নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
অভ্যাস মানুষের দাস হবে নাকি মানুষ অভ্যাসের দাস হবে?
রেজানুর রহমান
২৮ জুন ২০২৩, বুধবার
এই ঈদে আনন্দ বিনোদনের ক্ষেত্রে রাজধানীবাসীর জন্য নতুন খবর আছে। ঈদের দিন শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে একটি নতুন মঞ্চ নাটক দেখা যাবে। নাটকের নাম ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা অবলম্বনে নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন মঞ্চ নাটকের ব্যাপক আলোচিত ব্যক্তিত্ব সবার প্রিয় জামিল আহমেদ। এর আগে তার নির্দেশনায় শিল্পকলার মঞ্চে ঈদের দিন নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। জামিল আহমেদ ঈদের অনুষ্ঠানমালার ক্ষেত্রে একটি অচলায়তন ভাঙতে চেয়েছেন। তার বক্তব্য পরিষ্কার- ঈদে যদি নতুন সিনেমার মুক্তি দেয়া যায় তাহলে মঞ্চ নাটক কেন নয়? জামিল আহমেদের এই উদ্যোগের প্রতি দর্শকের বেশ সাড়া মিলেছে। অনলাইনে অগ্রিম টিকিট কিনে দর্শক নাটকটি দেখছেন। ঈদের দিন পরপর দুটি শো হবে। পরের দিনও আছে বিশেষ প্রদর্শনী।
দিনের টিকিট দিনে পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। দেশের মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে এ এক বিস্ময়কর পরিবর্তন। হ্যাঁ, একটা সময় সেই ৮০ থেকে ৯০’র দশকে বেইলি রোডের নাটকপাড়ায় মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মঞ্চে অনেক আলোচিত নাটকের শো শুরুর আগে গেটে ‘হাউসফুল’ লেখা বোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হতো। নাটকের অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করার জন্যও দর্শক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন। কিন্তু সময় তো সব সময় সমান যায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে একটা সময় মঞ্চ নাটকে দর্শক কমে গেল। বলতে কষ্ট হয়। মহিলা সমিতিতে মঞ্চ নাটকের জোয়ারের প্রভাবে বেইলি রোড এলাকা রাজধানীর একটি বিশেষ এলাকার মর্যাদা লাভ করে। খাবার দাবার থেকে শুরু করে পোশাক, কসমেটিকসসহ গেরস্থালির নানা পণ্যের পসরা সাজানোর জন্য রাস্তার দুই পার্শ্বে আকাশচুম্বী মার্কেট অর্থাৎ বিপণিবিতন গড়ে ওঠে। ৫০’র বেশি খাবার দোকানই আছে এই এলাকায়। মঞ্চ নাটকের প্রভাবে যে এলাকা আলোকিত হয়েছে সেই এলাকায় এখন মঞ্চ নাটক তেমন আগ্রহ পায় না।
গাইড হাউস এবং মহিলা সমিতি পাশাপাশি দুটি মঞ্চে এক সময় প্রতিদিন নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হতো। গাইড হাউসের মঞ্চ এখন নাটকের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় না। আগের সেই মহিলা সমিতি নতুন আধুনিক ভবন পেয়েছে। আগে ছিল নিচতলায় নাটকের মঞ্চ। এখন আধুনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় স্থান পেয়েছে নাটকের মঞ্চটি। প্রতিদিন বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের নাটক মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু আগের মতো যেন দর্শকের আগ্রহ নাই। আশার কথা, সম্প্রতি থিয়েটারওয়ালা রিপার্টরির উদ্যোগে ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ নামে একটি নতুন নাটকের টানা ৯ দিনের প্রদর্শনী হয়। এই নাটকের ক্ষেত্রেও দিনের টিকিট দিনে পাওয়া যায়নি। হাউসফুল ছিল প্রতিটি শো।

জামিল স্যারের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ এবং থিয়েটারওয়ালার ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ নতুন দুটি মঞ্চ নাটক মঞ্চপাড়ায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বলা হয়, মঞ্চে দর্শক কমে গেছে। কথাটি আদৌ ঠিক নয়। মঞ্চে যদি দর্শক কমেই থাকে তাহলে ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ ও ‘আমি বীরজ্ঞনা’র ক্ষেত্রে অগ্রিম টিকিট পাওয়া নিয়ে হাহাকার পড়লো কেন? তার মানে মঞ্চের দর্শক আছে। তবে তারা চমক চায়। চমকটা হলো নাটকের কনটেন্ট। যদিও অনেকে বলছেন, জামিল আহমেদ দেশের একজন কিংবদন্তি-তুল্য মঞ্চ নির্দেশক। নাটকের অঙ্গনেই তার শত শত ছাত্র-ছাত্রী আছে। জামিল স্যারের নাটক হাউসফুল করার জন্য তো তার ছাত্র-ছাত্রীরাই যথেষ্ট। এই কথার কোনো যক্তি আছে বলে আমি মনে করি না।
‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ নাটকের নির্দেশক সাইফ সুমন একেবারেই তরুণ নির্দেশক। তার নাটকও তো হাউসফুল হয়েছে। কেন হাউসফুল হলো? একটাই কারণ নাটকের কনটেন্ট আর প্রচারের অভিনভত্ব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অর্থাৎ ফেসবুক এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। শুধু মঞ্চ নাটকই নয় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাড়িতে বসে কোরবানির পশু কেনা যাবে এমন ভাবনা কি ২০/২৫ বছর আগে কেউ ভেবেছিল? অথচ বর্তমান সময়ে এটাই বাস্তবতা। এবার ঈদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পশু বিক্রি হয়েছে অনলাইনে। শুধু কি কোরবানির পশু, ঈদের নতুন পোশাক, গেরস্থালির প্রয়োজনীয় সবকিছুই এখন পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। ফলে ঈদের সংস্কৃতিও গেছে পাল্টে। ঈদ আয়োজনের অনেক কিছুই এখন নির্ভর করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর।
ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। রহিম সাহেব মনস্থির করলেন এবার গরু কোরবানি দেবেন। অথচ গরুর হাটে যেতে চান না। তার ছেলে অনলাইনে অনেক খোঁজাখুঁজির পর পছন্দসই একটি গরুর অর্ডার দিল। অনলাইনেই টাকা পাঠানো হলো। গরু এসে গেল নির্ধারিত সময়ে। ঈদের বাজার করবেন রহিম সাহেব। লিস্ট পাঠিয়ে দিলেন একটি অনলাইন মার্কেটে। এক ঘণ্টার মধ্যেই ঈদের বাজার হাজির। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে ঈদ উৎসবের রঙ পাল্টেছে। যোগাযোগ সহজ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনটা যেন একটু আলগা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রযাত্রাকে আমরা আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের সঙ্গেও তুলনা করতে পারি। প্রদীপে ঘষা দেয়া মাত্র দৈত্য হাজির। আমি বাড়ির সামনে পাহাড় দেখতে চাই। দৈত্যের কাছে এটা কোনো ব্যাপারই না। চোখের পলকে পাহাড় তৈরি হলো। এটা একটা চমক। কিন্তু সহজ পদ্ধতির চমক বেশিক্ষণ আনন্দ দেয় না। কষ্টের মাধ্যমে অর্জন করা সব কিছুই হয়ে উঠে বিপুল আনন্দের অনুষঙ্গ। ঈদে কোরবানির পশু কেনার কথাই যদি বলি, হাটে গিয়ে পশু কেনার মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা, আনন্দ থাকে। কোরবানির পশু কিনে বাড়ি ফেরার সময় কতোজনই না জানতে চায়-ভাই কতো নিলো? এই যে অচেনা মানুষের আগ্রহ এটাও ব্যাপক আনন্দের বিষয়। কিন্তু অনলাইনের কেনাকাটায় এই আনন্দ নাই। অনেকটা রোবটের সঙ্গে সময় কাটানোর মতো অবস্থা।
তবে একথা তো সত্য তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক ঝুট-ঝামেলা কমে গেছে। এই তো ১০/১২ বছর আগেও ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষকে বাসের কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কিনতে হয়েছে। এখন ঘরে বসে অনলাইনে টিকিট কেনার অবারিত সুযোগ। কোরবানির পশু কেনা যায় অনলাইনে। ট্রেন, লঞ্চ, বাসের টিকিট কেনা যায় অনলাইনে। ঈদের বাজার করতেও অনলাইন হাজির। শুধু দরকার একটি মোবাইল ফোন। অর্ডার করো। টাকা পাঠাও। কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্ডারের সব জিনিসপত্র হাজির।
সত্যি কথা বলতে কি এটা একটা বিস্ময়কর পরিবর্তন। বাড়িতে বসে সবকিছুই পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে জীবনযাত্রারও পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তনটাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে আতঙ্কেরও জন্ম দিচ্ছে। অনেকটা তুষের আগুনের মতো। তুষের আগুন দেখা যায় না। ভেতরে ভেতরে পোড়ায়। একটা সময় দেখা যায় বালির বাঁধের মতো সবকিছুই ভেঙে পড়েছে।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষের চিত্র আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই অছে। তবে অতীতকালে ঈদে বাড়িতে ফিরে প্রায় সবাই হয় কোরবানির জন্য পশু কেনা, না হয় ঈদের বাজার করার কাজে লেগে পড়তেন। এখন গ্রামেও অনলাইন কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয়। গ্রামেও অনলাইনে কোরবানির পশু কেনা-বেচা হচ্ছে। ফলে কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছে না ঘরমুখো মানুষেরা। বাড়িতে গিয়ে মোবাইল ফোন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকে। এক ঈদে একটি পরিবারের পাঁচ সন্তান গ্রামে বেড়াতে গেছেন। বাবা তাদের সবাইকে বাড়ির আঙিনায় ডাকলেন। পরিবারের ভবিষ্যৎ কর্মকা- নিয়ে কথা বলবেন। সঠিক সময়ে সবাইকে পাওয়া গেল না। তবে একটা সময় সবাই এলো। সবার হাতে মোবাইল ফোন। ফেসবুকে ব্যস্ত সবাই। বাবা কথা বলেই যাচ্ছেন। সন্তানেরা মোবাইলে ব্যস্ততা না কমিয়েই শুধু হ্যাঁ, হু করে চলেছেন। একটা মোবাইল ফোনই আমাদের জীবনযাত্রা, পারিবারিক সম্পর্ক, আচার-ব্যবহার সবকিছুতেই প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। একথা সত্য, মোবাইল ফোন এখন আর বিলাসতা নয়। অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস। মোবাইল ফোন ছাড়া জীবনধারণ কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু আমরা কি টের পাচ্ছি যে, মোবাইল ফোনের সংস্কৃতি আমাদেরকে দিনে দিনে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। আমাদেরকে মিথ্যুক বানাচ্ছে? ঈদে যারা নাড়ির টানে বাড়ি যান তারা একটা সময় বাড়ি গিয়েই বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ করতেন। আর এখন বাড়ি গিয়েও মোবাইল ফোনকে সঙ্গী বানান। সারাক্ষণ মোবাইল ফোন। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঠিকমতো পারিবারিক আলাপ আলোচনারও আগ্রহ পান না।
ঈদ আনন্দে একটা সময় দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারে বসার ঘরের টিভি সেটটি ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বিশেষ করে বিটিভি’র ঈদের নাটক, আনন্দমেলা দেখার জন্য সবাই নির্ধারিত সময়ের আগেই টিভি’র সামনে হাজির হতেন। এর ফলে অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে পারিবারিক কথাবার্তাও হতো। এখন অতি জরুরি ওই টিভি সেটটির প্রতি কারও তেমন আগ্রহ নাই। এখন এক একটি মোবাইল সেটই তো এক একটি টেলিভিশন স্টেশন। একই পরিবারে প্রতিটি ঘরের দরজা বন্ধ রেখে মোবাইল ফোনে যে যার মতো দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। এক রুম থেকে অন্য রুমে মোবাইল ফোনে কথা বলে। ঈদেও এই প্রবণতা কমে না।
যুগের প্রয়োজন বলে একটা কথা আছে। মোবাইল ফোন যুগের প্রয়োজনেই এসেছে। অনলাইন সংস্কৃতিও যুগের প্রয়োজন মেটাতেই এসেছে। এখন প্রশ্ন হলো- মানুষ কি যুগের প্রয়োজনে বিচ্ছিন্ন হবে নাকি মানুষই ঐক্যবদ্ধ থেকে যুগের প্রয়োজনকে ডমিনেট করবে? অভ্যাস মানুষের দাস হবে নাকি মানুষই অভ্যাসের দাসে পরিণত হবে?
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে আজকের লেখাটি শেষ করি। আমাদের দেশে এখন অনেক টিভি চ্যানেল। প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেল ৫ দিন, ৭ দিনের ঈদের অনুষ্ঠানমালা সাজিয়েছে। এত আয়োজন সত্ত্বেও আমরা যদি ঈদের দিনও ভিন দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতি আগ্রহ দেখাই সেটা কি ঠিক হবে? এটাও কি অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে?
ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানেই আনন্দ। আনন্দ আর খুশির এই দিনে খোঁজ নিয়েছেন কি প্রতিবেশীর? লাখ লাখ টাকা দিয়ে কেনা পশু কোরবানি হবে আপনার বাড়িতে। খাবারের উৎসব হবে। পাশের বাড়ির অভাবগ্রস্ত পরিবারটির কি খোঁজ নিয়েছেন। প্রতিবেশীকে অভক্ত রেখে ঈদের আনন্দ করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নাই। একইসঙ্গে ঈদে নিজস্ব সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে বিদেশি সংস্কৃতি গুরুত্ব দেয়ারও কোনো মানে হয় না। এ নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে কি?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।