নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
জামায়াতের এপিঠ-ওপিঠ
শামীমুল হক
২২ জুন ২০২৩, বৃহস্পতিবারতত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন হয়। একটিতে বিএনপি অংশ নেয়। আরেকটি বর্জন করে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দোরগোড়ায়। এবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি মাঠে। দীর্ঘ দশ বছর পর প্রকাশ্য কর্মসূচিতে জামায়াতও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছে। ১৯৮৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেখা গেছে জামায়াতে ইসলামী কখনো আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে, আবার কখনো বিএনপি’র সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছে। তাই প্রশ্ন করতেই হয় জামায়াত আসলে কার? এখন যদি জামায়াতকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনও করতে দেখা যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না
আলোচনায় ফের জামায়াত। দীর্ঘ ১০ বছর পর ঢাকায় প্রকাশ্যে কর্মসূচির অনুমতি পাওয়া জামায়াতকে নিয়ে এখন দেশজুড়ে আলোচনা। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে ইতিমধ্যে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের বৈঠকের কথা। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে সমঝোতার প্রসঙ্গও টেনে আনছেন। যদিও আওয়ামী লীগ কিংবা জামায়াত কেউই বিষয়টি স্বীকার করেনি। কিন্তু অতীত কি বলে? ইতিহাস কি বলে? এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এ আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে এবং স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট এবং সেপ্টেম্বর মাসে বিএনপি’র নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট গঠিত হয়। এরই মধ্যে চতুর এরশাদ ১৯৮৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেয়। যদিও বেশি দিন ওই সংসদ টিকতে পারেনি। মাঠের আন্দোলন ফের চাঙ্গা হয়। এরশাদের পতন পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এ আন্দোলনে বহু মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। অবশেষে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়।
১৯৯০ সালের প্রথম থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো মিছিল-মিটিং-হরতাল সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। সারা দেশের ছাত্র সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনগুলোও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট একাত্ম হয়ে আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। তিন জোটের যৌথ ঘোষণা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। শেষ পর্যন্ত আর কোনো পথ যখন খোলা নেই এরশাদের সামনে। একা হয়ে পড়েন তিনি। বাধ্য হয়ে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন। তখন অবশ্য পদত্যাগ করা ছাড়া এরশাদের অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। এরশাদের এ পদত্যাগ ছিল সাংবিধানিক পন্থা অবলম্বন করে। ওই দিন তখনকার উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন। ওই পদে তিন জোটের মনোনীত প্রার্থী তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর এরশাদ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেন ১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিস্থিতির কারণে জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা যায়। ৪২৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী সহ মোট ২৭৮৭ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ৭৫টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। রেকর্ড সংখ্যক ৪৭ জন মহিলা নির্বাচনে প্রার্থী হন। সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেন। ৭৫টি দল নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রধান ৪টি দল ৯৩.৬৬ শতাংশ আসন পায়। ৮৪ শতাংশ দল কোনো আসন পায়নি। ওই নির্বাচনে কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। ভোটের ফলাফলে বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৮৮, জাতীয় পার্টি ৩৫, জামায়াত ১৮টি আসন পায়। এই সংসদ দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করে। ১৯৯১-২০০১ সময়সীমায় তিনটি সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। কিন্তু এই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলেও সরকারি দল এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে প্রায় সকল ইস্যুতে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ সংসদ বয়কটের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একদিকে উপ-নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ সংসদে কথা বলতে না দেয়ার অভিযোগ সহ বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করে বিরোধী দলগুলোর টানা সংসদ অধিবেশন বর্জন, সংসদীয় ব্যবস্থায় অচলাবস্থা তৈরি হয়। বিশেষ করে ১৯৯৪ সালের ২০শে মার্চ, মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশই বাড়তে থাকে। বিরোধী দলগুলো আর কোনো উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে, ওই বছরের ২৮শে ডিসেম্বর ১৪৭ জন সংসদ সদস্য একযোগে পদত্যাগের ঘোষণার ফলে পঞ্চম জাতীয় সংসদ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। এখানে উল্লেখ করতে হয় ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতও অংশ নেয়। আর ১৯৯৫ সালে জামায়াত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উত্থাপন করে। পরে আওয়ামী লীগ এ দাবি নিয়ে মাঠে নামে।
শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন। আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এ আন্দোলনে রাজপথ উত্তপ্ত করে তুলে। হরতাল, অবরোধে অচল করে তুলে সারা দেশ। এখানেও আওয়ামী লীগ-জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন করে। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেমন অংশ নেয়নি, তেমনি অংশ নেয়নি জামায়াতও। এখানেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সংসদ ২৬শে মার্চ সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করে ৩০শে মার্চ পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে। এখানে বলতে হয়, ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা ছিল না। বরং তা ছিল সামরিক শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি অস্থায়ী ফর্মুলা। কিন্তু সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থায়ী রূপ লাভ করে। ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৪৬টি আসনে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী অন্যান্য দলের মধ্যে বিএনপি ১১৬টি, জাতীয় পার্টি ৩২টি, জামায়াত ৩টি আসন পায়। এই নির্বাচনে মাত্র ১ জন স্বতন্ত্রপ্রার্থী জয়ী হন। তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান এবং জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ও জাসদ (রব)-এর সমর্থনে আওয়ামী লীগ ঐকমত্যের সরকার গঠন করে। এ পর্যন্ত জামায়াত ও আওয়ামী লীগের কর্মকা- ছিল সমান্তরাল। ’৮৬ সালের নির্বাচন, ’৯১ সালের সংসদ বর্জন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন সবই হয়েছে এক কাতারে। ২০০১ সালে এসে জামায়াত-বিএনপি’র সঙ্গে চারদলীয় জোটে একীভূত হয়। নির্বাচনে চারদলীয় জোট জয়লাভ করে। চারদলীয় জোট সরকারে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয় দেয়া হয়। তারপর তো ইতিহাস অন্য।
সরকারের শেষ সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়ে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। অবশেষে বিএনপি সকল অপশন বাদ দিয়ে সবশেষ অপশনটি বেছে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীনের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তারা সরে যান। এতে আরও হিতে বিপরীত হয়। আন্দোলন তীব্র হয়। ওদিকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। আবার বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টি প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল করা হয়। এ জন্য তার সকল মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করা হয়। দেশে নেমে আসে আবারো ঘোর অন্ধকার। ইয়াজউদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে ক’জন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। এ অবস্থায় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। দুই বছর পর এই সরকারের অধীনে হয় নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু এ সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন হয়। একটিতে বিএনপি অংশ নেয়। আরেকটি বর্জন করে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দোরগোড়ায়। এবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি মাঠে। দীর্ঘ দশ বছর পর প্রকাশ্য কর্মসূচিতে জামায়াতও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছে। ১৯৮৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেখা গেছে জামায়াতে ইসলামী কখনো আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে, আবার কখনো বিএনপি’র সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছে। তাই প্রশ্ন করতেই হয় জামায়াত আসলে কার? এখন যদি জামায়াতকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনও করতে দেখা যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।