নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
বিভক্ত বিশ্ব, সৌদি ভিশন-২০৩০ ও চীনের বিআরআই
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১২ জুন ২০২৩, সোমবারএই সম্মেলনই বলে দিচ্ছে চীনকে কতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব। তাদের নেতৃত্বে আরব দেশগুলো যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে তারা চীনের সঙ্গে বাণিজ্য শক্তিশালী করতে চায়। চীনও নতুন নতুন দেশকে তার পাশে চাইছে। বিশেষত দক্ষিণ চীন সাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের উত্তেজনা বিরাজমান। সেখানে তাইওয়ানের সরাসরি পক্ষ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তার সঙ্গে আছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া। তাইওয়ানকে দখল করে নেয়ার জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর ঠিক বিপরীত অবস্থান চীনের। ফলে বিশ্বের বড় দুই পরাশক্তি শুধু এখানেই যে মুখোমুখি তা নয়, তারা নানা দিক থেকে বিপরীত মেরুতে। তাদের রাজনীতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে বিশ্ব
বিশ্ব স্পষ্টত বিভক্ত। পূর্ব আর পশ্চিম। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বিশ্ব এখন এই দুই মেরুতে বিভক্ত। একদিকের নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। অন্যদিকে চীন। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য পূর্বদিকের অনেক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করেছে। যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ানসহ আরও অনেক দেশ। আর চীন বলয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমারসহ বেশকিছু দেশ। ক্রমাগত বিশ্বে কর্তৃত্বের লড়াই চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হলেও চীন এগুচ্ছে কৌশলে। অনেকটা নীরবে। তার প্রমাণ ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবকে মিলিয়ে দেয়া। এ বছর মার্চ মাসে ওই দুই দেশের নতুন দোস্তির ঘোষণা দেয়ার আগে কেউ এমনটা আঁচ করতে পারেননি। একে একে এশিয়া, তথা পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে, একের পর এক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীন তার আধিপত্য বাড়াচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ভিন্ন। তারা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হওয়া সত্ত্বেও চীনের এই মাতব্বরি মেনে নিতে পারছে না। এ নিয়ে ভারতের পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। এশিয়ায়, তথা ভারতীয় উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে চীন। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কায় থাবা বিস্তার করেছে। হাম্বানটোটা বন্দর চীনের নিয়ন্ত্রণে। অনেকটাই চীন ও রাশিয়ানির্ভর হয়ে পড়েছে পাকিস্তান। সম্ভবত এ কারণেই তাদেরকে ঋণ দিতে একের পর এক শর্ত আরোপ করছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের দহরম মহরম। তাছাড়া অন্য অনেক দেশে চীন তার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। এমনকি বাংলাদেশেও বড় বিনিয়োগ করেছে চীন। তারা সামনে আরও বিনিয়োগের জায়গা খুঁজছে। এসব বিষয় ভারতের ইমেজের জন্য ক্ষতিকর। ভারতীয় উপমহাদেশে চীনের এই আধিপত্য ভারতের জন্য সহনীয় নয়। তাই তাদেরকে পশ্চিমাদের সঙ্গে তাল মেলাতে হচ্ছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি বদলে গেছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য চলে যাচ্ছে চীনের বলয়ে। এতদিন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট যে বাশার আল আসাদ ছিলেন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চোখে ‘অপরাধী’, তিনি এখন প্রিয় হয়ে উঠেছেন। তার দেশে প্রায় এক যুগ গৃহযুদ্ধ চলছে। এ সময়ে আসাদকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তাকে হত্যা করা হতে পারে এমন ভয় ছিল। এজন্যই তার অবস্থান নিয়ে ছিল নানা জল্পনা। অনেকে গুজব ছড়িয়েছিলো, তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। দুরবিন দিয়েও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর এখন? এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার নতুন করে যেন অভিষেক হয়েছে। একের পর এক কনফারেন্সে তার উপস্থিতি। ফলে নতুন এক মাত্রা পেয়েছে পরিস্থিতি।
এরই মধ্যে রোববার থেকে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে শুরু হয়েছে দশম আরব-চায়না বিজনেস কনফারেন্স। শেষ হবে আজ সোমবার। কিং আবদুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে বিশাল আয়োজন এ নিয়ে। তাতে উপস্থিত আরব দেশগুলো এবং চীন। তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার লক্ষ্য নিয়ে এই সম্মেলন। চীনকে বলা হচ্ছে এশিয়ার অর্থনৈতিক জায়ান্ট বা দৈত্য। তার সঙ্গে আরব দেশগুলোর সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো শনাক্ত করা হবে এই সম্মেলনে। এর আয়োজক সৌদি আরবের বিনিয়োগ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তার সঙ্গে সহযোগিতায় আছে আরব লীগ, চায়না কাউন্সিল ফর দ্য প্রোমোশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড এবং ইউনিয়ন অব আরব চেম্বার্স। আরব ও চীনের মধ্যে এটাকে বলা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ব্যবসা বিষয়ক সম্মেলন। এতে অংশ নিচ্ছেন কমপক্ষে দুই হাজার অতিথি। আলোচনা হচ্ছে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ফার্মাসিউটিক্যালস, স্টার্টআপ, ই- স্পোর্টস, পর্যটন ও খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিবিধ প্রসঙ্গ। এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করার কথা সৌদি আরবের জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান, রয়েল কমিশন অব এ১ইউ১-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমর আল মাদানি, কিং আবদুল্লাহ পেট্রোলিয়াম স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্স সেন্টারের প্রেসিডেন্ট ফাহদ আলাজলান এবং সৌদি এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহদ সিনডির। এর বাইরে বক্তব্য রাখার কথা হংকং এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড ক্লিয়ারিংয়ের চেয়ারপারসন লরা মে-লাং চা, লীগ অব আরব স্টেটসের সেক্রেটারি জেনারেল আহমেদ আবুল ঘেইতি এবং ব্যাংক অব চায়না ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিংসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টোং লি’র। এই সম্মেলনে চলছে ২০টি প্যানেল আলোচনা। চলছে ওয়ার্কশপ। এতে শীর্ষ স্থানীয় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, বিনিয়োগকারী এবং সরকারি কর্মকর্তারা আরব অঞ্চল এবং চীনের মধ্যে কীভাবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানো যায় তা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করছেন। সৌদি আরব এবং এশিয়ার জায়ান্ট চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কে এই কনফারেন্স অনুঘটকের মতো কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই দু’টি দেশই এখন গুরুতর কৌশলগত খাতগুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। হয়তো এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।
জুনের শুরুতে চীনের ন্যাশনাল এনার্জি এডমিনিস্ট্রেশনের প্রশাসক ঝাং জিয়ানহুয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সৌদি আরবের জ্বালানি বিষয়ক মন্ত্রী। এবার তার প্রতিনিধিদলসহ রিয়াদের আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে জ্বালানির বিভিন্ন খাতে সম্পর্ক শক্তিশালী করার বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত। এর উদ্দেশ্য সৌদি ভিশন-২০৩০ এবং চীনের বিআরআই। এর আগের মিটিংয়ে মার্কেটে জ্বালানি সরবরাহ নিরাপত্তা নিশ্চিতের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এটি হলো একটি যৌথ প্রকল্প, যার মধ্য দিয়ে অশোধিত তেলকে পেট্রোলিয়ামে রূপান্তর করা যায়। একই সঙ্গে হাইড্রোকার্বন ব্যবহারের উদ্ভাবনী ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হয়।
মে মাসে চীনের বাওশান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি ঘোষণা দেয়, সৌদি আরবের রাস আল খাইরে অর্থনৈতিক জোনে ১৫০০ কোটি সৌদি রিয়ালের একটি প্রকল্পে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। সেখানে তৈরি কর হবে ধাতব পাত। মার্চে জ্বালানি বিষয়ক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান সৌদি এরাবিয়ান ওয়েল কোম্পানি চীনের নোরিনকো গ্রুপ এবং পানজিন সিনচেং ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপের সঙ্গে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর উদ্দেশ্য চীনের লিয়াওনিং প্রদেশে একটি তেল পরিশোধনাগার এবং পেট্রোলিয়াম কমপ্লেক্স যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করা। এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে হুজাইন আরামকো পেট্রোলিয়াম কোম্পানি। এতে সৌদি আরামকোর থাকবে শতকরা ৩০ ভাগ শেয়ার। অন্যদিকে নোরিনকো গ্রুপ এবং পানজিন সিনচেং ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপের থাকবে যথাক্রমে শতকরা ৫১ ভাগ এবং ১৯ ভাগ শেয়ার। সম্প্রতি সৌদি আরবের বিনিয়োগ বিষয়ক মন্ত্রী খালিদ আল ফালিহ বলেছেন, আরব দেশগুলো এবং চীনর মধ্যে বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক সব সময়ই শক্তিশালী। তার ভাষায়- আরব দেশগুলো এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন কমপক্ষে দুই হাজার বছরের পুরনো। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তা আরও গভীর ও শক্তিশালী হয়েছে। এসব উদ্যোগের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরব-চায়না বিজনেস কনফারেন্সে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকারীরা আলোচনা করছেন। তিনি আরও বলেন, চীনের যে কৌশলগত নির্দেশনা তার সঙ্গে মিল আছে সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ এর।
রিয়াদে এই সম্মেলনই বলে দিচ্ছে চীনকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব। তাদের নেতৃত্বে আরব দেশগুলো যুক্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা চীনের সঙ্গে বাণিজ্য শক্তিশালী করতে চায়। চীনও নতুন নতুন দেশকে তার পাশে চাইছে। বিশেষত দক্ষিণ চীন সাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের উত্তেজনা বিরাজমান। সেখানে তাইওয়ানের সরাসরি পক্ষ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তার সঙ্গে আছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া। তাইওয়ানকে দখল করে নেয়ার জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর ঠিক বিপরীত অবস্থান চীনের। ফলে বিশ্বের বড় দুই পরাশক্তি শুধু এখানেই যে মুখোমুখি তা নয়, তারা নানা দিক থেকে বিপরীত মেরুতে। তাদের রাজনীতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে বিশ্ব।