নির্বাচিত কলাম
চলতি পথে
ঈশ্বর আছে মানুষ নাই
শুভ কিবরিয়া
৫ জুলাই ২০২৩, বুধবার
বাজার অর্থনীতি, পুঁজিবাদের বল্গাহীন উল্লম্ফন ও সাফল্য সম্ভবত ইউরোপীয় নবজাগরণের আলোকায়ন ভাবনাতে একটা কালো পর্দা ফেলে দিয়েছে। মানুষের ধর্মচিন্তাতেও তার প্রভাব পড়েছে বিস্তর। ধর্ম অনেক বেশি ‘ধর্মকেন্দ্রিক’ হয়ে পড়েছে। ধর্ম তার ‘নৈতিকতাকেন্দ্রিক’ আলোচনা থেকে সরে গেছে। আরও সহজ করে বললে বলা যায়, ধর্মের সকল বিবেচনা থেকে আমরা যতটা আচার-অনুষ্ঠান পালনে উৎসাহী হয়েছি, ধর্ম বিবেচনার কেন্দ্রে ততটা ‘মানুষ’কে রাখিনি। শুধু তাই নয়, ধর্মের যে প্রবলতর শক্তি নৈতিকতায় সেখান থেকেও ‘মানুষ ও মানবতাকে’ দূরে সরিয়ে রেখেছি। তাই মানুষ ঠকাতে, মানুষকে বিপদে ফেলতে, ধর্মাচরণ কিংবা ধর্মচর্চা আর আমাদের আটকাতে পারছে না
এবার গরম পড়েছিল খুব। সঙ্গে ছিল লোডশেডিং। ঢাকাবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। কেননা, ঢাকায় আছে বিপুল মানুষ।
এবারের ভীষণ গরমে চার্জার ফ্যানের বাজারের হালহকিকত জানতে, হাজির হলাম এক পরিচিত ছোট ভাইয়ের দোকানে। মাঝে মধ্যে ওর দোকানে বসি। ফ্যান, ঘড়ি, চার্জার, ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্সের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা। ছোট ভাইদের পরিবার বনেদি এবং বাজারকে প্রভাবিত করার মতো শক্তিমান ব্যবসায়ী। কিন্তু সবসময় তারা একটা ন্যূনতম নীতি মেনে চলা ব্যবসায়ী। বছরের পর বছর ধরে ‘কম লাভ বেশি বিক্রি’ আর ‘গ্রাহকসন্তুষ্টি’ তাদের ব্যবসায়িক নীতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছোট ভাই’র সংস্কৃতি চর্চার অভিঘাত। বহু বছর ধরে ছোট ভাইটি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। বইপড়ার পুরনো অভ্যেস এখনো তার সচল। তার ভাষায়, ‘একটা বিবেচনাবোধ সবসময় বিবেককে জাগিয়ে রাখে’। ফলে, ওদের দোকানে বসলেই বাজারের হালফিল আর ভেতরের অনেক গোপন খবর আলোচনার সূত্রে বেরিয়ে আসে, নীতি আলোচনার ফলাফল হিসেবে।
ছোট ভাইটির কাছেই জানলাম, এবার এমনো হয়েছে, ১৭০০ (এক হাজার সাত শত) টাকার চার্জার টেবিল ফ্যান ৫১০০(পাঁচ হাজার একশত) টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। ফুটপাথের হকারি করা কয়েকজন দু-চার দিনে লাখ পাঁচেক টাকা লাভও করেছে। তারপর, এই অসীম লাভের পথ তাদের বেসামাল করে দেয়। তারা আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবের কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা ধার করে চার্জার ফ্যান কিনে আনে চড়া দামে। তাদের ভাবনায় ছিল আরও চড়া দামে বিক্রি করে তারা বিপুল টাকা বাগিয়ে নেবে। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি, তাদের সে আশায় গুড়ে বালি ঢেলে দেয়। বাজারে চার্জার ফ্যানের দাম পড়ে যায়। কিন্তু তাদের চড়া দামের কেনা ফ্যান অবিক্রীত পড়ে থাকে। দুদিনে পাঁচ লাখ টাকা লাভ দেখে তারা পঁয়ত্রিশ লাখ টাকার মালামাল কিনে আনে চড়া দামে। এই বিপুল টাকা এখন ঘরবন্দি। অন্যদিকে মালের দাম কম। ফলে তাদের দেউলিয়া হবার অবস্থা।

আমরা পুরো অবস্থাটার একটা মূল্যায়নে বসি। প্রথমত, ১৭০০ টাকার একটা ফ্যানে স্বাভাবিক নিয়মে ২০০-২৫০ টাকা লাভেই বেচা-বিক্রির কথা। এই নিয়মে একটা চার্জার ফ্যান বিক্রি হবার কথা সর্বোচ্চ ১৫% লাভে। কিন্তু ১৭০০ টাকার চার্জার ফ্যান যখন ৫১০০ টাকায় বিক্রি হয়, তখন লাভ দাঁড়ায় ২০০%। গাণিতিকভাবে এটা একটা অস্বাভাবিক অবস্থা। কেননা স্বাভাবিক লাভের চেয়ে এই লাভ (২০০-১৫)=১৮৫% বেশি। আবার এই অস্বাভাবিক লাভ তাকে একটা বিপুল মুনাফার পথ দেখায়। এই মুনাফা ব্যবসার স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে না। মানুষকে বাধ্য করে, বেকায়দায় ফেলে ঘটানো হয় এই মুনাফা। একে লুণ্ঠনমূলক মুনাফা বলাই ভালো। এই লুন্ঠনমূলক মুনাফাতেই দু-চার দিনে ৫ লাখ টাকা আয় হয়। সেটাই তাকে বিবেচনাশূন্য করে আরও অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের দিকে ঠেলে দেয়। সে ধারদেনা করে ৩০-৩২ লাখ টাকা বিপজ্জনক বিনিয়োগে পাগলপরা হয়ে ওঠে। অবশেষে, চড়ামূল্যে কেনা দ্রব্য অবিক্রীত থাকে। একদিকে তার লোকসান হয় অস্বাভাবিক। অন্যদিকে আটকে থাকে বড় বিনিয়োগ।
আমি প্রশ্ন করি এই অস্বাভাবিক অবস্থার জন্য দায়ী কে? ছোট ভাই নীতিশাস্ত্র পড়া মানুষ। তার উত্তর, ‘দায়ী হচ্ছে অসীম লোভ’। আর, অপেশাদারি মনোভাব। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক মুনাফায় চলতে অভ্যস্ত। তারা বাজারের গতি-প্রকৃতি, ওঠা-নামা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা রাখে। সে অনুযায়ী ব্যবসা চালায়। অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রিত বাজার দেখার মনিটরিং ব্যবস্থা আমাদের এখানে প্রায় ব্যর্থ। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাজ অনেকটাই লোক দেখানো, মিডিয়ার সামনে লম্ফঝম্ফতেই সারা। তা ছাড়া তাদের আইনেও সীমাবদ্ধতা আছে। লোকবলেও আছে ঘাটতি।
এ রকম লোভের কারণ কী? কেন মানুষ এ রকম বেপরোয়া হয়ে ওঠে, অমানুষিক লোভে? এই প্রশ্ন রাখলাম ব্যবসায়ী ছোট ভাই’র কাছে। তার উত্তর দু-রকম। প্রথমত, অভিজ্ঞতার অভাব। ব্যবসা যে ঠুনকো জিনিস নয়, একদিনেই, এক সপ্তাহেই কিংবা এক মাসেই যে ব্যবসা শেষ হয়ে যায় না, একে যে ধীরে ধীরে বড় ও বৃহৎ করে তুলতে হয়, সেই অভিজ্ঞতা এই ভূইফোঁড় ব্যবসায়ীদের নেই। এরা আঙ্গুল ফুলেই কলাগাছ হতে চায়। এই অনভিজ্ঞতাই তাদের বিপথে ঠেলে, বিপদে ফেলে। দ্বিতীয়ত, ঠিক এর উল্টো কারণেই তারা উৎসাহিত হয়। তারা তাদের চোখের সামনে পাড়ায়, মহল্লায়, সংসদীয় আসনে, রাষ্ট্রে দেখে, দ্রুত বড়লোক হবার এটাই সবচাইতে শর্টকার্ট পথ। তাদের চোখের সামনে এরকম উদাহরণ ভুড়ি ভুড়ি। তারা দেখে ছোট ছোট লুন্ঠনমূলক মুনাফাই এক সময় বড় ব্যবসায়ী বানায়। এক সময় ব্যাংক ডিফল্টার বানায়। এক সময় তারাই এমপি, মন্ত্রী হয়। এক সময় তারাই ব্যবসায়িক সংগঠনে, রাজনৈতিক সংগঠনে সমীহ জাগানিয়া বড় পদে জায়গা পায়। পত্রিকায় পাতায় ঋণখেলাপি হিসেবে নাম ওঠে, সেটাই বরং জাতির সামনে তাকে ক্ষমতাশালী করে তোলে। চোখের সামনে এ রকম শত শত উদাহরণ তাদের মরিয়া করে ফেলে। এদের মধ্যে হাজার জনের চেষ্টায় দু-একজন যে সফল হয় না, তা-না, কিন্তু একটা বড় অংশই ঝরে পড়ে। তারপর, ধর্মই এদের আশ্রয়ের জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। জীবন থেকে তারা নিজেদের গুটিয়ে নেয়। অনেকেই মাদকে মুক্তি খোঁজে।
ছোট ভাই ব্যবসায়ীর কথায় যুক্তি হয়তো আছে কিছুটা, কিন্তু তার এই উপলব্ধি, সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতাজাত। সে তার এলাকার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রয়াত এমপি’র নাম বললো। তার পরিবারের একাল-সেকালের গল্প শোনালো। তার দোকানের বিপরীতে থাকা সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়া ব্যবসায়ীর দোকানের দিকে ইঙ্গিত করে সেই ব্যবসায়ী পরিবারের অন্দরমহলের গল্প শোনালো। তারপর একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই বললো, আমাদের চোখের সামনে ভালো ও মন্দ, দুটোই উদাহরণ হিসেবে আছে। কিন্তু মানুষ কেন যে খারাপটাতেই আগ্রহী হয়!!!
ছোট ভাই ব্যবসায়ী, এবার আমাকেই বিপাকে ফেলে। জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ভাই, মানুষ তো আগের চেয়ে অনেক বেশি ধার্মিক হয়েছে। মসজিদে গেলে জায়গা পাওয়া যায় না। মুসল্লি এত বেড়েছে। শুক্রবারে জুমার নামাজে ঢাকা শহরে বহু ব্যস্ত সড়ক বন্ধ করে নামাজি মানুষের ঢল নামে। শুধু পুরুষরা নয়, নারীদের দিকেও তাকালে দেখবেন, পরহেজগারি-হিজাবি পোশাকের বিপুল বিস্তৃৃতি। হজে যাচ্ছে প্রচুর মানুষ, অনেক টাকা খরচ করেই। তবুও অফিসে আদালতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কোথাও তো ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। তাহলে মানুষের এই ধর্মবোধ যায় কোথায়? তাহলে কি ধর্মের শক্তিই কমে গেল? নাকি, মানুষ মেনে নিয়েছে ‘ধর্ম যার যার, ঘুষ নেয়া-দেয়া সবার’।
ব্যবসায়ী ছোট ভাই’র আবেগ ও বেদনা আমাকেও তড়িত করে। আপাতত আমি তার কাছ থেকে বিদায় নেই, জরুরি কাজের কথা বলে। কিন্তু আমার মাথায় এই ভাবনা ঘুরতে থাকে। কেন এত ধর্মাশ্রয়ী হয়েও মানুষ অসীম লোভ আর সীমাহীন মুনাফার পেছনে ছুটছে, মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষকে বাধ্য করে?
পুনশ্চ: বাজার অর্থনীতি, পুঁজিবাদের বল্গাহীন উল্লম্ফন ও সাফল্য সম্ভবত ইউরোপীয় নবজাগরণের আলোকায়ন ভাবনাতে একটা কালো পর্দা ফেলে দিয়েছে। মানুষের ধর্মচিন্তাতেও তার প্রভাব পড়েছে বিস্তর। ধর্ম অনেক বেশি ‘ধর্মকেন্দ্রিক’ হয়ে পড়েছে। ধর্ম তার ‘নৈতিকতাকেন্দ্রিক’ আলোচনা থেকে সরে গেছে। আরও সহজ করে বললে বলা যায়, ধর্মের সকল বিবেচনা থেকে আমরা যতটা আচার-অনুষ্ঠান পালনে উৎসাহী হয়েছি, ধর্ম বিবেচনার কেন্দ্রে ততটা ‘মানুষ’কে রাখিনি। শুধু তাই নয়, ধর্মের যে প্রবলতর শক্তি নৈতিকতায় সেখান থেকেও ‘মানুষ ও মানবতাকে’ দূরে সরিয়ে রেখেছি। তাই মানুষ ঠকাতে, মানুষকে বিপদে ফেলতে, ধর্মাচরণ কিংবা ধর্মচর্চা আর আমাদের আটকাতে পারছে না। ধর্মাচারণের এই বিপুল প্রসারের যুগেও মানুষ ‘নৈতিকতাকে’ খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। মানুষের এই ভ্রান্তি থেকে মানুষকে তাই ফেরাতে হবে, মানবকল্যাণের স্বার্থেই। ধর্মে নৈতিকতা এবং সেই নৈতিকতার কেন্দ্রে মানুষকে আজ তাই জাগাতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক। [email protected]
পাঠকের মতামত
কোন ব্যবসায়ী অসীম লোভী নয় বলুন। আপনার ছোট ভাই হয় হয়তো বনেদি ব্যবসায়ী কিন্তু বাংলাদেশের ছোট বড় শতকরা ৯৫% ব্যবসায়ী অসীম লোভের সাগরে। আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা একজন আরেক জনকে দুষছে, আর ধার্মিকের কথা বলেছেন ধর্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে মনে হচ্ছে আপনার, কিন্তু আসলে তা নয় ধর্মের আড়ালে ভন্ডামী বেড়েছে। লোভ আর ধর্ম এক জিনিস নয়। যে কথাটা আপনার ছোট ভাই বলেনি সেটা হলো সুশাসন সুশাসনের অভাবেই আজ আমাদের রাস্ট্রের এই দুরাবস্থা যারা রাস্ট্র শাসন করছে তারাইতো লোভের সাগরে ডুবে আছে। আর এই লোভ ছড়িয়ে পরেছে ভাইরাসের মতো। "লোভের সাগর পুকুরে যায়" একদিন সেটা অবশ্যই হবে। এটাই নিয়তি। পুনশ্চঃ চার্জার ফ্যান এর কথা বলেছেন একটা ছোট ব্যবসায়ী লোভে পরে ৩২ লাখ টাকার ফ্যান কিনেছিলো। এবার বড় ব্যবসায়ীর কথা বলি একজন আমদানি কারক ২০ কন্টেইনার চার্জার ফ্যান আমদানি করেছিলো ঐ দিনের পর, যে সংবাদ প্রথম আলো তে প্রকাশিত হয়েছিলো।
মানুষ ধর্ম পালন করে কিন্তু ধার্মিক হয়না। কেউ কেউ বকধার্মিক। তাঁরা দোয়া তাবিজ তদবিরে কন্ট্রাক্টরি করে। এদেশের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ মুসলমান। কিন্তু তারা ইসলাম বুঝে না। মুনাফালোভীর স্থান ইসলামে নেই। তাই আল্লাহর বিচারে ফ্যান ব্যবসায়ীদের 'অতিলোভে তাঁতি নষ্ট' হয়েছে।