপি হন। ভেবেছিলাম অচলায়তন ভাঙতে এলেন নুর। কিন্তু এই সেদিনের নুর এবং বর্তমানের নুরকে যেন মিলিয়ে নিতে কষ্ট হয়। মানবজমিনেই নুরের একটি বক্তব্য পড়লাম। নুর বলেছেন, এত কম টাকায় বিক্রি হয় না নুর। রেজা কিবরিয়ার একটি অভিযোগের জবাবে নুর এই মন্তব্য করেছেন। নুরের বিরুদ্ধে রেজা কিবরিয়া যে অভিযোগ করেছেন অনেকটা এরকম- সরকারের সঙ্গে নুর নির্বাচনে যেতে চাচ্ছেন। সরকারের কাছ থেকে ৩ কোটি টাকার প্রস্তাব পেয়েছেন। নির্বাচন করতে সরকারের পক্ষ থেকে দুই কোটি দেয়া হবে এবং নুরকে ব্যক্তিগতভাবে আরও এক কোটি টাকা দেয়া হবে। রেজা কিবরিয়ার বক্তব্য- আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবীর নানক, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে নুরের একাধিক বৈঠকে নুরকে এই প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। রেজা কিবরিয়ার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নুর। পৃথক সংবাদ সম্মেলনে নুর অনেকটা দম্ভের সঙ্গে বলেছেন, ৩ কোটি টাকার সুবিধা নিয়ে সরকারের সঙ্গে নির্বাচনে যাওয়া হাস্যকর। ৩০০ কোটি টাকা নেয়ার কথা বললে হয়তো যৌক্তিকতা থাকতো। তিনি বলেছেন, এত কম টাকায় বিক্রি হয় না নুর।
নুরের এই দম্ভোক্তির দুটি মানে হতে পারে। এক. নুর নীতিবান নেতা। কোনো প্রলোভন তাকে টলাতে পারবে না। দুই. ৩ কোটিতে নুর বিক্রি হয় না। ৩০০ কোটি হলে বিক্রি হবে।
শ্রদ্ধেয় নাট্যজন মামুনুর রশীদ রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছেন। এই নিয়ে এখনো আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আমরা মানি বা না মানি দেশে রুচির দুর্ভিক্ষই এখন মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগযোগমাধ্যম নীতিহীন, পথভ্রষ্ট মেধাহীন মানুষকে নেতা বানাচ্ছে। হিরো আলম শোষিত, নির্যাতিত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ঢাকা-১৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। নির্বাচনী হলফনামায় বার্ষিক আয়ের ঘরে যে অর্থের কথা লিখেছেন তার সঙ্গে বগুড়ায় প্রাসাদসম বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থের কোনো সঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার মানে হিরো আলমেরও প্রাসাদসম বাড়ি হচ্ছে। এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে। তার মানে রাজনীতিও কি তাহলে কারও কারও কাছে নিছক ব্যবসা? এই ব্যবসায় দেশের জনগণ কোথায়? হায়রে জনগণ!
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো
পাঠকের মতামত
হিরো বেচারাতো কিছু করতে পারবেনা। তাইনা রেজানুর সাহেব? আপনার কাছে অনুরোধ থাকলো পক্ষপাতদুষ্ট লিখা বর্জন করুন। আর না পরলে লিখবেন না।
আপনি লিখার শেষে এসে ওই কেষ্ট বেটা হিরো আলমকে ধরেছেন উদাহরণ হিসেবে আর কারও নাম পাননি। আরও কারও নাম উল্লেখ করলে হয়তো মামলা খাবেন এই ভয়ে। হিরো বেচারাতো কিছু করতে পারবেনা। তাইনা রেজানুর সাহেব? আপনার কাছে অনুরোধ থাকলো পক্ষপাতদুষ্ট লিখা বর্জন করুন। আর না পরলে লিখবেন না। এমনিতে আপনার লিখা গুলো গদ বাঁধা কোন গভীরতা নাই। আপনি বিনোদন পত্রিকা বের করতেন ওটা নিয়েই থাকুন।
রাজনীতি যে একটা ব্যবসা তা আপনি সাংবাদিক হয়ে এতদিন পরে বুঝলেন , আর আমি সাধারণ আম জনতা ৭৫ সালের পর থেকেই বুঝতে পেরেছি।
রাজনীতি পেশা বা ব্যবসা নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতায় সহজে ঘুষ দূর্নীতি ও চাঁদাবাজি করে পার পাওয়া যায়। ফলে রাজনৈতিকরা প্রচুর অবৈধ সম্পদের মালিক হয়।
রাজনীতি কি তাহলে ব্যবসা? কোন দেশে বাস করেন ভাই? এ দেশের একটা পাগলও এটা জানে যে বাজনীতি একটা ব্যাবসা, তাইতো ব্যাবসায়ীরা তাদের নিজেদের ব্যাবসা ছেড়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছে।