নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
নায়িকার কান্না নায়কের হাসি নাটক সিনেমায় এ কেমন ভালোবাসাবাসি?
রেজানুর রহমান
১৭ জুন ২০২৩, শনিবার
এই যে মাঝে মাঝে তারকাদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে বাহাস শুরু হয়- এতে নাটক, সিনেমার কদর কতোটুকু বাড়ে? কী দুর্ভাগ্য আমাদের সংসার বাঁচাতে নায়িকাদের প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে বসে কাঁদতে হয়। চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস হঠাৎ সন্তান কোলে নিয়ে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেন চিত্রনায়ক শাকিব খান তার স্বামী। তার সন্তানের পিতা। স্ত্রীর স্বীকৃতি চান তিনি। বিপরীত চিত্র দেখুন দেশের সিনেমার আলোচিত তারকা পরীমনিও একটি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে সাক্ষাৎকার দিতে এসে কাঁদলেন। তিনি আর সংসার চান না। ডিভোর্স চান। কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর পরিবেশ।
বাঘ এলো, বাঘ এলো...সেই গল্পটাই মনে পড়ছে বার-বার। চতুর রাখাল বালকের গল্প। হঠাৎ একদিন ‘বাঘ এলো, বাঘ এলো’ বলে ভয়ার্ত চিৎকার শুরু করে দিলো।
চিত্রনায়িকা পরীমনি এবং চিত্রনায়ক শরীফুল রাজের জীবন নাটকের মধ্যে রাখাল বালকের সেই গল্পের ছায়া পাওয়া যাচ্ছে। কারণ এর আগেও তাদের দাম্পত্য জীবনের টানা পড়েনের গল্প সোশ্যাল মিডিয়া সহ প্রচার মাধ্যমের সকল শাখায় তোলপাড় তুলেছিল। কোনো কোনো পত্রিকা, অনলাইন মিডিয়া তো বলেই দিয়েছিল পরীমনি আর রাজের সংসার আর টিকবে না। তাদের সংসারের ভাঙন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভক্ত-দর্শকের সে কী হাহাকার। আবার কেউ কেউ তাদের সংসার ভাঙার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরীমনি এবং শরীফুল রাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনের হাস্যোজ্জ্বল কিছু ছবি পোস্ট করলেন। সে সব ছবি দেখে সহজেই মনে হয়েছে তাদের দাম্পত্য জীবনের সংকট নিয়ে এতদিন পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক যা কিছু প্রকাশ হয়েছে সবই মিথ্যা ও বানোয়াট। তা না হলে দাম্পত্য জীবনের এমন মধুরতম আলিঙ্গনের ছবি তারা তোলেন কি করে? এই ছবি দেখে রাজ এবং পরীমনিকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা থেমে গেল। রাজ এবং পরীমনি এতটাই আন্তরিক ভাবে ‘সংসার খেলা’ শুরু করলেন যে, সবাই ধরেই নিলেন তাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা নাই। তারা সুখি দাম্পত্য জীবনযাপন করছেন। তুমি আর আমি দু’জনে দু’জনার। পৃথিবীর কোনো শক্তি নাই আমাদেরকে আলাদা করবে...

কিন্তু আবার সেই রাখাল বালকের মতোই আত্মচিৎকার শোনা যাচ্ছে পরীমনির কণ্ঠে। ‘আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে। রাজের সঙ্গে আর সংসার করা সম্ভব নয়। আমি আর রাজের বউ নই। আমি ডিভোর্স চাই।’ একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে ভিডিও সাক্ষাৎকারে কাঁদতে কাঁদতে এই কথাগুলো বলেছেন পরীমনি। তাকে দারুণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। উপস্থাপিকা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- আর কি এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়? পরীমনির সোজা সাপ্টা উত্তর- না। আর এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। মজার ব্যাপার হলো ওই দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে একই উপস্থাপিকার মুখোমুখি হয়েছিলেন শরীফুল রাজ। তিনিও স্ত্রী পরীমনির বিরুদ্ধে নানা কথা বলেছেন। আবার পরীমনিও তার স্বামী অর্থাৎ শরীফুল রাজের বিরুদ্ধেও একাধিক স্পর্শকাতর অভিযোগ তুলেছেন। ফেসবুক ও ভিউ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় পরীমনি ও রাজের এই দাম্পত্য বাহাস বেশ কাজে দিচ্ছে। ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ। আর সে কারণেই সবার আগ্রহ এখন রাজ ও পরীমনির দিকে। সংসার ভাঙলো নাকি এখনো টিকে আছে? আবার কেউ কেউ মন্তব্য করছেন এই সব নায়ক-নায়িকার সংসার থাকলেই বা কী? আর না থাকলেই বা কী? সংসার তো তাদের কাছে একটা সাইনবোর্ড মাত্র। সাইনবোর্ডের আড়ালে-আবডালে কতো কিছুই না হয়... তবে এই ক্ষেত্রে আমার একটি প্রশ্ন আছে। সংসারের সাইনবোর্ডের আড়ালে শুধু কি তারকারাই (মাফ করবেন সব তারকার কথা বলছি না) ‘কতো কিছু’ করেন? আর কেউ করেন না? যত দোষ নন্দ ঘোষের। তারকাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। অন্য পেশার মানুষের ব্যাপারে কোনো আলোচনা-সমালোচনা হয় না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। তারকাদের অনেকের জীবন তো খোলামেলা। কাজেই তারা তো আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই থাকবেন। ভিউ বাড়ানোর এই যুগে ইদানীং অনেক তারকা নাকি নিজেরাই নেতিবাচক গল্পের সূচনা করেন। কারণ ফেসবুক অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পজিটিভ খবরের ভিউ কম। নেগেটিভ খবরের ভিউ বেশি। একটি ভালো সিনেমার খবরের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। ওই সিনেমার নায়ক-নায়িকার ব্যাপারে যদি কোনো নেগেটিভ খবর প্রকাশ হয় তাহলেই কেল্লাফতে। লাইক আর কমেন্টস-এর হিড়িক পড়ে যায়।
ছোট একটা উদাহরণ দেই। পরীমনি সম্প্রতি একটি ভালো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। অরণ্য আনোয়ারের এই সিনেমার নাম- মা। কান ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটি গিয়েছিল। পরীমনি দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন এই সিনেমায়। প্রচার মাধ্যমে এ নিয়ে এক লাইন ভালো কথা পড়িনি, দেখিনি এখনো। অথচ পরীমনির সংসার ভাঙা না ভাঙা নিয়ে মুখরোচক সংবাদের ছড়াছড়ি সর্বত্র। কোনো কোনো মিডিয়া তো খবর কম্পোজ করে রেখেছে। রাজ এবং পরীর সংসারের ভাঙনের চূড়ান্ত খবর জানা মাত্রই যেন খবরটা আগে দিতে পারে। তাহলে ভিউ বাড়বে। কারণ এখন তো চলছে ভিউ-এর যুগ। ভালো-মন্দ বুঝি না। ভিউ বাড়লেই হলো।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও, কিছু ছবি আপলোড হওয়ার পর থেকেই মূলত পরীমনি ও রাজের দাম্পত্য জীবনের বাহাস শুরু হয়েছে। ভিডিওতে নায়ক শরীফুল রাজ, অভিনেত্রী তানজিন তিশা, নাজিফা তুষি ও চিত্রনায়িকা সুনেরা বিনতে কামালের কিছু ব্যক্তিগত অসংলগ্ন ছবি আছে। গভীর রাতে কেউ রাস্তায়, কেউ লিফটে মদ্যপ অবস্থায় যা মনে আসে তাই বলছেন। ফান করছেন। তাদের মুখে প্রকাশ অযোগ্য শব্দও শোনা গেছে। গভীর রাতে শরীফুল রাজের ফেসবুক আইডি থেকে এই ভিডিও আপলোড করার মাত্র ১৮ মিনিটের মাথায় তা ফেসবুক থেকে তুলে নেয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তাই হয়েছে। খারাপ খবর বাতাসের আগে ছোটে। তাও আবার তারকাদের অন্ধকার জীবনের খবর। অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ঘুম হারাম হয় পরীমনিরও। শুরু হয় তাদের দাম্পত্য জীবনের বাহাস।
পরীমনির বক্তব্য- স্বামী হিসেবে শরীফুল রাজ সততা ও বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। সব কিছু ভুলে গিয়ে পরীমনি রাজের সঙ্গে সুখে সংসার করতে চান। কিন্তু রাজ বড়ই বেপরোয়া। তার একদল বন্ধু আছে। তারাই তাকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। এক্ষেত্রে চিত্রনায়িকা সুনেরাহ বিনতে কামালের প্রতিই সন্দেহের তীর ছুড়েছেন তিনি। অন্যদিকে রাজের বক্তব্য- যে ভিডিওটি তার ফেসবুক আইডি থেকে ছাড়া হয়েছে তিনি এব্যাপারে কিছুই জানেন না। ১০ দিন আগে তিনি বাসা ছেড়েছেন। কেন বাসা ছেড়েছেন সেটা পরীমনি ভালো করেই জানেন। আরও জানেন চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম ও তার স্ত্রী। কারণ রাজ যেদিন বাসা থেকে বের হন সেদিন নাকি গিয়াস উদ্দিন সেলিম ও তার স্ত্রী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এটা রাজের বক্তব্য। কথিত ভিডিওর ব্যাপারে রাজ বলেছেন এই ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। রহস্যটা মূলত এখান থেকে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ভিডিও ফাঁস হলো রাজের ফেসবুক আইডি থেকে। অথচ রাজ বলছেন তিনি এব্যাপারে কিছুই জানেন না। পরীমনি প্রথমে এব্যাপারে সুনেরা বিনতে কামালকে দায়ী করলেও এখন অবশ্য সুর পাল্টেছেন। রাজের একজন আত্মীয়কে এব্যাপারে দায়ী করে বলেছেন, তিনি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চান। তদন্ত চান। কারণ তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে ভিডিও কে আপলোড করেছে।
এখন কথা হলো, ভিডিওটি তো অসত্য নয়। ভিডিওটিতে যা দেখা গেছে তা হয়তো সংশ্লিষ্ট তারকাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো এত কদর্য হবে কেন? পর্দার তারকা আর ব্যক্তি তারকার মধ্যে এত ফারাক? তাহলে কে কার কাছে শিখবে? এ নিয়ে অবশ্য ব্যাপক যুক্তিতর্কের অবকাশ আছে।
মূল প্রসঙ্গে আসি। এই যে মাঝে মাঝে তারকাদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে বাহাস শুরু হয়- এতে নাটক, সিনেমার কদর কতোটুকু বাড়ে? কী দুর্ভাগ্য আমাদের সংসার বাঁচাতে নায়িকাদের প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে বসে কাঁদতে হয়। চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস হঠাৎ সন্তান কোলে নিয়ে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেন চিত্রনায়ক শাকিব খান তার স্বামী। তার সন্তানের পিতা। স্ত্রীর স্বীকৃতি চান তিনি। বিপরীত চিত্র দেখুন দেশের সিনেমার আলোচিত তারকা পরীমনিও একটি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে সাক্ষাৎকার দিতে এসে কাঁদলেন। তিনি আর সংসার চান না। ডিভোর্স চান। কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর পরিবেশ। দুটি ঘটনায় ভালো সিনেমার অবস্থানটা কোথায়? অথচ সিনেমাকে পুঁজি করেই আজ তারা তারকা। লেখাটি শেষ করি। তার আগে একটি ছোট্ট প্রশ্ন। এর আগে দেখলাম অপু বিশ্বাস স্ত্রীর মর্যাদা পোক্ত করার জন্য কাঁদলেন। এবার দেখলাম পরীমনি সংসার বাঁচানোর জন্য কাঁদছেন। দুটি ক্ষেত্রেই স্বামীদের ভূমিকা যেন একটু বিতর্কিত। আরও বিতর্কিত আমাদের নাটক, সিনেমা। দাম্পত্য সংকট পরীমনি ও রাজের। অথচ দোষারোপ করা হচ্ছে পুরো সিনেমা অঙ্গনকে। এর দায় কার? শেষ খবরে জানা যায়, ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে পরীমনি ও রাজ একসাথে হয়েছিলেন কিন্তু এটা যে তাদের সম্পর্ক জোড়া লেগেছে এমন আভাস মেলেনি। এই ক্ষেত্রেও রাখাল ছেলের বাঘ এলো, বাঘ এলো সেই গল্পের কথাই মনে পড়ছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।