নির্বাচিত কলাম
খোলা চোখে
আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যু, চিকিৎসক কারাগারে, মালিকপক্ষ বাইরে কেন?
লুৎফর রহমান
২৫ জুন ২০২৩, রবিবার
আঁখির মৃত্যুতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি দায়ীদের শাস্তি দেয়ার কথা বলেছেন। আমরা মনে করি এ ঘটনায় ব্যবস্থা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। এখানে কার কী দায়। কার কী দোষ তা খুঁজে বের করে প্রকৃত দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হোক। যাতে ভবিষ্যতে এমন আর একটি ঘটনাও না ঘটে। আঁখির মতো কোনো মায়ের এমন মৃত্যু না হয়।
মাহবুবা রহমান আঁখির ইচ্ছা ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তানের জন্ম দেবেন। তাই শুরু থেকেই সতর্কতার সঙ্গে চিকিৎসক ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসা ও পরামর্শ নিচ্ছিলেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে তিনি পরামর্শ নিয়েছেন ঠিকই কিন্তু নিরাপদে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারেননি। অপচিকিৎসার শিকার হয়ে তার নিজের জীবনটাও বিপন্ন হয়েছে।
রোগীর জীবন যখন সংকটাপন্ন ঠিক সেই সময়ে তাকে অন্য একটি হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এক সপ্তাহ পর ওই হাসপাতালে মৃত্যু হয় আঁখির। ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের গাফিলতির বিষয়টি স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু কথা হলো, শুধু কি সেন্ট্রাল হাসপাতাল? রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা অনেক বেশি। সারা দেশে সরকারি হাসপাতাল আছে সাড়ে ৬শ’র মতো। এসব হাসপাতালে শয্যা আছে ৫১ হাজার।
এ ছাড়া ৫ হাজারের বেশি বেসরকারি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ১ লাখের বেশি। দেশের মানুষের চিকিৎসা প্রয়োজন মেটাতে বড় ভূমিকা রাখছে এই বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। একইসঙ্গে এসব হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ও অপচিকিৎসার শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। অস্বাভাবিক চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। এসব হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের। তাদের অবহেলা ও তদারকির অভাবেই হাসপাতালগুলো স্বেচ্ছাচারের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যে যেভাবে পারে অনিয়ম করে যাচ্ছে। চিকিৎসা ও রোগীর সেবা যেন তেন হলেও আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এই অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে কোথাও কোনো নিয়ম নেই।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের অভিযোগ, ভর্তিযোগ্য নন এমন রোগীদেরও হাসপাতালে রেখে নানাভাবে অর্থ আদায়ের ফন্দি হয় বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে। আইসিইউ, সিসিইউ সেবার নামে চলে গলাকাটা ব্যবসা। রোগী এবং তাদের স্বজনরা জরুরি পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে এসব সেবা নিয়ে থাকেন। বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে যারা যান তারাই কেবল বুঝেন কেমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। কতো ধরনের কৌশল করে রোগীর কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। কতোভাবে রোগী ও তার স্বজনদের জিম্মি করা হয় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তাদের কৌশলের কাছে যেখানে শিক্ষিত, সচেতন মানুষরাই এসব জায়গায় অসহায় বোধ করেন, সেখানে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের কথা তো বলার অপেক্ষা-ই রাখে না। এসব অভিযোগ যে শুধু বেসরকারি হাসপাতালেই হয় তা কিন্তু নয়; সরকারি হাসপাতালেও আছে এমন নানা অনিয়ম।

সর্বশেষ সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনাটি একটা উদাহরণ হতে পারে। এই হাসপাতালটিতে আঁখির প্রসবসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে চরম গাফিলতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে রোগীকে ভর্তির কথা বলা হয়েছিল। ওই চিকিৎক সে সময় দেশে ছিলেন না। রোগীকে ভর্তির পরও তার স্বজনরা ডা. সংযুক্তা সাহার বিষয়ে বার বার জানতে চেয়েছেন। কিন্তু তাদের কাছে চিকিৎসকের অনুপস্থিতির বিষয়টি জানানো হয়নি। ভর্তির পর আঁখির শারীরিক অবস্থা খারাপ হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জরুরি কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সিনিয়র চিকিৎসকদের ডাকা হয়নি। দায়িত্বরত জুনিয়র চিকিৎসকদের দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করায় আঁখির অবস্থা সংকটাপন্ন হয়। তার গর্ভের শিশুটি মারা যায়। একপর্যায়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আঁখির জীবনও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘটনায় নিজেদের দায় স্বীকার করে। আঁখির স্বামী এয়াকুব আলীর দায়ের করা মামলায় দায়িত্বরত দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা এখন কারাগারে। ঘটনার দায় নিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতাল ও চিকিৎসক সংযুক্তা সাহার মধ্যে বাকবিত-া হচ্ছে। ডা. সংযুক্তা বলছেন, তিনি দেশে না থাকলেও তার কথা বলে রোগী ভর্তি করা হয়েছে। এই দায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগী ভর্তির বিষয়টি ডা. সংযুক্তা জানতেন। আঁখির ও তার সন্তানের মৃত্যুর পর এই হাসপাতাল এবং চিকিৎসক দুই পক্ষেরই অনিয়মের তথ্য বের হয়ে এসেছে। ফেসবুকে জনপ্রিয় চিকিৎসক সংযুক্তা সাহা ১৩ বছর ধরে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন ছাড়া চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। মাসে শ শ রোগীর চিকিৎসা দিয়ে অর্থ কামানোর সময় থাকলেও এই চিকিৎসা দেয়ার বৈধতার সনদটি নিতে তার সময় হয়নি তেরো বছরেও।
এই চিকিৎসক স্বাভাবিক প্রসবসেবা দিয়ে রোগীদের কাছ থেকে ২২ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন। আর সেন্ট্রাল হাসপাতালে এই সেবা নিতে রোগীকে মোট খরচ করতে হয় ৭০ হাজার টাকা। একটা স্বাভাবিক প্রসবে ৭০ হাজার খরচ! এটা স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক এটা চিকিৎসা ক্ষেত্রে জড়িতরাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু কথা হলো একটা স্বাভাবিক প্রসবে এত টাকা নিলে সিজারিয়ান প্রসবে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কতো টাকা নেয়। এই অঙ্ক লাখ টাকার বেশি। ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি টাকা খরচ করতে হয় রোগীকে। সেবার বিনিময়ে এত টাকা আদায় করা হলেও হাসপাতালটি সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে যে নজির সৃষ্টি করেছে তা দেখে অনেকে এখন ওই হাসপাতালে যেতেই ভয় পাবেন। অনিয়মের কারণে ইতিমধ্যে এখানে অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তদন্তের পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে ডা. সংযুক্তা সাহার দুই সহযোগী ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহাকে গ্রেপ্তার করে ধানমণ্ডি থানা পুলিশ। ওই দুই চিকিৎসক এখন কারাগারে আছেন। প্রশ্ন হলো আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুর পেছনে দায় কি শুধু এই দুই চিকিৎসকের। তাদের যারা চিকিৎসার দায়িত্ব দিয়েছিল। ডা. সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতিতে তার অধীনে যারা আঁখিকে ভর্তি করেছিল তাদের কী কোনো শাস্তি হবে না? এখন পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। গ্রিন রোডের এই হাসপাতালটির এক সময় বেশ নামডাক ছিল। বিশিষ্ট চিকিৎসক এম আর খানের হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটি এখন অনেকটা বেহাত হয়ে গেছে। কারণ এম আর খানের উত্তরাধিকারী তার মেয়ে ম্যান্ডি করিম দুই বছর আগেই অভিযোগ করেছিলেন তাকে হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ তোলার পর এ পর্যন্ত তিনি আর হাসপাতালে যেতে পারেননি। যতটা জানা গেছে, হাসপাতাল পরিচালনা নিয়ে দুটি পক্ষ সক্রিয়। তাদের দ্বন্দ্বের কারণে রোগীরা সঠিক সেবা পাচ্ছেন না। হাসপাতালের অনিয়মের পাশাপাশি চিকিৎসকরাও যে পদে পদে অনিয়ম করছেন তার বড় উদাহরণ ডা. সংযুক্তা সাহা। নিজের নিবন্ধন নবায়ন না করে টানা ১৩ বছর ধরে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। মাসে একশ’র বেশি রোগীর প্রসবসেবা দিয়ে আসছেন তিনি। তিনি নিজেই এই হিসাব দিয়েছেন। ডা. সংযুক্তার মতো আরও বহু চিকিৎসক আছেন যারা বিএমডিসি’র সনদ নবায়ন না করেই চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। ভুয়া বা সনদ ছাড়াই চিকিৎসা দিয়ে আমাদের কথা আর নাই বললাম। এই যে বিনা নিবন্ধনে চিকিৎসা দেয়া, ভুয়া চিকিৎসকের চিকিৎসা দেয়া এসব দেখার দায়িত্ব কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
মন্ত্রণালয় এই দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করলে আঁখির মতো হবু মায়ের কিন্তু এমন পরিণতি হওয়ার কথা না। শুধু কী আঁখি? প্রতিদিনই এমন কোনো না কোনো মা বা সন্তানের জীবন ঝরছে ভুল চিকিৎসায়। হাসপাতাল বা চিকিৎসকের অবহেলায়। এসবের কী কোনো প্রতিকার হচ্ছে। ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে?
আঁখির মৃত্যুতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি দায়ীদের শাস্তি দেয়ার কথা বলেছেন। আমরা মনে করি এ ঘটনায় ব্যবস্থা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। এখানে কার কী দায়। কার কী দোষ তা খুঁজে বের করে প্রকৃত দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হোক। যাতে ভবিষ্যতে এমন আর একটি ঘটনাও না ঘটে। আঁখির মতো কোনো মায়ের এমন মৃত্যু না হয়।
পাঠকের মতামত
জানি না কোনো দিন কি আমাদের বাংলাদেশের মানুষ গুলোর বিবেক বদলাবে কি না? সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানের সেবা কেই বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত পয়শাকে নয়।
"চিকিৎসক কারাগারে, মালিকপক্ষ বাইরে কেন?" এটা খুব সহজ কথা। এদেশে আইন দুর্বলের জন্য, সবল বা প্রভাবশালীর জন্য আইন নয়। মালিক কেন কারাগারে যাবে? তার টুঁটি চেপে ধরবে, কার ঘরে কয়টা মাথা?
এইখানে অধিকাংশ দোষ মালিক পক্ষেরই। অথচ তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাহিরে। ঢাকার মত জায়গায় এত বড় ১টা হাসপাতালের যদি এত অব্যবস্থাপনা হয় তাহলে ভুইপোকার মত দেশের আনাছে কানাছে গড়ে উঠা হাসপাতাল গুলোর কি অবস্থা চিন্তা করে দেখুন। আর যারা এইগুলো তদারকির দায়িত্তে আছেন তাঁদের ব্যপারে কিছু বলতেও রুচিতে বাধতেছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন অনেক রোগী ভারতে যায় চিকিৎসার জন্য বলাহয় ঐখানে ডাক্তাররা রোগী কে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করে এবং চিকিৎসা সেবাও নাকি আমাদের দেশের চেয়ে অনেক ভালো আর চিকিৎসার নামে যেমন অহেতুক বিভিন্ন প্রকার উদ্দেশ্যহীন ল্যাবরোটারি টেস্ট দেয় না তেমনি চিকিৎসার নামেও অপচিকিৎসা করে না। সুতরাং আমাদের দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের উচিৎ বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক গুলো তে জনস্বার্থে তদারকি করা বেশি জরুরি।
সকল শয়তানির উৎস মালিক পক্ষ । তারা ডাক্তার ও রোগীদের চাপে ফেলে ব্যবসা করে । মানবতার বিষয় সম্পুর্ন অনুপস্থিত । এমনকি টাকা নিয়েও ভালো চিকিৎসা দেয়না ।