নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
যুক্তরাষ্ট্রের আশা, চীনের শীতল প্রতিক্রিয়া
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৯ জুন ২০২৩, সোমবারব্লিনকেন এবং তার কূটনৈতিক টিম বলেছেন, তাদের এই সফরের উদ্দেশ্য হলো উত্তেজনা কমিয়ে আনা। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ নতুন করে শুরু করা উচিত। এক্ষেত্রে বড় কিছু অর্জন করা, অধিকতর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা বাইডেন প্রশাসনের জন্য অনেক জটিল ও কঠিন হবে। কারণ, সামনেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ২০২৪ সালের সেই নির্বাচনের মাঠে চীন বিরোধিতা ওয়াশিংটনে উত্তাপ ছড়াবে। তাই বলা যায়, এই সফরের মধ্যদিয়ে উভয় পক্ষের জন্য একটি সহজ সাধারণ পথ বের হয়ে আসবে। তা হলো যোগাযোগের, কথা বলার বিভিন্ন চ্যানেল বেরিয়ে আসবে, যা সামরিক সংঘাত প্রতিরোধে সহায়ক হবে।
রাজনীতির এক জটিল ও কঠিন সময়ে চীন সফরে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। চীনের স্পাই বেলুন বা গোয়েন্দা বেলুন নিয়ে সৃষ্ট সম্পর্কে তীব্র উত্তেজনার পাঁচ মাস পরে তিনি প্রথম চীন সফরে এলেন। বিশ্ব রাজনীতির যে টালমাটাল অবস্থা তাতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কে এই সফর কতোটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে বিশ্লেষণ! কারণ সারা বিশ্বের চোখে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন হলো দুই পরাশক্তি, সুপারপাওয়ার। তারা সাম্প্রতিককালে একে অন্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। শীতলযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এতটা বিরোধ তাদের মধ্যে আগে কখনো দেখা যায়নি। ওই বেলুন ইস্যুকে কেন্দ্র করে ব্লিনকেনের আগে নির্ধারিত চীন সফর আকস্মিকভাবে বাতিল হয়ে যায়। ওই বেলুনটি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশজুড়ে উড়ছিল। এতে সন্দেহ করা হয়, বেলুন দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছে চীন। এতে এমন কিছু উপাদান আছে, যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। উত্তেজনাকর অবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিমান গুলি করে ভূপাতিত করে ওই বেলুনকে। তারপর নতুন শিডিউল করে দুইদিনের জন্য চীন এসেছেন অ্যান্টনি ব্লিনকেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চরম উত্তেজনাকর সম্পর্ক বিরাজ করছে। তার সফরের উদ্দেশ্য দুই দেশের মধ্যে সেই সম্পর্ককে যতটা সহজ করা যায় তা করে স্থিতিশীল একটি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। শুরুতে গতকাল রোববার তিনি বৈঠক করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাংয়ের সঙ্গে। এই বৈঠক হয়েছে বেইজিংয়ে ডাইয়ুতাই স্টেট গেস্ট হাউজে। সেখানে ব্লিনকেনকে স্বাগত জানিয়েছেন কিন গ্যাং। এ সময় তারা নিজস্ব পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে করমর্দন করেন। তারপর যার যার প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে নিয়ে একটি লম্বা টেবিলে বৈঠক শুরু করেন। এই সফরে চীনের শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা রয়েছে ব্লিনকেনের। তবে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাক্ষাৎ পাবেন কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। জিনপিংকে শুক্রবারও বেইজিংয়ে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের সঙ্গে দেখা গেছে। বিশ্বের এই দুই শীর্ষ সুপারপাওয়ারের মধ্যে অমীমাংসিত ইস্যুর দীর্ঘ তালিকা আছে। তার মধ্যে অন্যতম উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে মতের অমিল। আছে সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান। তবে এই সফরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তা হলো- সম্পর্ক মেরামত, বাণিজ্যিক সংঘাতময় অবস্থা শিথিলকরণ ও যুদ্ধ এড়ানো।
সম্পর্ক মেরামত: ব্লিনকেনের সফরের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে যেকোনো রকমে কূটনৈতিক সম্পর্ককে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। গত মাসে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র কর্মকর্তারা সাক্ষাৎ করেন। সেখানে প্রাথমিকভাবে বরফ গলতে শুরু করেছে বলে ধরে নেয়া হয়। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সবচেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে চীন সফর করছেন ব্লিনকেন। ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর এটাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম চীন সফর। এখনই আলোচনা বা কথা বলার উত্তম সময়। কারণ, এতে যুদ্ধের ঝুঁকি কমে আসবে বলে মনে করেন ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ক সমন্বয়কারী এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ডেপুটি সহকারী কার্ট ক্যাম্পবেল। তিনি বলেন, আমরা এমন মতবিরোধকে মেনে নিতে পারি না, যা দিয়ে আমাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে। বৈশ্বিক অগ্রাধিকার নিয়ে এগিয়ে যেতে আমাদেরকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
তবে ব্লিনকেনের সফর নিয়ে চীনের প্রতিক্রিয়া ঘোলাটে। বুধবার রাতে ব্লিনকেনের সফর নিয়ে চীনের কর্মকর্তারা দোষারোপের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং বলেছেন, সম্পর্কের সাম্প্রতিক অবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী তা পরিষ্কার। চীনের উদ্বেগের বিষয়ে সম্মান দেখানো উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। চীনের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন স্বার্থকে প্রতিযোগিতার নামে খর্ব করা বন্ধ করতে হবে। চীনের এমন অবস্থানের কারণে ব্লিনকেনের এই সফরে উল্লেখযোগ্য কোনো ফল আসবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র কূটনীতিক ড্যানিয়েল জে. ক্রিতেনব্রিংক বলেছেন, দু’পক্ষ যেভাবে একে অন্যের সঙ্গে আচরণ করে তাতে বড় কোনো বিস্ময়কর কিছু প্রত্যাশা করবেন না। তবে যদি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনা কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও সংলাপের দিকে নিয়ে যায় এই সাক্ষাৎ তাহলে তা উভয়ের জন্যই ভালো কিছু হতে পারে।
বাণিজ্যিক সংঘাতময় পরিস্থিতি শিথিলকরণ: চীনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সম্পর্ক শুরুই হয়েছে একটি জটিল, কণ্টকময় অবস্থার মধ্যে। তার পূর্বসূরি সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে যে বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নিয়েছেন তা বাতিল না করার ইচ্ছা প্রকাশ করছে বাইডেন প্রশাসন। এসব ব্যবস্থায় চীনে তৈরি পণ্যের ওপর শত শত কোটি ডলার আমদানি কর বসানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চীনের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের কম্পিউটার চিপ চীনে রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। এর মধ্যদিয়ে প্রযুক্তি খাতে, ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সুপেরিয়রিটি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। পক্ষান্তরে এর জবাব দিয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রস্তুতকারক মাইক্রোনের তৈরি করা কম্পিউটারের মেমোরি চিপের ওপর নিজেরাই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে চীন। তাদের উদ্বেগের বিষয়টি স্বীকার করেন ক্যাম্পবেল। কিন্তু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে তার আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে এবং ব্যাখ্যা দিতে হবে এ পর্যন্ত তারা কী করেছে এবং সামনে আর কী অপেক্ষা করছে। যদি কম্পিউটার প্রযুক্তি এই দুই সুপারপাওয়ারের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়, তাহলে অধিক সহযোগিতার ক্ষেত্র হতে পারে অবৈধ ড্রাগের ব্যবসা। ফেনতানাইল তৈরিতে ব্যবহৃত চীনে প্রস্তুতকৃত রাসায়নিক উপাদান রপ্তানি সীমিত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ফেনতানাইল হলো সিনথেটিক পদার্থ, যা হেরোইনের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। গত সাত বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ফেনতানাইল সংক্রান্ত মাদকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মৃত্যুহার তিনগুণের বেশি হয়েছে।
যুদ্ধ এড়ানো: বেলুন ঘটনার পর রিপোর্ট প্রকাশ হয় যে, রাশিয়ায় অস্ত্র পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে চীন। সেই অস্ত্র ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার করতে পারে রাশিয়া। পরে এই অভিযোগ থেকে সরে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। কারণ, এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই দুই পরাশক্তির মধ্যে একটি প্রক্সি যুদ্ধ লেগেই থাকতো। তা সত্ত্বেও ভিয়েনাতে চীনকে সতর্কতা দিয়েছেন ব্লিনকেন। তিনি বলেছেন, যদি রাশিয়াকে সামরিক এবং আর্থিক সহযোগিতা দেয় চীন, তাহলে তাদেরকে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। ওদিকে তাইওয়ান প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনা যুদ্ধজাহাজগুলো মুখোমুখি অবস্থানে আছে। এসব এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে চীন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একই বক্তব্য। তারা বলছেন, এসব এলাকা হলো আন্তর্জাতিক জলসীমা।
ব্লিনকেন এবং তার কূটনৈতিক টিম বলেছেন, তাদের এই সফরের উদ্দেশ্য হলো উত্তেজনা কমিয়ে আনা। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ নতুন করে শুরু করা উচিত। এক্ষেত্রে বড় কিছু অর্জন করা, অধিকতর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা বাইডেন প্রশাসনের জন্য অনেক জটিল ও কঠিন হবে। কারণ, সামনেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ২০২৪ সালের সেই নির্বাচনের মাঠে চীন বিরোধিতা ওয়াশিংটনে উত্তাপ ছড়াবে। তাই বলা যায়, এই সফরের মধ্যদিয়ে উভয় পক্ষের জন্য একটি সহজ সাধারণ পথ বের হয়ে আসবে। তা হলো যোগাযোগের, কথা বলার বিভিন্ন চ্যানেল বেরিয়ে আসবে, যা সামরিক সংঘাত প্রতিরোধে সহায়ক হবে।