নির্বাচিত কলাম
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেবেন শেহবাজ
নতুন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ নাকি বিলাওয়াল? আশাহত হবেন জারদারি!
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
৩ জুলাই ২০২৩, সোমবারআগামী জাতীয় নির্বাচনে পাঞ্জাব প্রদেশে পিএমএলএনের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনার আগ্রহ দেখিয়েছেন জারদারি। পিপিপি’র একজন নেতা বলেছেন, পাঞ্জাবে পিপিপি’র অল্প কিছু বড় মাপের প্রার্থীর নাম পিএমএলএন বিবেচনা করবে বলে আশা করেন জারদারি। পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির চেয়ারম্যান ইমরান খানের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে দুবাই বৈঠকে। আলোচনা হয়েছে, পিটিআইকে সামনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া হবে নাকি নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা হবে, তা নিয়ে। পিপিপি’র ওই নেতা বলেছেন, পিটিআই’র বিরুদ্ধে ৯ই মে’র ঘটনার আগে উভয় পক্ষ পুরোপুরি একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিল
পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সরকার মেয়াদ শেষে ক্ষমতা তুলে দেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া চলছে। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছেন, নওয়াজই হতে যাচ্ছেন আগামীতে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী। তাতে দৃশ্যত সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি আশাহত হতে পারেন। কারণ, তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। চাইছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন তার ছেলে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। ইমরান খানের যে জনপ্রিয়তা তাতে তাদের এসব আশা গুড়েবালি হতে পারে। এমন ভয়েই হয়তো নওয়াজ শরীফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) এবং জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) শীর্ষ নেতারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। সেখানে এসব বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভট এক রাজনীতির দেশ পাকিস্তান। দেশটি স্বাধীনতা অর্জনের পর বার বার অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে সেনাবাহিনী। এর ফাঁকে ফাঁকে যেসব বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে জেনারেলরা। তাদের আঙ্গুল হেলনিতেই সরকার পরিচালিত হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকেও তারাই ক্ষমতায় এনেছিল। আবার তার ক্ষমতাচ্যুতির জন্য তারাই দায়ী বলে বিশ্বাস করেন সবাই। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশটির রাজনীতি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। কৌশল, কূটকৌশলে কে সেরা, তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ক্ষমতাচ্যুত হলেও এখনো ব্যাপক জনপ্রিয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। বর্তমান জোট সরকারে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন), পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) থাকলেও তাদের ভয়ের কারণ ইমরানের ওই জনপ্রিয়তা। এ জন্য পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি ভয়াবহভাবে ঘোলাটে হয়েছে। বিষয়টি আদালতে উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ও পার্লামেন্ট যেন একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিচ্ছে, পার্লামেন্ট তাকে উল্টে দিচ্ছে। আবার পার্লামেন্ট যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট তার উল্টো। ঝড়ের সময় সমুদ্রের পানিতে যেমন ঢেউ খেলে যায়, উত্তাল হয়ে ওঠে সমুদ্র, তেমনি বার বার আন্দোলিত হচ্ছে পাকিস্তানের রাজনীতি। সেখানে যে করেই হোক ইমরান খানকে থামিয়ে দেয়ার কৌশল প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ জন্য অবশ্য লন্ডন থেকে ‘রাজা চেক’ দিচ্ছেন পিএমএলএনের সুপ্রিমো, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। তাই বার বার ক্ষমতাসীন জোটের নেতারা লন্ডন উড়ে গিয়েছেন, যাচ্ছেন। সেখান থেকে ঘুঁটি যেভাবে চালতে বলা হয়, তারা সেভাবে চালেন। ফলে পাকিস্তানে এখন নওয়াজ শরীফ ক্ষমতায় না থাকলেও বলা চলে সরকারের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আছে। তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন তার ছোট ভাই প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। সঙ্গে আছে পিপিপি। সম্প্রতি এই দুই দলের মধ্যে মান-অভিমানের ঘটনা ঘটেছে বলে জল্পনা ছড়িয়েছে। আবার সামনে জাতীয় নির্বাচন। যদি ইমরান খানকে থামিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় অব্যাহতভাবে থাকতেই হয়, তাহলে এই মান-অভিমান কমিয়ে তার পরিবর্তে ‘রোমাঞ্চকর’ এক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নির্বাচনের রূপরেখা নির্ধারণ করতে হবে। এসব কৌশল চূড়ান্ত করতেই গত সপ্তাহে দুই দলের কর্ণধাররা দুবাইয়ে উড়ে যান। প্রথমদিকে তাতে নওয়াজ শরীফের যোগ দেয়ার খবর জানা না গেলেও, পরে শোনা যায় তিনি তাতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সময়ে তারা বেশ কিছু ইস্যুতে আলোচনা করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু। ক্ষমতাসীনরা বুঝতে পেরেছেন, দলীয় সরকারের ওপর কারও আস্থা নেই। তাই নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হয়, সেজন্য নির্বাচন হতে হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এই সরকারে কোন কোন নাম দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হলে দুই দলের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির ফর্মুলা তৈরি করা হয়েছে। দুবাইয়ের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে উভয় দলের যেসব নেতা উপস্থিত ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম পিএমএলএনের নেতা নওয়াজ শরীফ, তার ছোট ভাই ও প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ, পিপিপি’র সহ-সভাপতি ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি, তার ছেলে পিপিপি’র সভাপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি, আইনমন্ত্রী আযম নাজির তারার, পিএমএলএনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মরিয়ম নওয়াজ প্রমুখ। এতে তারা আগামী নির্বাচনের তারিখ ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
কিন্তু এ সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো নওয়াজ শরীফকে দেশে ফেরানো। তিনি সরকারি পদে যাবজ্জীবন অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন আদালতের নির্দেশে। তারপর জেলে গিয়েছেন। অসুস্থ হয়েছেন। তারপর চিকিৎসার নাম করে নির্বাসনে গিয়েছেন বিদেশে। থিতু হয়েছেন লন্ডনে। তা সে অনেক বছর হয়ে গেছে। কিন্তু তাকে দেশে ফেরানোর জন্য বর্তমান জোট সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। এ জন্য সম্প্রতি তারা কোনো পার্লামেন্টারিয়ানের অযোগ্য ঘোষণার মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর ধরে আইন সংশোধন করেছে। নওয়াজ শরীফের ক্ষেত্রে এই ৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে অনেক আগে। ফলে এই আইনের ফলে তিনি দেশে ফিরে রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন- এমনটাই আশা করা হচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানে এখন যে প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল তার সঙ্গে সরকারের স্পষ্ট বিরোধ। তার আলোকে নওয়াজ শরীফ এখন দেশে ফিরলে কোনো আইনি সমস্যায় পড়তে পারেন কিনা, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মিয়া জাভেদ বলেছেন, আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন নওয়াজ শরীফ এবং চতুর্থ মেয়াদে তিনি হবেন প্রধানমন্ত্রী। জল্পনা আছে, আদালতের সব অভিযোগ থেকে যদি স্বস্তি মেলে, তাহলে আগামী ১৪ই আগস্ট দেশে ফিরতে পারেন নওয়াজ শরীফ।
দুবাই মিটিংয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ, সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি, আইনমন্ত্রী ফিরেছেন পাকিস্তানে। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি উড়াল দিয়েছেন টোকিওর উদ্দেশ্যে। ডনের মতে, লন্ডন থেকে এসে ওই মিটিংয়ে যোগ দেন নওয়াজ শরীফ। তিনি সেখানে কমপক্ষে এক সপ্তাহ অবস্থান করবেন। এ সময়ে রাজনীতি এবং ব্যবসা বিষয়ক মিটিং করবেন। এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক ইস্যুতে পিএমএলএন এবং পিপিপি’র মধ্যে ভিন্নমত দেখা দেয়। অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচন হবে কিনা এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখায় পিএমএলএন। তবে পিপিপি বলেছে, যথাসময়েই নির্বাচন চায় তারা। পিপিপি’র সিনিয়র নেতা এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কমর জামান কাইরা বলেছেন, পিপিপি বলেছে- বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে এই আগস্টে। এরপরই নির্বাচন হওয়া উচিত অক্টোবরে। তিনি আরও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখার পর নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আর কোনো মতবিরোধ নেই।
শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন শেহবাজ শরীফ। তিনি বলেছেন, তার সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগস্টে। এরপরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে যারাই বিজয়ী হোন, তারা জনগণের জন্য কাজ করবে। দেশকে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য কাজ করবে।
জল্পনা আছে আরও। বলা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের তারিখ নিয়ে পিপিপি একমত হয়েছে। এর কারণ আছে। তাহলো, নিজের ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে তিনি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। এ ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচনে পাঞ্জাব প্রদেশে পিএমএলএনের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনার আগ্রহ দেখিয়েছেন জারদারি। পিপিপি’র একজন নেতা বলেছেন, পাঞ্জাবে পিপিপি’র অল্প কিছু বড় মাপের প্রার্থীর নাম পিএমএলএন বিবেচনা করবে বলে আশা করেন জারদারি। পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির চেয়ারম্যান ইমরান খানের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে দুবাই বৈঠকে। আলোচনা হয়েছে, পিটিআইকে সামনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া হবে নাকি নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা হবে, তা নিয়ে। পিপিপি’র ওই নেতা বলেছেন, পিটিআই’র বিরুদ্ধে ৯ই মে’র ঘটনার আগে উভয় পক্ষ পুরোপুরি একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিল। কিন্তু তারা মনে করছে আসন্ন নির্বাচনে ইমরান খান আর প্রাসঙ্গিক নন। অন্ততপক্ষে ক্ষমতাসীন জোট পিডিএমের দৃষ্টিতে।