ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক

আব্বাস আলীদের বাজেট

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
৬ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

বাজেট একবার পাস হয়ে গেলে তারে আর পায় কে? বেচারা সম্পূরক বাজেট, যা পেশ করা মাত্র পাস হয়ে যাবে। আব্বাস আলীর মাথায় অনেক কিছু ঢোকে না, ঢুকলে পরক্ষণে তা বেরিয়ে যায়- অনেক কিছু মনে রাখতে পারে না। এ ধরনের স্বভাব কাণ্ডজ্ঞানের কিছুটা অভাব তার ঘটতে শুরু করে করোনার কালে। করোনার সঙ্গে সে সময় দু’ একবার তার দেখা সাক্ষাৎ ঘটলেও তার খুব বেশি কাছাকাছি সে হয়নি। কিন্তু করোনারে ঠেকানোর নামে ভ্যাকসিন নাকি যেন (তিন নামে তিন ডোজ) সে নিয়েছিল সেই থেকে তার শরীরে মনে ও মাথায় ভ্যাকসিনের পাহারাদার এমনভাবে বসেছে যে, এখন ছোটখাটো ব্যারামে সে কোনো ওষুধ খেলে কাজে দেয় না। ‘ওষুধ খেলে এক সপ্তাহ না খেলে ৭ দিন’ এসব হেয়ালি বাক্য এখন আর পাত্তা পায় না।

মিডিয়ার বদৌলতে বাজেট সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারে আমজনতা। তাদেরই একজন আব্বাস আলী। বাজেটের সময় হিসাব নিকাশের অভ্যাস আব্বাস আলীর অনেকদিন থেকে। বলতে গেলে সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। আব্বাস আলীর মনে আছে বাংলাদেশের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন, (বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী) তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ।

বিজ্ঞাপন
বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। বাজেটের শেষের দিকে সুন্দর করে হিসাব দিয়েছিলেন কোন খাতে কতো টাকা আয় এবং ব্যয় হবে। আব্বাস আলীদের আকিঞ্চন অকাক্সক্ষা আহা বাংলাদেশের বাজেট উপস্থাপনা যদি সেই প্রথম ফর্মেট অনুসরণ করে করা হতো! বাজেট সরকারের সঙ্গে জনগণের মধ্যকার রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্পর্কের ব্যাখ্যা বা দলিল। বাজেটে খোলাসা করা থাকবে কীভাবে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, কীভাবে সংকট মোকাবিলা করা হবে। মোদ্দাকথা, বাজেট কীভাবে আব্বাস আলীদের হবে।
মানুষ সময়ের সন্তান-একেক পরিবেশে সে একেক রকমের প্রতিক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এগোয়। আর্থসামাজিকভাবে দেশ ও অর্থনীতির এগুনো পিছানোটা এখনো খোলাশা হয়নি আব্বাস আলীর কাছে। আজ যা তার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে দু’দিন পরে তার মনে হয় আগেরটা ঠিক ছিল না। ঠিক আর বেঠিকের বৈঠকখানাতেই তার সময় কেটে যায়। বড় ঘরে পৌঁছানো এখনো তার কাছে মনে হয় ঢের বাকি।

আব্বাস আলীর দুনিয়া কতো আর বড়, ভূগোল বইয়ে আকাশ আর পৃথিবীর আকার অবয়ব নিয়ে সে যা পড়েছে তাবৎ ধর্মগ্রন্থে তার চৌহদ্দী অন্যরকম মনে হয় তার। তবুও আকাশ আর পৃথিবীর সম্পর্ক সুপ্রাচীন এবং তারা একে অন্যের পরিপূরক। কোন এক বইয়ে সে পড়েছিল শুক্রবারে কেয়ামত হবে। সে তখন ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ে। তার আত্মীয়বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সমবয়সীদের সঙ্গে কিয়ামত নিয়ে আলোচনা হয় কোন এক বৃহস্পতিবারের রাতের বেলায়। সবার মনে ধারণা গেঁথে যায় আগামীকাল শুক্রবার হয়তো কেয়ামত হতে পারে। সবাই ঘুমুতে যায় কেয়ামতের আগের রাতের ঘুমে। সকালে উঠে দেখে কিছুই হয়নি। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে তারা। শেষে একথা বা ব্যাখ্যা এলো সৃষ্টিকর্তা হয়তো ভুলে গেছেন আজ। পেটমোটা পল্টু বললো পরের কোনো এক শুক্রবারের জন্য এটি রেখে দেয়া হয়েছে, সৃষ্টিকর্তার কতো কাজ! সেই থেকে আব্বাস আলীরা মনে করে দিন তারিখ ভিত্তিক কোনো ভাব কল্পনা আশঙ্কা প্রকাশে যাবে না। নতুন বাজেট দেয়ার আগে কতো কথা বলে সবাই। ৩০শে জুন পাস হবার পর এই বাজেট নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না সারা বছর চুপ থাকে। সম্পূরক বাজেট পাসের সময় কেউ প্রশ্ন করে না, আপত্তি তোলে না কেন আয় কিংবা ব্যয় কম বা বেশি হয়েছে। কেউ জানতে চায় না আয় বা ব্যয় যথাযথ হয়েছে কিনা।

একবার বাজেটের পরে কথা উঠেছিল আগামী মাসের অমুক তারিখে কেয়ামত হবে। আব্বাস আলী তখন দূরদেশে পরিবার পরিজন নিয়ে বাস করতো। তার দেশে যখন সকাল সাড়ে ১০টা তখন কেয়ামত হওয়ার কথা আব্বাস আলীর পিএ হরমুজ মিয়া সবে বিদেশে কর্মস্থলে এসেছে বউ বাচ্চা নিয়ে। দুপুরের দিকে হরমুজ আলী বললেন, ‘স্যার আমার বউ বড্ড ভয় পাচ্ছে, আমি বাসায় যাই, কেয়ামতের পর আমি আবার অফিসে আসবানে।’ আব্বাস আলীর ভীষণ হাসি পায়, বলে, ‘হরমুজ মিয়া কেয়ামত হলে তোমার আমার দেখা সাক্ষাতের সুযোগ থাকবে না।’ এ ধরনের তাজা এবং বেকুব মন্তব্যের জন্য হরমুজ মিয়া বেশ লজ্জা পায়। সে তার বাসায় চলে গেল। সেদিন কেয়ামত হয়নি। সে সময় দেশের ডাকসাইটে পত্রিকায় একটা বড় কার্টুন-কাহিনী ছাপা হয়েছিল। কেয়ামত না হওয়ার কারণ নিয়ে। বিশিষ্টজনদের মতামত ছিল এরকম- একজন সাবেক স্বৈরশাসক বললেন, কেয়ামত হলে ভালোই হতো- লোকে আর আমাকে স্বৈরাচার বলতে পারতো না। বিরোধী পক্ষীয় একজন বললেন, আমরা মহাসমাবেশে এ ব্যাপারে ষোষণা দিইনি তো সেজন্য কেয়ামত হয়নি। ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা করেন এমন একজন মনে করেন এখানে পাক পবিত্রতার অভাবে দিন তারিখ মেলে নাই। সবশেষে মহাজ্ঞানী একজন বললেন, আমাদের পূর্ব পুরুষ এ ধরনের স্বপ্ন দেখেননি বলে কেয়ামত হয়নি। বাজেট বানানো, পেশ, সংসদে আলোচনা, নামকাওয়াস্তে ছাটাই প্রস্তাব আনা এবং সব শেষে কণ্ঠভোটে (‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে’) তা পাস হওয়া সবই এমনভাবে হয় যে আব্বাস আলীরা মনে করে এ তো কেয়ামত হতে চেয়ে না হওয়ার মতো ব্যাপার। একেক জনের এক এক ব্যাখ্যা।

বাজেট একবার পাস হয়ে গেলে তারে আর পায় কে? বেচারা সম্পূরক বাজেট, যা পেশ করা মাত্র পাস হয়ে যাবে। আব্বাস আলীর মাথায় অনেক কিছু ঢোকে না, ঢুকলে পরক্ষণে তা বেরিয়ে যায়-অনেক কিছু মনে রাখতে পারে না। এ ধরনের স্বভাব কাণ্ডজ্ঞানের কিছুটা অভাব তার ঘটতে শুরু করে করোনার কালে। করোনার সঙ্গে সে সময় দু একবার তার দেখা সাক্ষাৎ ঘটলেও তার খুব বেশি কাছাকাছি সে হয়নি। কিন্তু করোনারে ঠেকানোর নামে ভ্যাকসিন নাকি যেন (তিন নামে তিন ডোজ) সে নিয়েছিল সেই থেকে তার শরীরে মনে ও মাথায় ভ্যাকসিনের পাহারাদার এমনভাবে বসেছে যে, এখন ছোটখাটো ব্যারামে সে কোনো ওষুধ খেলে কাজে দেয় না। ‘ওষুধ খেলে এক সপ্তাহ না খেলে ৭ দিন’ এসব হেয়ালি বাক্য এখন আর পাত্তা পায় না। বাজেটে জিনিসপত্রের দাম বাড়া কমার, সেবা ও সৌজন্যের তালিকা দেখতে গেলে আর যাই হোক স্মরণশক্তির খাতায় হার্টের রোগীর পালস রেটের মতো লাইন সোজা হতে চায়। বাজেটে অর্থমন্ত্রীর সুন্দর সুন্দর কথা শান্তিনগর কাওরান বাজারের খুচরা পাইকারি ক্রেতা বিক্রেতার কানে পৌঁছার কোনো উদাহরণ আব্বাস আলীর কাছে নেই। বাজেটে বড় লোকের সুযোগ-সুবিধার কথা থাকে বেশি। আব্বাস আলীর মনে পড়ে যায় বৃটিশ সেই স্বগতোক্তির কথাÑ ‘বোকারা রাঁধে বাড়ে চালাকেরা খায়’। চোখ ট্যারা পণ্ডিত মশাই বলেন, এখন আব্বাস আগে খালি পায় থাকতি এখন স্যান্ডেল পরিস, আগে মাটির ঘরে কাটাতিস এখন পাকা ঘর হয়েছে তোর, আগে মোকামে উঠতে কতো কষ্ট হতো এখন চটজলদি সেখানে পৌঁছাতে পারিস-কতো উন্নয়ন উন্নতি! আব্বাস আলী উন্নয়নের মারপ্যাঁচ বোঝে না, সে বোঝে, কোনো মতে খেয়ে পরে বাঁচতে চাই, ধারকর্জ করে ঘি খাওয়া ঠিক না, উন্নয়নের নামে বায়ান্ন বছরে কতো টাকা ধারকর্জ করে ঢালা হয়েছে, তার থেকে কতো টাকা সরানো হয়েছে, বোকাকে লুঙ্গি থেকে প্যান্ট পরানোর বুঝ দিয়ে বাহবা নিয়েছে ঘরের তস্করেরা। আগে সাত সমুদ্দুর দূরের লোককে দোষ দিয়ে, এমনকি ষাট-সত্তর বছর আগে ‘হাজার মাইল দূরের’ শোষক স্বৈরাচারকে (যিনি বা যারা ডিকেড অব রিফর্মস এর ভেল্কি দেখিয়েছিলেন) দোষ দেয়া যেতো, এখন? শিক্ষায় ব্যক্তির পকেট ব্যয় বাড়িয়েও দক্ষ ও ন্যয় নীতিবান জনসম্পদ তৈরি হয়নি, অর্ধ শিক্ষিত বেকারের ভাড়ে ন্যুব্জ অর্থনীতিতে বাইরের লোকেরা এসে চাকরি করে রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছে, অদক্ষ শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমিকের কস্টার্জিত রেমিট্যান্সের ওপর ভরসাকারী অর্থনীতিতে। স্বাস্থ্যখাতেও চিকিৎসা ব্যয় ব্যক্তির পকেট থেকে যাচ্ছে, করোনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা, সেবা দানে অপারগ পরিস্থিতির, ঋণের টাকায় যোগাড় করা ভ্যাকসিন আব্বাস আলীরা ফ্রি পেয়ে ধন্য হয়েছে, কিন্তু ব্যাংকে তার জমানো টাকা বেহাত হওয়ার বিচার আচার, তদন্ত ও উদ্ধার শেষ হওয়া দেখে যেতে পারবে কিনা এই সন্দেহ সন্দিহানে ব্যামো বাড়ছে তার। বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ছিটেফোটা ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়, বলা হবে, কিন্তু আব্বাস আলীর হিসাব মেলে না।

মিলবে কীভাবে, আব্বাস আলী অতি দ্রুত এটা সেটা ঘটতে দেখে তার চোখের চশমার পাওয়ার পরীক্ষা করতে হয়েছে দু-দুবার। চোখ বিশেষজ্ঞ বলেছেন চোখের পাওয়ার ঠিক আছে মনের পাওয়ারটা একটু মেপে দেখতে পারেন। আব্বাস আলী মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যায়, যিনি একজন সুলেখিকা। তিনি বললেন, ‘আরে ধ্যুৎ ওসব কিছু না আপনি মনের ভাড় কমান। আপনি চারদিকে যা শুনছেন, দেখছেন এবং বুঝছেন ওসব আপনার মনের মধ্যে তালগোল পাকাচ্ছে।’ ‘তাহলে কি ওসব দেখবো না, শুনবো না, বলবো না?’ ‘আরে না তা করবেন না কেন? তবে জাপানের সেই প্যাগোডার ৩ বানরের কথা মনে করুন, বানরেরা একজন চোখ বন্ধ করে রেখেছে একজন কান একজন মুখ। অর্থাৎ তারা খারাপ কিছু দেখবে না, মন্দ কিছু শুনবে না এবং বাজে কথা বলবে না। আব্বাস আলী ঠাওর পায় না এ প্রেসক্রিপশনের। বলে মনোবিশেষজ্ঞকে, ‘তাই আমি কি করতাম? অন্ধ হয়ে বোবা হয়ে কালা হয়ে বসে সময় কাটাবো?’ বিশেষজ্ঞ আপা বললেন, ‘হয়তো তাই, নয়তো নয়’, এ আবার কেমন কথা? আজকাল পক্ষ বিপক্ষের লোকেরা সকাল বিকাল এমন সব বয়ান ছাড়েন আব্বাস আলীদের কাছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোধগম্য হয় না। একজনের মাজা ভেঙে দিয়ে আরেকজন বলে ওর মাজা ভেঙে গিয়েছে ও আর দাঁড়াতে পারবে না ও ‘বিকল’ হয়ে গেছে। তারা একে অন্যের মাজা ভাঙতে থাকুন কিন্তু আমজনতার জন্য কী করলেন বা রেখে যাচ্ছেন তা আব্বাস আলীদের বোধগম্য করানো যাচ্ছে না। ক্ষতি যা হবার তা হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ, মানব সম্পদ, দক্ষ জনবল কোথায়? বিদেশিরা এসে বেতন নিয়ে যাচ্ছে, স্বার্থের টানাটানিতে ভূ-রাজনীতির ভায়রা ভাইদের সংখ্যা বাড়ছে। যে যখন যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে নিজেদের আখের গোছাতে যেয়ে অন্যের জানমাল ও মনোবলের ধ্বংস সাধনে তৎপর। বিশাল বাজেটের আগে এখন আব্বাস আলীদের একেকটা দিন ও রাত্রি হিসাব মেলানোর সুযোগ তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। খাঁড়ার উপর মড়ার ঘায়ের মতো শোনা যাচ্ছে এই হিসাবের কাগজ বানাতে। সব্বাইকে ২০০০ টাকা ট্যাক্স দিতে হবে, তবে সেটা সরকারকে না রাষ্ট্রকে আব্বাস আলীরা সেটাও বুঝতে পারে না।

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status