নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
জাতীয় নির্বাচন: তাহলে কি সুড়ঙ্গের ওপাশে আলোর দেখা মিলছে?
শামীমুল হক
৮ জুন ২০২৩, বৃহস্পতিবার
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করে দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বের দেশগুলো। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই সব মহল নড়েচড়ে বসেছেন। সরকারি দল আওয়ামী লীগ চায় সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। যে সংবিধান থেকে তারাই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছে। ওদিকে বিএনপি চাইছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে সরকার পদত্যাগ করুক। এরপর তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্বাচনকালীন যে নামেই ডাকা হোক সেই সরকারের অধীনেই নির্বাচন হউক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের সবক’টি নির্বাচনে মানুষ দলবেঁধে ভোট দিয়েছে। নিজের ভোট নিজে দিতে পেরে উল্লাস করেছে। নির্বাচনের দিন সেই দৃশ্যই দেখতে চান সবাই। আর এ সময়ে যখন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমুর মুখে সংলাপের কথা শুনেন তখন দেশবাসী আশার আলো দেখতে পান। আবার যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মুখে শুনেন- আলোচনার বিকল্প কিছু নেই-তখনো তারা উদ্বেলিত হন। হাটে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে, চলা-ফেরায়, বাসে-ট্রেনে, চায়ের আড্ডা থেকে বিয়েবাড়ি সর্বত্র এখন একটাই চাওয়া দেশের স্থিতিশীলতা
সুড়ঙ্গের ওপাশে কি আলো দেখা যাচ্ছে? ক’দিন ধরে রাজনীতির মাঠের বেশ কিছু আলামত এ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর সংলাপের তাগিদ আসছে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে। সংলাপই পারে একমাত্র বর্তমান সংকটকে উতরে দিতে। ইতিমধ্যে নানা মাধ্যমে বিভিন্ন কথা হাওয়ায় ভাসছে। গুঞ্জন, গুজব তো বাংলাদেশে অহরহই বইছে। এক্ষেত্রেও কম যায়নি। তবে ভিসা নীতি ঘোষণার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ডাকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা ছুটে যান। তারা এক টেবিলে বসেন। এটাকে যদি আলোচনার সূচনা ধরি তাহলে বলতে হয়, শিগগিরই সুড়ঙ্গের ওপাশে আলোর দেখা মিলবে। যদিও দেশে আলোচনায় রাজনৈতিক কোনো বিষয়ের সমাধান হয়েছে এমন নজির নেই। তারপরও অতীতে হয়নি বলে ভবিষ্যতে হবে না- এমন তো কথা নেই। সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের কথাবার্তায় কিছুটা হলেও আশা জন্মায় মনে। তার উপর মঙ্গলবার রাজনীতির টালমাটাল এ সময়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমুর এক মন্তব্যে নড়েচড়ে বসেন সবাই। আমির হোসেন আমু কি বলেছেন? তিনি বলেছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি’র সঙ্গে আলোচনার দুয়ার খোলা। প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আলোচনা হতে পারে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ১৪ দল আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিকে আশ্রয় করে বিএনপি মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। এটা কারও পক্ষে-বিপক্ষে কিনা তা প্রমাণিত হবে আগামী দিনে বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে। আমরা বলতে চাই, প্রয়োজনে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি আসুক। আমরা বিএনপি’র সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে দেখতে চাই। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করার বাধা কোথায়? কীভাবে সেটা নিরসন করা যায় এটা আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা যেতে পারে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে সংলাপের বিকল্প কিছু নেই। আমরা মনে করি, সবকিছুই সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। অবশ্য আমির হোসেন আমু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঠিক উল্টো কথা বললেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করবে- এরকম কোনো সংকট বাংলাদেশে হয়নি। এ ছাড়া আপাতত বিএনপি’র সঙ্গে আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ নেয়নি
বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে সংলাপের বিকল্প কিছু নেই। আমরা মনে করি, সবকিছুই সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।

অবশ্য আমির হোসেন আমু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঠিক উল্টো কথা বললেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করবে- এরকম কোনো সংকট বাংলাদেশে হয়নি। এ ছাড়া আপাতত বিএনপি’র সঙ্গে আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ নেয়নি। বুধবার সকালে ৬ দফা দিবস উপলক্ষে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা শেষে তিনি এসব কথা বলেন। তবে তিনি বলেন, আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করবো। এটা নিজেদের সমস্যা, নিজেরাই সমাধান করবো। সময় বলে দেবে কখন কী হবে। আপাতত আলাপ-আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর বক্তব্য দলীয় বক্তব্য কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগের বক্তব্য দিলাম। এখানে আমু ভাইয়ের সঙ্গে আমার কন্ট্রাডিকশন নেই। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় তিনি প্রকাশ্যে আলোচনাকে প্রত্যাখ্যান করেননি। বলেছেন, সিদ্ধান্ত হয়নি। এখানেও প্রশ্ন সিদ্ধান্ত হতে কতোক্ষণ। ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, এমন কিছু হয়নি যে, জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আলোচনায় বসতে হবে। তিনি নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধানের পক্ষে মত দিয়েছেন। এ কথায়ই বোঝা যায় সংলাপ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে। তবে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি যদিও আমির হোসেন আমু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো জানায়নি। তবে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এলে বিএনপি এতে সায় দিবে বলেই মনে হয়। কারণ তাদেরও দাবি তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যাই হোক নির্বাচনের এখনো ছয় সাত মাস দেরি আছে। এ সময়ে নির্বাচনকে ঘিরে আমেরিকান ভিসা নীতি প্রণয়ন দেশের জন্য কতোটুকু সম্মানের? রাজনৈতিক দলগুলো এই ভিসা নীতিকে তাদের প্রতিপক্ষের উপর আরোপ করেছে বলে নিজেরা ঢেঁকুর তুলছেন। আদতে যে এই ভিসা নীতি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয় সেটা তারা ঠিকই বুঝেছেন। যে জন্য প্রধান তিনটি দলই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ডাকে সাড়া দেন। পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনকে অবাধ এবং সুষ্ঠু করার টার্গেটে স্বতন্ত্র ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে ঢাকায় ব্যস্ত সময় পার করছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। সরকার, বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে চলেছেন তিনি। এসব বৈঠকে রাষ্ট্রদূত জানার চেষ্টা করছেন মানুষের ভোটাধিকার কীভাবে নিশ্চিত হবে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েও কথা হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানো সম্ভব কিনা? সেই প্রশ্নও উঠছে। তবে নির্বাচনকালীন সরকার যে নামেই হোক তা সরকার এবং বিরোধী-সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে এমন কথাও আসছে। তাছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে তা বহুবার খোলাসা করেছেন হোয়াইট হাউস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানে অবিচল রয়েছে বলে সোমবারও জানিয়েছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (এনএসসি)’র স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন পরিচালক অ্যাডমিরাল জন কিরবি।
২৪শে মে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে এই ক’দিনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। মঙ্গলবার সকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে। মধ্যাহ্নে বসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। মির্জা ফখরুলের সঙ্গে বৈঠকে রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং প্রচারণা প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন বলে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এক টুইট বার্তায় নিশ্চিত করা হয়েছে। এর দু’দিন আগে পিটার ডি হাস ও জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের মধ্যে বৈঠক হয়। জিএম কাদের রোববার পিটার ডি হাসের সঙ্গে দেখা করতে তার গুলশানের বাসায় যান। ওই বৈঠকের মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল নির্বাচন।
আর বাংলাদেশের এই নির্বাচনের দিকেই দৃষ্টি গোটা বিশ্বের। নির্বাচনে যেন ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করে দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বের দেশগুলো। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই সব মহল নড়েচড়ে বসেছেন। সরকারি দল আওয়ামী লীগ চায় সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। যে সংবিধান থেকে তারাই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছে। ওদিকে বিএনপি চাইছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে সরকার পদত্যাগ করুক। এরপর তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্বাচনকালীন যে নামেই ডাকা হোক সেই সরকারের অধীনেই নির্বাচন হউক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের সবক’টি নির্বাচনে মানুষ দলবেঁধে ভোট দিয়েছে। নিজের ভোট নিজে দিতে পেরে উল্লাস করেছে। নির্বাচনের দিন সেই দৃশ্যই দেখতে চান সবাই। আর এ সময়ে যখন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমুর মুখে সংলাপের কথা শুনেন তখন দেশবাসী আশার আলো দেখতে পান। আবার যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মুখে শুনেন- আলোচনার বিকল্প কিছু নেই-তখনো তারা উদ্বেলিত হন। হাটে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে, চলা-ফেরায়, বাসে- ট্রেনে, চায়ের আড্ডা থেকে বিয়েবাড়ি সর্বত্র এখন একটাই চাওয়া দেশের স্থিতিশীলতা। নিজের ভোটটি নিজে দেয়ার ক্ষমতাটুকু চান তারা। এ কারণে সুড়ঙ্গের ওপাশে তাদের দৃষ্টি। সেখানে একটু আলো দেখতে চায় তারা। অন্ধকার ভেদ করে যে আলো ছড়াতে পারে ভালোবাসা। যে আলো হতে পারে স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার।