নির্বাচিত কলাম
চলতি পথে
ধৈর্য, বৃষ্টি, লোডশেডিং ওয়েটিং ফর গডো!!!!
শুভ কিবরিয়া
১০ জুন ২০২৩, শনিবার
পাবলিক খাতকে টুকরো টুকরো করে নতুন নতুন বৃহৎ ব্যয়ের খাত তৈরি করা হয়েছে। নতুন নতুন কোম্পানি বানানো হয়েছে। সুশাসনের নামে এইসব কোম্পানিকে সেবা খাত থেকে বাণিজ্যিক খাতে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। নীতি দ্বারা চাপিয়ে পাবলিক খাতকে বৃহৎ লসের খাতে পরিণত করা হয়েছে। পাবলিক সেক্টরের পিডিবিকে ভেঙে দুর্বল করা হয়েছে। উৎপাদনের চাইতে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রির ব্যবস্থা করে পিডিবিকে বছরের পর বছর লসের চিরস্থায়ী খাতে পরিণত করা হয়েছে। তারপর ক্রমাগত প্রাইভেট খাতের আমদানি করা হয়েছে। ক্রমশ এই খাতে প্রাইভেট খাতের অংশগ্রহণকে পাবলিক খাতের চাইতে শক্তিশালী করা হয়েছে। এমনসব নীতি নেয়া হয়েছে, যেখানে আইনি-ব্যবসাগত-মুনাফাগতভাবে প্রাইভেট সেক্টর যাতে অবাধ মুনাফা করতে পারে, আর পাবলিক সেক্টর যাতে লস করতে পারে তার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে
বিদ্যুতের খাম্বা আছে, জেনারেটর আছে, হাজার হাজার কিলোমিটার লাইন আছে, চাহিদার দ্বিগুণ উৎপাদন ক্ষমতা আছে, হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ আছে, কিন্তু জ্বালানি নাই। তাই বিদ্যুৎও নাই।
ফেসবুকে, ইউটিউবে মনোযোগ দিয়ে মানুষের স্ট্যাটাস, কমেন্ট লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গত একমাসে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিশেষ করে আমেরিকার নতুন ‘বাংলাদেশ ভিসা নীতির মতো কাগুজে ঘোষণার পরপরই কেমন যেন ভাষা বদল ঘটে গেছে রাজনীতির। বাংলাদেশ থেকে বহু দূরের দেশ আমেরিকা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ২০ ঘণ্টা প্লেনে চেপে সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হয় সেখানে। সেখানে যাবার পথ, থাকার পথ বিড়ম্বিত হবার একটা কাগুজে হুমকিই কী রকমভাবে সব চেনামুখের ভাষা বদলে দিচ্ছে। যে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র জামায়াতে ইসলামীকে মাঠে নামতে দিতেই এতদিন নারাজ ছিলেন, তারাই এখন তাদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা করছেন, জামায়াতের রাজনৈতিক প্রোগ্রামের আবেদন গ্রহণও করছেন। যে আওয়ামী নেতারা বিএনপি’র সঙ্গে সংলাপের কথা শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতেন, মনে হতো বিএনপি’র সঙ্গে সংলাপ হলে, তাদের গায়ে আগুনের হলকা এসে দাগাবে-তাদেরই কেও কেও এখন মোলায়েম সুরে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক ডায়ালগের কথা বলছেন।

এই পরিবর্তন যে ঘটছে তাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতি মনে করা যায় না। এটা তাদের মনের কথাও নয়। উল্টো হাওয়া বইলেই আবার পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। ধরা যাক রাশিয়া-চীন-ভারতের বদৌলতে আমেরিকার কাউন্টার একটা চাপ তৈরি হলো, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল তাহলে আবার আদিরূপে আবির্ভূত হতে বিন্দুমাত্র সময় নেবে না। উল্টোটাও ঘটতে পারে। যদি আমেরিকান চাপে সরকার ক্রমাগত বিপর্যস্ত হতে থাকে, তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও স্বরূপে আবির্ভূত হবে। চড়াও হবে সরকার ও সরকারি দলের ওপরে। এই যে একে অন্যকে নির্মূল করার প্রবণতার রাজনীতি, সেটাই বাংলাদেশের জন্য সবচাইতে বিপজ্জনক প্রবণতা। আমাদের রাষ্ট্র যে, রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারলো না, তার মূল রোগ এই প্রবণতার মধ্যেই নিহিত। এই যে স্বাধীনতার পর থেকে দেশে এত সহিংসতার ঘটনা ঘটলো, এত হত্যা, এত মৃত্যু, এত ক্যু, এত গুম-খুন, জিঘাংসার ঘটনা ঘটলো তার মূলেও এই প্রতিহিংসা এবং নির্মূলের প্রবণতা। এই মূলরোগ বজায় থাকা অবস্থায় পাশার দান যতই উল্টাক কিংবা সচল থাকুক, রাষ্ট্রনৈতিক পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে হয় না।
০২.
বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি বুঝতে হলে, এখানকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কর্মকাণ্ডকে মনোযোগ দিয়ে বুঝতে হবে। কীভাবে এই খাতে নতুন নতুন বাঁক-বদল ঘটেছে, নতুন নতুন সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছে, জনগণ প্রতারিত হয়েছে- সেই মডেলটাই আমাদের সমাজে সব খাতে বহাল থেকেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের যেকোনো পরিবর্তনের ফল যেহেতু মানুষ দেখতে পায়-প্রত্যক্ষ করতে পারে, একে ঠিক কার্পেটের তলায় চাপিয়ে রাখা যায় না, ফলে এই খাতকে ও তার পরিবর্তনের ধারাকে মন দিয়ে বোঝা দরকার।
প্রথমে এই খাতে সরকারি খাতের অংশগ্রহণ ক্রমাগত কমানো হয়েছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ’র পরামর্শেই আমাদের দুর্বল সরকারগুলো দেশের বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে পাবলিক খাতকে দুর্বল করেছে। এর কায়দা ছিল দুটো। প্রথমে, পাবলিক খাতকে টুকরো টুকরো করে নতুন নতুন বৃহৎ ব্যয়ের খাত তৈরি করা হয়েছে। নতুন নতুন কোম্পানি বানানো হয়েছে। সুশাসনের নামে এইসব কোম্পানিকে সেবা খাত থেকে বাণিজ্যিক খাতে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। নীতি দ্বারা চাপিয়ে পাবলিক খাতকে বৃহৎ লসের খাতে পরিণত করা হয়েছে। পাবলিক সেক্টরের পিডিবিকে ভেঙে দুর্বল করা হয়েছে। উৎপাদনের চাইতে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রির ব্যবস্থা করে পিডিবিকে বছরের পর বছর লসের চিরস্থায়ী খাতে পরিণত করা হয়েছে। তারপর ক্রমাগত প্রাইভেট খাতের আমদানি করা হয়েছে। ক্রমশ এই খাতে প্রাইভেট খাতের অংশগ্রহণকে পাবলিক খাতের চাইতে শক্তিশালী করা হয়েছে। এমনসব নীতি নেয়া হয়েছে, যেখানে আইনি-ব্যবসাগত-মুনাফাগতভাবে প্রাইভেট সেক্টর যাতে অবাধ মুনাফা করতে পারে, আর পাবলিক সেক্টর যাতে লস করতে পারে তার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। পাবলিক সেক্টরে বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতির নামে, দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বিশেষ বিধানের নামে, বিইআরসি আইন সংশোধনের নামে-এসব অপকর্ম নিশ্চিত করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, লুণ্ঠনমূলক মুনাফা আর লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের বিধান নিশ্চিত করা । আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পেশাদার ব্যক্তিদের বদলে এর কর্তৃত্ব তুলে দেয়া হয়েছে অপেশাদার অকারিগরি সিভিল ব্যুরোক্রেসির হাতে। অন্যদিকে এই খাতে দেশের সক্ষমতাকে বিকলাঙ্গ করে আমদানিনির্ভর জ্বালানিনির্ভরতা তৈরি করা হয়েছে। পুরো খাতকে তৈরি করা হয়েছে দেশের ও বিদেশের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বিনিয়োগকারীদের অবাধ মুনাফার ক্ষেত্র হিসেবে। পলিটিক্যাল ইকোনমির সোর্স হিসেবে এই খাত ভুল ও ইচ্ছাকৃত ভুলনীতির অবাধ বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে আমজনতাকে। একদিকে তারা সেবা পাচ্ছে না, অন্যদিকে তাদের বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। বিদ্যুতের লোডশেডিং ও বেশি দাম আমাদের দেশীয় উৎপাদন খাতকে ফেলেছে দারুণ বিপদের মুখে। এই মডেল একদিকে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিনষ্ট করেছে অন্যদিকে জ্বালানি সুবিচার বা এনার্জি জাস্টিসকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
এই যে দেশের স্বার্থবিরোধী, নীতিহীন উন্নয়ন মডেল, এই মডেল ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়েছে অন্যান্য খাতেও।
০৩.
স্যামুয়েল বেকেটের বিখ্যাত নাটকের মতো এখন বাংলাদেশের জনগণের প্রতীক্ষা তাই একজন ‘গডো’র জন্য। এখানকার রাজনীতিতে, রাষ্ট্রনীতিতে সবাই এখন অপেক্ষা করছে, ‘ওয়েটিং ফর গডো’র জন্য। সেই গডো আসবেন, রাজনীতিতে সংলাপ করে দেবেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেবেন, সক্ষম নির্বাচন কমিশন বানিয়ে দেবেন, সুষ্ঠু-অবাধ-গ্রহণযোগ্য সবার অংশগ্রহণের নির্বাচন অনুষ্ঠান তৈরি করে দেবেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে দেবেন, সুশাসন আনবেন, দুর্নীতি কমাবেন, দেশের মধ্যে বাড়ন্ত অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্য কমাবেন, বেগমপাড়ার বাসিন্দাদের অবৈধ সম্পদের হিসাব নেবেন- দায়ীদের বিচার করবেন, দেশের বাড়ন্ত তাপমাত্রা কমানোর জন্য পরিবেশ সুরক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা নেবেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে সুনীতি আনবেন, দলদাস আমলাতন্ত্রের বদলে পেশাদার আমলাতন্ত্র চালু করবেন। হাজারো হাজারো কাজ করবার আছে সেই প্রতীক্ষিত গডোর।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেই গডো কি কখনো আসে? নাকি প্রতীক্ষাই সার!!!
পুনশ্চ: লেখাটা শেষ করি একটি গল্প দিয়ে।
এক তরুণ শিষ্য, গুরুকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে। ধরেন, আমি একটা স্বপ্ন দেখছি। বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে পথ হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, সামনে বাঘের আনাগোনা। আমি অন্য একটা পথ ধরলাম । দেখলাম সেদিকেও একদল সিংহ দাঁড়িয়ে আছে। এরপর আমি যেদিকেই যাচ্ছি, কোনো না কোনো হিংস্র জন্তুর দেখা পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতিতে আমি কী করব?’
গুরু মৃদু হেসে বললেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে তোমার উচিত ঘুম থেকে জেগে ওঠা।’
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক।
পাঠকের মতামত
Thanks Kibria Saheb for ur excellent piece of analysis on reality behind nagging power outages.
দ্বীন কায়েমের পথে যারা অবিচল, তারা হল আল্লাহর প্রিয়জন
"গরম" গরমে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তাই না ,এই গরমের জন্য প্রকৃতি দায়ী নয়! এই গরমের জন্য দায়ী মানুষ,শুনতে আজব হলেও এটাই বাস্তব! তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে গাছপালা, আর আমরা মানুষ কি করি গাছপালা লাগানোর বদলে আরো কেটে ফেলি! কথায় আছে না গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান, এখন কথাটা হবে গাছ লাগান নিজেকে বাঁচান
কে বলল বিদ্যুত নাই, লোডশেডিং চলছে । কালকে পত্রিকায় পড়লাম বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় একদিন ও লোডশেডিং হয়নি । উপদেষ্টার রাস্তায় প্রতিটি বাসায় কখনো লোডশেডিং হয় না । পরশু পত্রিকায় পড়লাম । একটু খোঁজ খবর নিয়ে লেখাটা লিখলে ভাল হত । অভাগা জনগণের জন্য শুধু বিদ্যুত বন্ধ রাখা হয়েছে - সেটা হয়তো শাস্তি স্বরূপ ।