নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক
প্রস্তাবিত বাজেট কি আয় বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে?
জিল্লুর রহমান
৭ জুন ২০২৩, বুধবার
আয় বৈষম্য কমানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর টুল হচ্ছে আয় পুনর্বণ্টন। কিন্তু কীভাবে আয় পুনর্বণ্টন হবে? সরকার ধনীদের বেশি হারে কর আরোপ করবে এবং সেই অর্থ গরিবদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে বণ্টন করবে। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আয়করের হার পুনরায় ৩০ শতাংশ করা যেতে পারে। করোনা মহামারির আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আয়করের হার ছিল ৩০ শতাংশ। করোনায় মানুষের আয় কমে গেলে সরকার সর্বোচ্চ করহার কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। যেহেতু বাংলাদেশ করোনার প্রতিঘাত খুব ভালোভাবে সামলে নিয়েছে এবং অর্থনীতি আগের পথে ফিরে এসেছে, সুতরাং সর্বোচ্চ আয়করের হার আবারো ৩০ শতাংশ করা উচিত। সরকারের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ব্যয় আরও বাড়াতে হবে। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) জন্য বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২৪.৩ থেকে কমে ১৮.৭ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ দেশে এখনো ৩ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।
দারিদ্র্যের হার ও আয় বৈষম্য কমানোর জন্য সরকার দুইভাবে কাজ করতে পারে; আয় পলিসি বা ব্যয় পলিসি দিয়ে। সরকারের করসংক্রান্ত পলিসি পরিবর্তন করে গরিবদের করের বোঝা কমিয়ে এবং ধনীদের কর বাড়িয়ে দিলে আয় বৈষম্য কমাতে সাহায্য করে। প্রগতিশীল (Progressive tax) প্রত্যক্ষ করহার এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে প্রগতিশীল প্রত্যক্ষ করহার ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী আয়কর দেবে, যাদের আয় কম তারা কম হারে এবং যাদের আয় বেশি তারা বেশি হারে কর প্রদান করবে। ন্যূনতম করযোগ্য আয় থাকলে আয়কর দিতে হয়। প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ন্যূনতম করযোগ্য আয়সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। বর্তমানের মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় এটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। প্রস্তাবিত বাজেটে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে এমন করদাতার মোট আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম না করলেও আয়ের পরিমাণ নির্বিশেষে ন্যূনতম করের পরিমাণ দুই হাজার টাকা ধার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির আয় করযোগ্য না হলেও নির্দিষ্ট কয়েকটি সেবা গ্রহণ করার জন্য তাকে ২ হাজার টাকা আয়কর দিয়ে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত অপেক্ষাকৃত গরিব মানুষের ওপর পড়বে এবং তাদের স্বল্প আয়ের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পদের ওপর সারচার্জ প্রদানের ক্ষেত্রে বর্তমানের ন্যূনতম সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে যাদের আয় কম তাদের ওপরে আয়ের বোঝা বসিয়ে দিয়ে যাদের সম্পদ বেশি তাদেরকে ছাড় দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দারিদ্র্যের হার কমাতে বাধা সৃষ্টি করবে এবং আয় বৈষম্য বাড়িয়ে দেবে।

দারিদ্র্যের হার ও আয় বৈষম্য কমাতে সরকারের ব্যয় পলিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় করে দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ ধনীদের ওপরে আয়কর বসিয়ে অর্জিত অর্থ সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এতে দেশের জনসাধারণের মধ্যে আয়ের ভারসাম্য বজায় থাকে। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা বর্তমান অর্থবছরে ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। জিডিপি’র অনুপাতে সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ ২.৫২ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ২.৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই খাতে বরাদ্দ সামান্য পরিমাণ বাড়লেও তা জিডিপি’র অনুপাতে কমেছে, যা কাক্সিক্ষত নয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে একটি দেশে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপি’র ৫-৬ শতাংশ হয়। বাংলাদেশে এটি অনেক কম। সেখানে আগামী অর্থবছরে আরও কমে যাবে। বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নয় এমন কিছু খাত সামাজিক সুরক্ষা খাতের মধ্যে বিবেচনা করা হয়। এগুলো বাদ দিলে, এই খাতের বরাদ্দ জিডিপি’র ২ শতাংশের কম হবে। সুতরাং সবকিছু বিবেচনা করলে সামাজিক সুরক্ষা খাত বা ব্যয় খাতেও দেশের ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য কমানোর জন্য কোনো বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
করণীয় কি?
আয় বৈষম্য কমানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর টুল হচ্ছে আয় পুনর্বণ্টন। কিন্তু কীভাবে আয় পুনর্বণ্টন হবে? সরকার ধনীদের বেশি হারে কর আরোপ করবে এবং সেই অর্থ গরিবদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে বণ্টন করবে। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আয়করের হার পুনরায় ৩০ শতাংশ করা যেতে পারে। করোনা মহামারির আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আয়করের হার ছিল ৩০ শতাংশ। করোনায় মানুষের আয় কমে গেলে সরকার সর্বোচ্চ করহার কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। যেহেতু বাংলাদেশ করোনার প্রতিঘাত খুব ভালোভাবে সামলে নিয়েছে এবং অর্থনীতি আগের পথে ফিরে এসেছে, সুতরাং সর্বোচ্চ আয়করের হার আবারো ৩০ শতাংশ করা উচিত। সরকারের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ব্যয় আরও বাড়াতে হবে। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) জন্য বরাদ্দ কমানো হয়েছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মাঝে ওএমএস’র বরাদ্দ কমানো অনাকাক্সিক্ষত ছিল। ওএমএসসহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পরিশেষে, সরকার আগামী বাজেটে ব্যক্তির আয় করযোগ্য না হলেও যে মিনিমাম কর ধার্য করা হয়েছে, সেটি অবশ্যই ফাইনাল বাজেট থেকে বাদ দেয়া উচিত। তা হলে কিছুটা হলেও আয় বৈষম্য কমে আসবে বলে আশা করি।
লেখক: জিল্লুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সহযোগী পরিচালক র্যাপিড।
মন্তব্য করুন
নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন
নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত
বেহুদা প্যাঁচাল/ অর্থমন্ত্রীর এত বুদ্ধি!
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ বাংলাদেশের অর্থ পাচার, ভারতের আনন্দবাজার, ইউরোপের কালো তালিকা
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ নির্বাচন ঘিরে একই প্রশ্ন, আমেরিকা কি ম্যানেজ হয়ে যাবে?
আন্তর্জাতিক/ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পশ্চিমাদের অবস্থান
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, সরকারের নীরবতা, অ্যাকশনে অন্যরাও?

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]